নান্দনিকতা, আবেগ, অর্জন এসব কিছু মিলিয়েই ফুটবল। বিশ্বের প্রায় দুই শত কিংবা তারও বেশি দেশ ফুটবলের এই নান্দনিকতায় মুগ্ধ হয়ে নিজেদেরকে জড়িয়ে নিয়েছে ফুটবলের সাথে। ফিফার সদস্য সংখ্যা এখন ২১১। জনপ্রিয়তা প্রমাণের এর থেকে ভাল নিয়ামক কি বা হতে পারে আর? যেখানে পুরো পৃথিবীর অধিকাংশ স্বাধীন রাষ্ট্র জড়িয়ে আছে প্রাচীনতম এই খেলার সাথে।
পৃথিবীর সেই শুরু থেকে যে সকল সভ্যতা প্রভাবিত করেছে পৃথিবীর ইতিহাসকে সে সকল সভ্যতার মাঝে ‘রোমান সভ্যতা’ অন্যতম। বর্তমান ইউরোপের দেশ ইতালির রোম শহরকে ঘিরে গড়ে উঠেছিল বলেই কি না দেখে নামকরণ করা হয় রোমান সভ্যতা। প্রাচীনতম এই সভ্যতা যেমন প্রভাবিত করেছিল গোটা পৃথিবীর ইতিহাসকে ঠিক সে রকম করেই সেই সভ্যতার পরবর্তী প্রজন্ম প্রভাব বিস্তার করে প্রভাবিত করেছে ফুটবলের ইতিহাসকে। ফুটবল মানেই তো এখন পুরো বিশ্ব।
ফুটবলকে ঘিরে সম্মানের, অর্জনের সবচেয়ে বড় আয়োজন ফিফা বিশ্বকাপের চার বারের চ্যাম্পিয়ন পৃথিবীর অন্যতম সুন্দর শহর ভেনিসের দেশ ইতালি। আজ ‘খেলা ৭১’ হাজির হয়েছে তাঁদের সর্বকালের সেরা একাদশ নিয়ে। ইতালির ফুটবলের ইতিহাসে রক্ষণভাগ ছিল সর্বদাই পরিপূর্ণ। কত কিংবদন্তি আগলে রেখেছিলেন ইতালির গোল বার। তাঁদের মধ্যে থেকে সেরা চার রক্ষণভাগের খেলোয়াড় বাছাই করা বেশ কষ্টসাধ্য কাজ, তাইতো আজকের ফরমেশন ৫-৩-২।
হালের সেরা কোচদের একজন হোসে মরিনহোর একটি বহুল প্রচলিত উক্তি রয়েছে, ‘আক্রমণ আপনাকে ম্যাচ জেতাবে, আর রক্ষণ জেতাবে শিরোপা।’ তাঁর এই উক্তিতে অনুপ্রাণিত হয়ে ইতালির এই রক্ষণাত্মক ফরমেশনের সূচনা করা যাক। আর ইতালি বরাবরই রক্ষণাত্মক ফুটবলই খেলে এসেছে।
- গোলরক্ষক: জিয়ানলুইজি বুফন
ইতালির হয়ে সর্বোচ্চ ম্যাচে অংশগ্রহণের রেকর্ডটা যিনি নিজের দখলে রেখেছেন তিনি জিয়ানলুইজি বুফন, তিনি অবশ্য জিজি বুফন নামেই অধিক পরিচিত। ইতালির গোলবারের ১৭৬ ম্যাচের দেয়াল জিজি বুফন। অতন্দ্র প্রহরীর মত সর্বদা সজাগ থেকেছেন, সার্ভিস দিয়েছেন প্রায় দুই দশক। ইতালিয়ান সিরি আ লিগের বারো বার সেরা গোলকিপার হওয়া এই গোলকিপার ছিলেন ইতালির ২০০৬ বিশ্বকাপ জয়ী দলের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
শান্ত মস্তিষ্ক, আর অসাধারণ রিফ্লেক্সের সম্বনয়ে বহুবার ভেঙ্গেছেন প্রতিপক্ষের গোলের আশা। নিঃসন্দহে বিশ্বসেরা গোলরক্ষকদের মধ্যে তিনি একজন। তবে অনেকের মনে হতে পারে ১৯৮২ এর বিশ্বকাপে ৪০ বছরে ইতালিকে নেতৃত্ব দেওয়া দিনো জোফকে মনে হতে পারে ইতালির সর্বকালের সেরা গোলরক্ষক। কিন্তু প্রতিভা এবং স্থায়িত্বের ভিত্তিতে জিজি বুফনে ভরসা।
- রক্ষণভাগ: জিয়ানলুকা জামব্রোতা, ফ্যাবিও ক্যানাভেরো, জর্জিও কিয়েল্লিনি, গাইতানো শিরেয়া ও পাওলো মালদিনি
ইতালি তাঁদের রক্ষণে জন্ম দিয়েছিল বহু বিশ্বমানে ফুটবলারকে। তাই মাত্র পাঁচ জনকে তাঁদের সর্বকালের সেরা একাদশে রেখেও কেমন যেন এক ইতস্তত বোধ হচ্ছিল, ফ্রাঙ্কো বারেসি , জিউসেপ বার্গোমি কিংবা জিয়াসিন্টো ফাচেত্তির মত খেলোয়াদের এই একাদশে জায়গা করে দিতে না পারায়।
তবে ইতস্ততা কাটিয়ে রাইট ব্যাক পজিশন দিয়েই শুরু করা যাক। সেই পজিশনে থাকবেন ইতালির রক্ষণভাগের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার জিয়ানলুকা জামব্রোতা।
তাঁর অবসর গ্রহণের এক দশকেও তাঁর মত বহুমুখী প্রতিভাধর একজন ডিফেন্ডারের শূন্যস্থান পূরণ করতে পারেনি ইতালি। তিনি রক্ষণের যেকোন পজিশনে খেলতে সমানভাবে পারদর্শী। তাছাড়া দীর্ঘদিন ধরে দলের আস্থার প্রতিদান দেওয়া জামব্রোতা থাকছেন ইতালির সর্বাকালের সেরা একাদশে। ২০০৬ সালে যে বার ইতালি তাঁদের চতুর্থ বিশ্বকাপ জেতে সেবার সেদলের একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড় ছিলেন তিনি।
তিনজন সেন্ট্রাল ডিভেন্ডার নিয়ে গড়া রক্ষণের অন্যতম সেনানী ফ্যাবিও ক্যানাভেরো। ২০০৬ বিশ্বকাপে ইতালির ভরসার প্রতীক। পাওলো মালদিনির অবর্তমানে তিনি ইতালিকে নেতৃত্ব দিয়ে নিয়ে যান বিশ্বকাপ জয়ের বন্দরে। তাঁর শক্তপোক্ত রক্ষণ আর সঠিক দিক নির্দেশনায় দল বিশ্বকাপ জেতে। ক্যানাভেরো সর্বশেষ ইতালিয়ান খেলোয়াড় যে ব্যালন ডি’অর জিতেছিলেন একজন রক্ষণভাগের খেলোয়াড় হয়েও। এই কিংবদন্তি খেলোয়াড় জিতেছেন ইতালির জার্সি গায়ে জরিয়েছিলেন ১৩৬ বার।
তারপর আরেক সেন্টার ডিফেন্ডার হিসেবে থাকবেন জর্জিও কিয়েল্লিনি। ২০২০ ইউরো জয়ে ইতালিকে নেতৃত্ব দেওয়া কিয়েল্লিনি ইতালির হয়ে খেলেছেন ১১৪ ম্যাচ।
তিনি প্রতিপক্ষের আক্রমণ রুখে দিতে কিংবা নসাৎ করতে যেমন পারদর্শী। ঠিক তেমনি ভাবে প্রতিপক্ষের মনোবল চূর্ণবিচূর্ণ করে দিতেও তাঁর জুড়ি মেলা ভাড়। স্পেনের বিপক্ষে গত ইউরোর সেমিফাইনালে ট্রাইবেকারে জর্ডি আলবার সাথে তাঁর করা মনোস্তাত্বিক লড়াই নিশ্চয়ই এত সহজে ভুলে যাননি ইতালি সমর্থকরা। খেলার মান এবং মানসিক দৃঢ়তার বিচারে তিনি টিকে গেলেন সেরাদের সেরা একাদশের রক্ষণে।
গাইতানো শিরেয়া ছিলেন ১৯৭৫ থেকে ১৯৮৬ অবধি ছিলেন ইতালির রক্ষণের অন্যতম ভরসার স্তম্ভ। স্তম্ভের ন্যায় তিনি আটকে রাখতেন প্রতিপক্ষকে। তাঁর শান্তশিষ্ট স্বভাবের খেলার ধরণ আর অভাবনীয় খেলোয়াড়ি গুণের বদৌলতেই ১৯৮২ বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম এক নিয়ামক বলে গণ্য করা হয়। এগারো বছরের জাতীয় দল ক্যারিয়ারে তিনি ৭৮ ম্যাচে ইতালিকে প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
ইতালির পাঁচ জনের এই সর্বকালের সেরা রক্ষণের শেষ এবং নিঃসন্দেহে সেরাদের সেরা নাম পাওলো মালদিনি। তিনি এই দলের লেফটব্যাক হিসেবে দায়িত্ব নির্দ্বিধায় পালন করতে পারবেন তা নিয়ে বিশদ আলাপনের তেমন কোন প্রয়োজন আছে বলে মনে হয় না।
তিনি ইতালির তো বটেই গোটা ফুটবল ইতিহাসের অন্যতম সেরা একজন রক্ষণভাগের খেলোয়াড়। ক্লাব ফুটবলে এমন কোন শিরোপা নেই যে তিনি তা জেতেননি এসি মিলানের হয়ে। কিন্তু আক্ষেপ ফুটবলের এই কিংবদন্তি জেতেননি কোন আন্তর্জাতিক শিরোপা। তাঁর মত একজন খেলোয়াড়, যিনি কি না প্রমাণ করেছিলেন শুধু গায়ের জোড়ে নয় রক্ষণটা যে বুদ্ধিমত্তা দিয়েও সামলানো যায় তাঁর হাতে একটা আন্তর্জাতিক শিরোপা না ওঠা বড্ড বেমানান কিংবা নিষ্ঠুর নিয়তির এক খেলা মাত্র।
- মধ্যমাঠ: মার্কো তারদেল্লি, আন্দ্রে পিরলো ও জিয়াননি রিভেরা
মার্কো তারদেল্লি, একপ্রকার আতঙ্কের নাম। তাঁর শক্তিশালি পেশির জোড় আর নির্ভীক সব ট্যাকেল যেন প্রতিপক্ষের জন্য ছিল ভয়ের কারণ। তাঁকে কিছুটা এড়িয়ে চলার প্রচেষ্টা করতেন প্রতিপক্ষের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়রা। ১৯৮২ বিশ্বকাপ দলে তিনি যেন ছিলেন রক্ষণের রক্ষা কর্তা।
বক্স টু বক্স মিডফিল্ডারের উপযুক্ত উদাহরণ তারদেল্লি। আক্রমণে আর রক্ষণে সমান তালে মনোযোগী ছিলেন তিনি। ডিভেন্সিভ মিডফিল্ডার হিসেবে প্রতিপক্ষের কত আক্রমণ যে নস্যাৎ করেছেন মধ্যমাঠে তাঁর হিসেব করাটা সময় সাপেক্ষ। হিসেবের মারপ্যাচ থেকে বেড়িয়ে ইতালির সেরাদের সেরা একাদশের ডিফেন্সিভ মিডে মার্কো তারদেল্লিকে বসিয়ে বাকিদের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়া যাক।
ইতালির সর্বকালের সেরা একাদশের মধ্যমাঠে খেলা গোছানোর মূল কারিগরের দায়িত্বে থাকছেন আন্দ্রে পিরলো। ২০০৬ বিশ্বকাপ জয়ে তাঁর অবদান অনস্বীকার্য। তিনি ইতালির ফুটবলীয় ইতিহাসের একজন উজ্জ্বল নক্ষত্র। তাঁর করা প্রথম গোলেই ইতালির ২০০৬ বিশ্বকাপের সূচনা।
দলের প্রয়োজনে সর্বদা নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন পিরলো। ইতালির হয়ে ১১৬ ম্যাচ প্রতিনিধিত্ব করে দলের হয়ে আদায় করেছেন ১৩টি গুরুত্বপূর্ণ গোল। তাছাড়া তাঁর সৃজনশীল খেলার ধরণে তিনি ম্যাচের গতি পরিবর্তন করেছন বহুবার। তিনি না হয় থাকুক তাঁর চিরপরিচিত সেন্ট্রাল মিডফিল্ড পজিশনে।
আন্দ্রে পিরলোর সাথে জুটি বেঁধে নানন্দিক সব আক্রমণ রচনায় জিয়াননি রিভেরার বিকল্প ইতালির ইতিহাসে প্রতিদ্বন্দ্বীর সংখ্যা অত্যন্ত নগণ্য।
তিনি ছিলেন বুদ্ধিদীপ্ত, সৃষ্টিশীল, আক্রমণাত্মক একজন মধ্যমাঠের খেলোয়াড় যার ফুটবলীয় শৈলী যেন মনে হয় ঈশ্বর প্রদত্ত। আফসোস তিনি কখনো বিশ্বকাপটি ছুঁয়ে দেখেননি। ব্রাজিলের কাছে ১৯৭০ এর ফাইনালে হেরে অধরা থেকে যায় তাঁর বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন। ইতালির হয়ে ৬০ ম্যাচে ১৪ গোল করা রিভেরা আর পিরলো ইতালির সর্বকালের সেরা একাদশের বিধ্বংসী মধ্যমাঠ জুটি।
- আক্রমণভাগ: জিউসেপ মেয়েজা ও পাওলো রসি
৫-৩-২ ফরমেশনের আক্রমণভাগে থাকছেন দুইজন স্ট্রাইকার। সার্বিক দিক বিবেচনায় আর খেলার ধরণে জিউসেপ মেয়াজা ও পাওলো রসি হতে পারেন যোগ্য আক্রমণ যুগল।
জিউসেপ মেয়েজা ছিলেন একজন প্রতিভাবান খেলোয়াড়। ফুলব্যাক হিসেবে যুব দলে খেলা মেয়েজা রীতিমত স্ট্রাইকার বনে যান পরবর্তিতে।
তিনি ছিলেন স্বয়ংসম্পূর্ণ একজন খেলোয়াড় যিনি ফুটবল বিভিন্ন পজিশনে খেলেছেন নিজের পেশাদার জীবনে। তবে তিনি সবচেয়ে সফল ছিলেন স্ট্রাইকার হিসেবেই। এই সেরাদের সেরা একাদশে তিনিই একমাত্র খেলোয়াড় যিনি জিতেছেন দুইটি বিশ্বকাপ। ১৯৩৪ ও ১৯৩৮ বিশ্বকাপ জয়ী এই খেলোয়াড় ছিলেন ১৯৩৮ বিশ্বকাপ জয়ী দলের অধিনায়কও। তাঁর দীর্ঘ প্রায় এক দশকের ইতালি জাতীয় দলের ক্যারিয়ারে খেলেছেন ৫৩ ম্যাচ গোল করেছেন ৩৩টি।
অন্যদিকে, মেয়াজাকে সাহায্য করতে আক্রমণে চাই আরেকজন বিধ্বংসী খেলোয়াড়। সেই বিবেচনায় ১৯৮২ বিশ্বকাপ জয়ের অন্যতম কারিগর পাওলো রসি হতে পারেন মেয়াজার সহযোদ্ধা। ১৯৮২ বিশ্বকাপে তাঁর কৃতিত্বে ইতালি ব্রাজিল, পোল্যান্ডকে হারিয়ে ওঠে ফাইনালে।
কোয়াটার ফাইনালে ব্রাজিলের বিপক্ষে করেছিলেন হ্যাট্রিক। পরবর্তীতে ফাইনালে পশ্চিম জার্মানিকে হারিয়ে শিরোপা জয়ের ম্যাচে করেছিলেন প্রথম গোল। তিনি ছিল অত্যন্ত দ্রুতগতি সম্পন্ন একজন খেলোয়াড়। এছাড়াও তাঁর শট করার দক্ষতা, আর দ্রুত প্রতিক্রিয়া দেখাবার ক্ষমতা তাঁকে অনায়সে জায়গা করে দিচ্ছে ইতালির এই সর্বকালের সেরা একাদশে।
ইতালি চার বারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। সুদূর ইউরোপের এই দেশটির ফুটবলের ভক্ত এই উপমহাদেশে কম নয়। তাঁদের মতে, এই সেরা একাদশে জায়গা করে নিতে পারতেন অন্য কেউ। একটা পুরো দল সাজাতে পারলে হয়ত অনেক কিংবদন্তি খেলোয়াড়দের নির্দ্বিধায় জায়গা হতে পারত। তবে হায় একাদশে তো স্থান সংকুলান হয় না!