মোড়ল চান না নতুন আইসিসি চেয়ারম্যান

বেশিদিন হয়নি, ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছেন নিউজিল্যান্ড ক্রিকেট বোর্ডের সাবেক ডিরেক্টর গ্রেগ বার্কলে। চেয়ারমান হিসেবে তিনি কেমন হবেন, কী করতে পারবেন; এটা সময় বলবে। তবে আপাতত তার কথাবার্তায় মনে হচ্ছে, কিছু বৈপ্লবিক কাজ করতে যাচ্ছেন বার্কলে। অন্তত আইসিসির তিন মোড়লভিত্তিক যেসব কর্মকাণ্ড ছিলো, তা তিনি পছন্দ করেন না বলে জানিয়ে দিয়েছেন।

দুই দফায় ভোটগ্রহণের পর অন্তর্বর্তী চেয়ারম্যান ইমরান খাজার স্থলাভিষিক্ত হয়েছেন বার্কলে। নির্বাচিত হয়ে প্রথমেই নজর দিয়েছেন ক্রিকেট ক্যালেন্ডারের দিকে। বললেন, এই অসামাঞ্জস্যপূর্ণ ক্যালেন্ডার পুনর্বিবেচনা করা দরকার। বছরের প্রথমদিকের সভায় গভর্নিং বডির প্রধান নির্বাহী মনু সাওনির আনা বাড়তি বৈশ্বিক টুর্নামেন্টের প্রস্তাবকেও প্রত্যাখ্যান করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

ক্রিকেট বিষয়ক গণমাধ্যম ইএসপিএন ক্রিকইনফোকে দেয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলছিলেন, পুরুষ ও মহিলা চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফির সংস্করণের কোন চিন্তা তাঁর নেই। বরং তাঁর কথায় ইঙ্গিত, আইসিসির বড় ইভেন্টগুলির পুনর্বিবেচনার। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশগুলিকে ক্রিকেটে সক্রিয় করার মত পরিকল্পনা করা উচিত বলে তিনি মনে করেন।

বার্কলে আইসিসির বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলোতে আরও বেশি মনোনিবেশ করার জন্য আন্তর্জাতিক রাগবি লীগের চেয়ারম্যান পদ থেকে পদত্যাগ করবেন বলে জানালেন। বিশেষত মহামারীর এই সময়ে আইসিসির অনেক কাজ রয়েছে বিভিন্ন পর্যায়ে।

বৈশ্বিক ক্যালেন্ডারের বিষয়ে বার্কলে বলছিলেন, ‘আমরা আসলে নিজেরা আইসিসি ইভেন্টের ক্যালেন্ডারটি তৈরি করিনা। কয়টা আইসিসি ইভেন্ট হবে, এ নিয়ে অনেক মত আছে। কেউ ছয়টা চান, কেউ সাতটা বা কেউ অন্যরকম। তবে সত্যি বলতে আমার নিজস্ব কোনো মত নেই। যে কটাই ইভেন্ট হোক, আমার লক্ষ্য হচ্ছে সেখান থেকে সর্বোচ্চ ফলাফল নিয়ে আসার; বিনোদন, উত্তেজনা বা ক্রিকেটের উন্নয়ন, সবদিকেই। কিন্তু আমি জানি, আমরা এখন বাণিজ্যিক মুনাফার দিকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। এবং এটাও সত্য, আটটি ইভেন্ট আইসিসিকে আরও বেশি অর্থ আয়ে সাহায্য করবে।’

বার্কলে বরং মনে করেন, এতো ইভেন্ট নিয়ে ভাবার চেয়ে জরুরী খেলোয়াড় বের করে আনা নিয়ে ভাবা, ‘আমার মনে হয়না আমরা ক্রিকেট এবং ক্রিকেটের ভবিষ্যৎ নিয়ে আমরা (আইসিসি) ভাবি; বিশেষত প্লেয়ারদের দৃষ্টিকোণ থেকে। বিশ্বের প্রতিটি কোণায় সবাই একইরকম অনুকূল পরিবেশে থাকেনা। তাই সবার খেলার ধরণ এক হবে, এটা সঠিক চিন্তা নয়। তাই আমরা কাজ করছি যেন আমরা বৈশ্বিক ইভেন্টগুলি থেকে আমাদের সেরা প্লেয়ারটাই বের করতে পারি, যারা দেশের হয়ে নিজের সেরাটা দিয়ে উঠে আসতে পারে। সুতরাং অনেকক্ষেত্রেই আমাদের ভারসাম্য আনার ব্যাপার আছে, এবং সবকিছু বিবেচনায় রেখে আমাদের এই বার্ষিক ক্যালেন্ডার তৈরিতে আরও সজাগ হতে হবে। এখন আমরা শুধু বৈশ্বিক ইভেন্ট আয়োজন করি, আর বলতে থাকি, এটা বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট, এখানে খেলতে গেলে সবাইকে একইরকম ফিট হতে হবে। এরকম হলে সমাধান হবেনা। আমাদের আরও ভাল মডেল দাঁড় করাতে হবে। তাহলেই আমরা ভাল ফলাফল পেতে পারি।’

নিউজিল্যান্ড থেকে আসা বার্কলে বলছিলেন বেশ কবছর নিস্ক্রিয়তা থেকে উঠে আসতে চেষ্টা করা আইসিসিকে আরও সহানুভূতিশীল ও কৌশলী নেতৃত্বের পক্ষে চেষ্টা করবেন, ‘আমাদের প্রথম কাজ আইসিসির স্ট্রাটেজি পরিষ্কার ও স্বচ্ছ রাখা। তাহলে আমরা বুঝতে পারব আমরা কী অর্জন করতে চাই, কীভাবে তা বিশ্ব ক্রিকেটকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, এবং সদস্যদের স্বার্থকেও দেখবে। আমরা কৌশলগত পরিকল্পনা অনুশীলনের মধ্যে আছি, কিন্তু আমাদের ২-৩ বছর কেটে গেছে তাই আমরা কী করছি তা স্পষ্ট হওয়া উচিত। যেন আমরা সেই কৌশলের ভিত্তিতে কিছু সিদ্ধান্ত নিতে পারি।’

বার্কলে মনে করেন, এখন ক্রিকেটকে আরও ছড়ি দেওয়া নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে, ‘সহজ বিষয়। আমাদের যদি আরও অর্থ থাকে, আমরা বিনিয়োগ করতে চাচ্ছি খেলাটির প্রসারণ ঘটাতে। আমরা যদি আমেরিকায় বিনিয়োগ করি, ব্যাপারটা কেমন হবে? সুতরাং আমাদের এমনসব জায়গায় বৈশ্বিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে হবে, যেটা ক্রিকেটের প্রসারের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হবে। হয়তো সেখান থেকে সদস্যরা যেমন অর্থ আশা করবেন, সেরকম অর্থ আসবে না। কিন্তু ক্রিকেটের প্রসারণের স্বার্থে আমাদের কি কৌশলগত পন্থা নিতে চাচ্ছি সেই সিদ্ধান্ত নেয়া জরুরী।’

বার্কলে মনে করেন, খেলাটাকে সত্যিই ছড়িয়ে দিতে চাইলে যুক্তরাষ্ট্রকে লক্ষ্য করতে হবে, ‘আমরা যদি খেলাটি বাড়াতে চাই, হোক তা এশিয়া বা আমেরিকা, তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই শুরু করার ভাল জায়গা। ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং আমেরিকার মধ্যে কেউ আয়োজক হতে পারে। তবে আমাদের ভাল ফলাফল আনার দিকেই নজর দিতে হবে। যেখানেই হোক কিভাবে ভাল ফলাফল আনা যায় তা সিদ্ধান্তের ব্যাপার। দ্বিতীয় কথা আমাদের লভ্যাংশের ব্যাপারে আয়োজকের পাশে থাকতেই হবে, যেরকমই লাভ আসুক মেনে নিতে হবে। যদি উপার্জন একভাবে না আসে, অন্যভাবে কিভাবে আনা যায় ভাবতে হবে। আমাদের মানসিকতা পরিষ্কার রাখতেই হবে। এমন হতে দেওয়া যাবে না, বাণিজ্যের জন্য আমাদের পরিকল্পনা মার খেলো। আমাদের সেটাই ভাবতে হবে, ক্রিকেটের জন্য কোনটা কার্যকরী।’

এন শ্রীনিবাসন আইসিসির চেয়ারম্যান থাকাকালীন ‘বিগ থ্রি’ বলে একটা ব্যাপার করেছিলেন। যাতে আইসিসির সব গুরুত্বপূর্ন ব্যাপার চলে গিয়েছিলো ভারত, অস্ট্রেলিয়া ও ইংল্যান্ডের হাতে। বার্কলে পরিষ্কার বললেন, তিনি এই ধরণের ব্যাপারের একেবারেই পক্ষে নন।

শশাঙ্ক মনোহর ক্ষমতায় এসে বিগ থ্রি ব্যাপারটা তুলে দেন। তবে এখনও সব ক্ষেত্র থেকে এই তিন দেশের প্রভাব একেবারে ভারসাম্যপূর্ন করা যায়নি। বার্কলে বলেছেন, শশাঙ্ক মনোহরের সময় বিগ থ্রির প্রভাব যেভাবে কমিয়ে আনা হয়েছে, তিনি সেটাই করবেন, ‘মিডিয়া তিন মোড়লকে খুব প্রচার করেছে, তবে আমি মোটেই এইসবের পক্ষপাতী না। আমার কাছে কোন তিন মোড়ল নেই, তারা কেবল আইসিসির সদস্য। তবে তারা সত্যই গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। তারা ক্রিকেটের জন্য কাজ করে, ফলাফলও এনেছে, আয়োজক হিসেবে বেশ লাভ দেখিয়েছে। এছাড়া মাঠের প্রতিপক্ষ হিসেবেও তাঁরা দারুণ। তাই ক্রিকেটে তাঁদের প্রভাব বেশ গভীর। তবে তারা আইসিসির সদস্য হিসেবে ঠিক ততটাই গুরুত্বপূর্ণ অন্যরা যেরকম। বিগ থ্রি প্রস্তাবের সময় আমি আইসিসিতে ছিলাম না। কিন্তু সেই প্রস্তাবের দরুন এফটিপি, বেশ কিছু সদস্য কিছু সুবিধা ভোগ করেছিলেন যা ভাল ব্যাপার ছিল। যদিও এটি একটি বৈষম্যমূলক বিভাজন ছিল, নিউজিল্যান্ড এবং অন্যরাও প্রভাব কিন্তু রেখেছিল যা এখনো একইরকম। তবে শশাঙ্ক মনোহর এর প্রভাবকে কমিয়ে দিয়েছিলেন। এখন এই ‘বিগ থ্রি’ বলে কিছু নেই ৩-৪ বছর ধরে। আমি জানি, ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার এই ব্যাপারে খুব উৎসাহ ছিল।’

তবে ভারতকে একটু আলাদা চোখে দেখতে হবে বলেও মনে করিয়ে দিলেন আইসিসির নতুন এই চেয়ারম্যান, ‘তারা এখন অন্যদের মতই সমপরিমাণ অর্থ আইসিসি ইভেন্ট থেকে পায়। ভারতের ব্যাপারটা কিছুটা আলাদা, তাঁদের ক্রিকেটের শক্তি বিশাল। ১.৩ বিলিয়ন মানুষের আগ্রহটাকে আমাদের ব্যবহার করা উচিত। আমাদের আসলে প্রতিটা ব্যাপার আলাদা করে সমাধান করা উচিত। প্রতিটা বিষয়ের ইতিবাচকতা নেতিবাচকতা দুটিই থাকে।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link