গত আসরে নতুন দল হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল গুজরাট টাইটান্স। আইপিএলের মঞ্চে পা রেখে সেই থেকেই দলটা সাফল্যের সিঁড়ি বেঁয়ে বেঁয়ে চলছে। প্রথম বারে চ্যাম্পিয়ন। আর এবার সেই ধারাবাহিকতায় আবারো ফাইনালে!
গুজরাট টাইটান্সের সাফল্যের রাজমুকুটে এখন আরেকটি পালক যুক্ত হওয়ার পালা। আগামী ২৮ মে’র ফাইনালে চেন্নাই সুপার কিংসকে হারাতে পারলেই ‘ব্যাক টু ব্যাক’ চ্যাম্পিয়ন হওয়ার স্বাদ নিবে হার্দিক পান্ডিয়ার দল।
চলতি আইপিএলে প্লে-অফ নিশ্চিত করতে রীতমত ঘাম ছুটে গিয়েছে দলগুলোর। এবারের ফাইনালিস্ট চেন্নাই সুপার কিংস থেকে শুরু করে লখনৌ সুপার জায়ান্ট, মুম্বাই ইন্ডিয়ানস— এই তিন দলেরই শেষ চার নিশ্চিত হয় রাউন্ড রবিন লিগে নিজেদের শেষ ম্যাচে এসে।
তবে, শেষ চারের এই লড়াইয়ে যেন এক প্রকার অপ্রতিরোধ্য হয়েই সবার আগে প্লে-অফ নিশ্চিত করেছিল গুজরাট টাইটান্স। আগের আসরের মতোই এবারও সবার আগে প্লে-অফ নিশ্চিত করে দলটা।
গুজরাট টাইটান্সের এমন ধারাবাহিক সাফল্যের রহস্য কি? নামে ভারে অন্য দলগুলোর চেয়ে গুজরাট খুব যে তারকা ক্রিকেটার ভিড়িয়েছে, এমন নয়। তাদের সাফল্যের রহস্য মূলত, ব্যালান্সড স্কোয়াড আর সেই স্কোয়াডের সবার একটা টিম হয়ে খেলার প্রবণতা। একটু বিস্তরভাবে বিষয়টা বিশ্লেষণ করা যাক।
এবারের আইপিএল ফাইনালের আগে পরিসংখ্যান বলছে, ২৮ টা উইকেট নিয়ে এই মুহূর্তে পার্পল ক্যাপের দৌড়ে এগিয়ে আছেন গুজরাট টাইটান্সের মোহাম্মদ শামি। এরপরের নামটা? সেটাও গুজরাটের।
২৭ উইকেট নিয়ে শামির পরে রয়েছেন তাঁরই সতীর্থ রশিদ খান। অবাক করা ব্যাপার হলো, সর্বোচ্চ উইকেট শিকারীদের তালিকায় পরের জায়গাটাও গুজরাট টাইটান্সের একজন বোলারের। ২৪ উইকেট নিয়ে এই মুহূর্তে তিনে রয়েছেন মোহিত শর্মা।
ভেবে দেখুন, রানপ্রসবা আইপিএলে, একটা দলের বোলিং লাইনআপ কতটা সক্ষমতার প্রমাণ কিংবা আধিপত্য দেখাতে পারলে, পুরো একটা আসরের সেরা তিন বোলারই একটি দলের হয়! গুজরাট টাইটান্সের এমন দুর্দান্ত সাফল্য যাত্রায় তাই এই বোলিং ত্রয়ীই হয়ে উঠেছে অন্যতম অস্ত্র।
এ তো গেল বোলিং লাইন আপের আধিপত্যের নমুনা। ৮৫১ রান করে এরই মধ্যে অরেঞ্জ ক্যাপটা নিজের করে নিয়েছেন গুজরাটের ওপেনার শুভমান গিল। আর এই ব্যাটারের ব্যাটিংয়েই যে গুজরাটের অনেক ম্যাচের জয়ের ভিত্তি গড়ে উঠেছিল, তা নিয়ে নতুন করে বলার কিছু নেই। শেষ চার ম্যাচে তিনটা সেঞ্চুরি করেছেন। তিনটাতেই জয় পেয়েছে গুজরাট টাইটান্স।
শুভমান গিলের অপর ওপেনিং সঙ্গী ঋদ্ধিমান সাহা এবারের আইপিএল ২১.১৩ গড়ে ৩১৭ রান করেছেন। এমন পরিসংখ্যান খালি চোখে গড়পড়তাই বটে। তবে গুজরাটের ইনিংসের শুরুর হিসেব করলে, এ ব্যাটারের অবদানও ফেলে দেওয়ার মতো নয়।
একটা পঞ্চাশোর্ধ্ব ইনিংসসহ কয়েকটা কার্যকরী ইনিংস খেলেছেন। এর পাশাপাশি বেশ কিছু ম্যাচেই গুজরাটের ইনিংসে উড়ন্ত শুরু এনে দিয়েছেন এ ব্যাটার।
গুজরাটের মিডল অর্ডারই বা কম কিসে! টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে বিজয় শঙ্করের তেমন একটা নামডাক নেই বললেই চলে। তবে এবারের আইপিএল দিয়ে এ ব্যাটার নিজেকে প্রমাণ করেছেন দারুণভাবে। পুরো আসরে তিন ফিফটিসহ ৩০১ রান করেছেন। আর এ সময়ে তাঁর ব্যাটিং স্ট্রাইকরেট ছিল ১৬০.১০!
ডেভিড মিলার ব্যাটিংয়ে সুযোগ পেয়েছেন কমই। তবে সেই স্বল্প সুযোগেও প্রোটিয়া এ ব্যাটার নিজের একটা ছাপ রেখেছেন। ১৪৫.৫০ স্ট্রাইকরেটে করেছেন ২৫৯ রান। এ ছাড়া ব্যাট হাতে অধিনায়ক হার্দিক পান্ডিয়া ৩২৫, সাঁই সুদর্শন ২৬৫ রান করেছেন।
মোদ্দাকথা, গুজরাটের হয়ে ব্যাট হাতে যিনিই সুযোগ পেয়েছেন, তিনিই নিজেকে একদম উজাড় করে দিয়েছেন। আর তাতেই গুজরাট টাইটান্সের কাছে সাফল্য এসে ধরা দিয়েছে।
বল হাতে ২৭ উইকেট নেওয়া রশিদ খান এবার ব্যাট হাতেও দেখিয়েছেন চমক। একটা দলের ফিনিশিংয়ের জন্য যেমন উপযুক্ত পিঞ্চ হিটার প্রয়োজন, গুজরাটের হয়ে সেই চাহিদাই মিটিয়েছেন আফগান এ অলরাউন্ডার। পুরো আসরে ৪৩.৩৩ গড়ে ১৩০ রান করেছেন। আর তাতে তাঁর ব্যাটিং স্ট্রাইকরেট ছিল ২২৪.১৩!
রশিদ খানের পাশাপাশি আরেক আফগান স্পিন নূর আহমেদও নিজেকে প্রমাণ করেছেন দারুণভাবে। ৮ এর নিচে ইকোনমিতে বাঁহাতি এ স্পিনার নিয়েছেন ১৪ টা উইকেট। এ ছাড়া আলজারি জোসেপ, জশুয়া লিটলরা যতটা সুযোগ পেয়েছেন, তাতে তাদের প্রচেষ্টা ঠিকই প্রতীয়মান হয়েছিল। দুজনই দলের বেশ কিছু সময়ে ব্রেক থ্রু এনে দিয়েছেন।
টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ব্যাটার, সর্বোচ্চ উইকেট শিকারী বোলার— দুই ‘সেরা’ই গুজরাট টাইটান্সের। এতেই স্পষ্ট হয়, টুর্নামেন্ট জুড়ে কতটা প্রভাব বিস্তার করেছে দলটা। টপ অর্ডার থেকে শুরু করে মিডল অর্ডার, এমনকি পিঞ্চ হিটিংয়েই কোনো খামতি রাখেনি তাঁরা।
একই ভাবে পেস বোলিং থেকে শুরু করে স্পিন বোলিং ইউনিট— দুটিতেই নিজেদের আধিপত্য সিংহভাগ প্রমাণ করেছে গুজরাট টাইটান্স।আর এই ব্যালান্সড স্কোয়াডই তাদের সাফল্যের রসদ জুগিয়েছে। সবার মধ্যে পারফর্ম ক্ষুধাটাই তাদের ধারাবাহিক সাফল্যের দিকে টেনে নিয়ে গিয়েছে।
আরেকটি শিরোপা থেকে এখন গুজরাট টাইটান্স আর একটি মাত্র জয় দূরে। ২৮ মে’র ফাইনালটা হবে নিজেদের মাটিতেই। ঘরের মাঠের দর্শকদের সামনে তাই নিশ্চিতভাবেই শিরোপা উঁচিয়ে ধরার দিকে চোখ থাকবে তাদের।
আহমেদাবাদের ফাইনালে ফল যাই হোক, মাত্র দুই আসরেই দু’বার ফাইনালে ওঠা গুজরাট টাইটান্স যে আইপিএলের সামনের দিনগুলোতে রাজ করতে চলেছে, সে ব্যাপারে বোধহয় এখন আর সন্দেহ থাকার কোনো কারণ নেই।