তারা যখন ম্যাচ সেরা!

ম্যাচ শেষ হলে অবধারিত প্রশ্ন হলো – ম্যাচ সেরা হলো কে?

অন্তত ক্রিকেটে এটা মারাত্মক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। আর এই ম্যাচ সেরার পুরষ্কার নিয়ে  ‍ক্রিকেট দুনিয়ায় আছে নানা ধরণের মজার কাণ্ড। অনেকে এসব কাণ্ড আবার যত্ন করে সংগ্রহও করে রাখেন। কেউ একজন টানা তিন ম্যাচে ম্যান অব দ্য ম্যাচ হয়েছেন, কেউ সিরিজের সব ম্যাচে হয়েছেন ম্যাচসেরা। আবার এক দলের সব খেলোয়াড় ‘ম্যান’ অব দ্য ম্যাচ পুরষ্কার জিতেছেন। এসব ঘটনা নিশ্চয়ই আপনাদের শোনা ও জানা হয়ে গেছে।

এবার জানানো যাক একেবারে ভিন্ন ‘এক’ ম্যাচ সেরার ঘটনা।

২০০০ সালের ১২ ডিসেম্বর ঘটেছিলো এক অভিনব ঘটনা। নিউজিল্যান্ড ও দক্ষিণ আফ্রিকার নিউ ওয়ার্ডার্স টেস্টে ঘটলো এক অভিনব ঘটনা। ম্যাচ সেরার পুরষ্কার পেলেন ক্রিস স্কট ও তার দল। কে এই ক্রিস স্কট? নিউ ওয়ান্ডার্সের প্রধাণ গ্রাউন্ডসম্যান। ঠিক ধরেছেন, এই টেস্টে ম্যাচ সেরার পুরষ্কারটা পেয়েছিলেন গ্রাউন্ডসম্যানরা।

তাহলে শুরু থেকে গল্পটা শোনা যাক।

নিউ ওয়ান্ডারার্সে সিরিজের তৃতীয় টেস্ট খেলতে নামার আগেই দক্ষিণ আফ্রিকা সিরিজটা জিতে গিয়েছিল। ব্লুমফন্টেইনের কথাই ধরা যাক। জ্যাক ক্যালিসের ১৬০ আর মাখায়া এনটিনির ৪৮ রানে ৬ উইকেট এর পর সাউথ আফ্রিকার শেষ ইনিংসে টার্গেট দাঁড়িয়েছিল মাত্র ১০১।

সেন্ট জর্জ পার্কে অবশ্য নিউজিল্যান্ড কিছুটা প্রতিরোধ গড়তে পেরেছিল। ম্যাথ্যু সিনক্লেয়ারের ১৫০ রানে তারা পৌছে গিয়েছিল ২৯৮ রানে। তবে তাতেও নিউজিল্যান্ডের ‘আশার গুঁড়েবালি’ হন নিল ম্যাকেঞ্জি। ম্যাকেঞ্জির ১২০ রানের সৌজন্যে সাউথ আফ্রিকা নেয় ৬৩ রানের লিড । সেই লিড অবশ্য আরেকটু বাড়তেও পারত, তবে ক্রিস মার্টিনের বোলিং তোপে তা বেশিদূর গড়ায়নি।

যা হোক, সেন্ট জর্জ পার্কে শেষ ইনিংসে দক্ষিণ আফ্রিকার টার্গেট দাঁড়ায় ৮৬ আর সাউথ আফ্রিকা তা অনায়াসেই পার করে ফেলে।

নিউ ওয়ান্ডারার্সে টেস্ট খেলতে নামার আগে নিউজিল্যান্ডের সামনে লক্ষ্য তখন হোয়াইটওয়াশ এড়ানো। হোয়াইটওয়াশ এড়ানোর লক্ষ্যে একাদশে কিছুটা বদল আনে নিউজিল্যান্ড। ক্রেইগ স্পিয়ারম্যান আর কেরি ওয়ামসলেকে একাদশ থেকে বাদ দিয়ে নেওয়া হয় টুফেকে, অভিষিক্ত হন হ্যামিশ মার্শাল। একাদশে অবশ্য সাউথ আফ্রিকাও বদল আনে। অ্যালান ডোনাল্ড ইনজুরিতে পড়ায় ২১ বছর বয়সী ফুনেকো নিগামকে দেওয়া হয় অভিষিক্ত টুপি।

 

নিউ ওয়ান্ডারার্সে প্রথম দিন থেকেই ছিল বৃষ্টির হানা । তাও ড্রেইনেজ সিস্টেম আর মাঠকর্মীদের দক্ষতাতে খেলা মাঠে নামানো সম্ভব হয়। তবে খেলা মাঠে গড়ালেই আবার দেখা মেলে প্রোটিয়া পেসারদের তান্ডব। শন পোলক নতুন বল তুলে দেন অভিষিক্ত নিগামের হাতে। নিগাম অবশ্য পোলককে আশাহত করেননি, প্রথম ওভারেই অ্যাডাম প্রাওরেকে এজড এর ফাঁদে ফেলেন। তবে তাতে অবশ্য লাভ হয়নি; ড্যালিন কুলিন্যান স্লিপে ক্যাচ নিতে ব্যার্থ হন!

এভাবে স্লিপে মোট তিনবার ক্যাচ ফেলে প্রোটিয়া ফিল্ডাররা। উইকেট যখন একের পর এক হাত থেকে ফসকে যাচ্ছে, তখন ত্রাতা হয়ে আসলেন মাখায়া এনটিনি। ২১ তম ওভারে প্রাওরেকে সাজঘরে ফিরিয়ে কিউই ইনিংসের ধ্বসের সূচনা করেন তিনি।

পাঁচ বলের ব্যাবধানে রিচার্ডসন আর সিনক্লেয়ার আউট হয়ে গেলে নিউজিল্যান্ডের ইনিংস বিপর্যয় দেখে ফেলে, সেই বিপর্যয় সামাল দেওয়ার আগেই ১১৭ রানেই পড়ে যায় ৬ উইকেট।

নিউজিল্যান্ডের মার্টিন ‘ডাক’ মেরে সাজঘরে ফিরলেও কাজের কাজটা তিনি করেন বোলিংয়ে, মার্ক বাউচারকে সাজঘরে ফিরিয়ে। দক্ষিণ আফ্রিকার ব্যাটিংয়েও তাই বিপর্যয় দেখতে সময় লাগেনি, ১৮ রানের মাথাতেই প্রথম উইকেটের পতন ঘটে যায় প্রোটিয়াদের। তবে ফলো-অন এড়াতে তখনও দরকার ১৩৩ রান।

সাউথ আফ্রিকার ব্যাটিং লাইনআপের কাছে এটা অবশ্য বিশেষ সমস্যা ছিল না। তবে সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয় প্রকৃতি। মোটামুটি ফলাফলের সব সম্ভাবনাই শেষ হয়ে যায় যখন তৃতীয় ও চতুর্থ দিন বৃষ্টির কবলে ভেসে যায় । হয়তো পঞ্চম দিনেও মাঠে খেলা গড়াত না, যদি না ক্রিস স্কট আর তাঁর দল অসাধ্যকে সাধন করত!

পঞ্চম দিনে যখন ডিপেনার আর নাইটওয়াচম্যান জুটি বোজে ৬৯ রান যোগ করে, শন পোলক তখন ডিকলেয়ার করে দেবেন ভাবছিলেন। দিনের এখনও ৭৫ ওভার বাকি ছিল। পোলক ভাবছিলেন, কিছু একটা তো হতেও পারে।

গ্রাউন্ডসম্যানদের প্রধান ক্রিস স্কট

কিন্তু পোলকের মাথায় কিছুটা অন্যরকমই ঘুরছিল। ক্যালিসকে সাথে নিয়ে ডিপেনার ব্যাট করতে থাকেন, আর ১৯০ বলে সেঞ্চুরিও করে ফেলেন।

এক সময়ে ডিপেনারও সাজঘরে ফিরলে ক্যালিস আর কুলিন্যান ব্যাট করতে থাকেন। সে ব্যাটিং এমন ধীরগতির হয় যে টি ব্রেকের পর ১৪ ওভারে দক্ষিণ আফ্রিকা করে মাত্র ৯ রান । ২৬১ রানে ৩ উইকেটে ইনিংসটি শেষ হয়ে যায়।

এই যে শেষ ইনিংসেও খেলা গড়াল, এটা কোনভাবেই আসলে সম্ভব ছিল না। শুধুমাত্র ক্রিস স্কটের দক্ষতাতেই এটা সম্ভব হয়। ম্যাচ শেষে তাই ক্রিস স্কট আর তাঁর দলের জন্যে সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছিল। সেই ম্যাচের ‘সেরা খেলোয়াড়’-এর পুরস্কার যে ক্রিস স্কট আর তাঁর দলকেই দেওয়া হয়।

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link