সময়টা ২০১৭ সালের অক্টোবর। বাংলাদেশ দল তখন দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে। হঠাৎই বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে চাউর হল, দলের প্রধান কোচ চান্দিকা হাতুরুসিংহে পদত্যাগ করতে যাচ্ছেন। অনেকে অবশ্য সেটাকে গুঞ্জন হিসেবেই ধরে নিয়েছিলেন। কিন্তু একটা সময় পরে এসে সেই গুঞ্জনই সত্যি হয়। সফরের মাঝপথে বিসিবিকে পদত্যাগ পত্র পাঠিয়ে দেন লঙ্কান এ কোচ। মূলত শ্রীলঙ্কা দলের দায়িত্ব নিতেই সে সময় বিসিবিকে উপেক্ষা করেছিলেন হাতুরুসিংহে।
সে সময়ের ৬ বছর পেরিয়ে গিয়েছে। হাতুরুসিংহের সেই চরম অপেশাদারিত্ব অনেকটা আড়ালেই চলে গিয়েছে। এ সময়ের মধ্যে বাংলাদেশ ক্রিকেটে আরো দুই বার কোচিংয়ের পালাবদল ঘটেছে। তবে কিছুটা বিস্ময় জাগানোর মতোই খবর হল, আবারো বাংলাদেশের কোচ হয়ে ফিরছেন হাথুরুসিংহে। দুই বছরের জন্য আবারো সাকিব, তামিমদের সামলাবেন তিনি।
নতুন কোচ মানেই নতুন স্ট্র্যাটেজি। অনেক পরিকল্পনার রদবদল। যদিও এই বাংলাদেশকে বেশ লম্বা একটা সময় ধরে কোচিং করিয়েছেন হাতুরুসিংহে। তাই হাথুরুর রণকৌশলে অন্যভস্ত থাকার কথা নয় বাংলাদেশি ক্রিকেটারদের। তারপরও অতীত অভিজ্ঞতায়, অনেক ক্রিকেটারই এবার প্রধান কোচের আড়ালে চলে যেতে পারেন। কারণ হাথুরু বরাবরই এক্সপেরিমেন্ট করতে পছন্দ করেন। তরুণ ক্রিকেটারদের অগ্রাধিকার দেন প্রায় সময়েই।
নতুন মেয়াদে হাতুরুসিংহের পরিকল্পনায় বাদ পড়তে পারেন স্বয়ং মুশফিক, মাহমুদুল্লাহরাই। এমনকি ওয়ানডে ক্রিকেটে দারুণ প্রত্যাবর্তনে আবারো ক্যারিয়ার শুরু করা এনামুল হকও খুব সুনজরে নাও থাকতে পারেন। প্রথমত, হাতুরুসিংহের সাথে মুশফিকুর রহিমের সম্পর্কের অবনতির কথা আগেই প্রকাশ্যে এসেছিল।
তাছাড়া, একবার রিয়াদকেও দল থেকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন হাথুরুসিংহে। কিন্তু সে সময়ে ক্যারিয়ারের অতটাও বাজে অবস্থায় ছিলেন না রিয়াদ। কিন্তু সেই পরিস্থিতি এখন বেশ খানিকটা বদলে গেছে। রিয়াদ কিংবা মুশফিক, কেউই এখন নিয়মিত পারফর্মার নন। ক্যারিয়ারের অন্তিম লগ্নেই আছেন বলা যেতে পারে। তাই হাথুরু দায়িত্ব নেওয়ার পর তারা যে কোচের বিরাগভাজনদের তালিকায় চলে যেতে পারেন- সেটি নিশ্চিতভাবেই আঁচ করা যায়।
নতুন মেয়াদের এ দায়িত্বে হাতুরুসিংহে তরুণ ক্রিকেটারদের ভালভাবেই বাজিয়ে নেওয়ার সুযোগ পাবেন। তাঁর সময়েই মুস্তাফিজ, লিটন, মিরাজ, মোসাদ্দেকদের অভিষেক হয়েছিল। তাই হাতুরুর আমলে নিশ্চিতভাবেই তৌহিদ হৃদয়, জাকির হাসানদের সামনে অসংখ্য সুযোগ আসতে যাচ্ছে। কারণ, হাথুরুসিংহে বরাবরই ভবিষ্যৎ দল গড়ার জন্য তরুণদের নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন।
হাতুরুর হাত ধরে যেমন সম্ভাবনার গল্প উদয় হতে পারে তেমনি তাঁর সামনে অনেক চ্যালেঞ্জও আছে। প্রথম চ্যালেঞ্জটা হল, ওয়ানডে ফরম্যাট বাদে বাকি দুই ফরম্যাটে দলের উন্নতি ঘটানো। রাসেল ডোমিঙ্গোর অধীনে প্রায় ৭০ ভাগ ওয়ানডে ম্যাচ জিতেছিল। কিন্তু ব্যর্থতা ছিল বাকি দুই ফরম্যাটে। নতুন দায়িত্বে তাই এই দুই ফরম্যাটে আলাদা করে নজর দিতে হবে লঙ্কান এ কোচকে।
হাথুরুসিংহে কোচ হিসেবে মোটেই নির্ভুল কেউ নন। আর এখানেই বড় একটা জায়গা প্রভাবিত হতে পারে তাঁর অধীনে। কারণ বিগত বছর গুলো ছিল বাংলাদেশি পেসারদের উত্থানের বছর। এবাদত হোসেন, হাসান মাহমুদ, শরিফুলদের মতো পেসার উঠে এসেছে এই সময়কালে। তাছাড়া, ২০২১ সাল থেকে দুর্দান্ত ফর্মে রয়েছেন তাসকিন আহমেদ। তবে হাতুরুর স্ট্র্যাটেজিতে সব সময়ই স্পিন নির্ভরতা ছিল। অন্তত তাঁর সময়কালে সেটিই বেশি ফুটে উঠেছে। তো সেই সময়ের পরিকল্পনার পুনরাবৃত্তি এ সময়ে ঘটলে পেসারদের এ গতিময় যাত্রা খানিকটা মন্থর হয়ে যেতে পারে নিশ্চিতভাবেই।
তবে দলের পেস বোলিং কোচ আবার অ্যালান ডোনাল্ড। তাঁর সময়েই পেসারদের এ উন্নতির ছাপ দেখা গিয়েছে। এই মুহূর্তে তাঁর পাইপ লাইনে রেজাউর রহমান রাজা, নাহিদ রানা, মৃত্যুঞ্জয় চৌধুরির মত পেসার আছে। তাই হাথুরু দায়িত্বে আসলেও বড় কোনো রদবদল ঘটার সম্ভাবনা অনেকাংশেই কম।
২০১৪ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের হয়ে কাজ করা হাতুরুসিংহেকে ঘিরে এবার প্রত্যাশা অনেক। নিজের প্রথম মেয়াদে বেশ সফল ছিলেন তিনি। এবার সেটিকেও ছাপিয়ে যেতে দ্বিতীয় মেয়াদে দলের দায়িত্ব নিতে আসছেন। আর ৮ মাস বাদেই ওয়ানডে বিশ্বকাপ। দিন বদলের গান রচনার সময় পাচ্ছেন এই মঞ্চেই। এখন দেখার পালা হাথুরুসিংহে ২.০ এর যাত্রা কতটা মসৃণ হয়। অবশ্য বাংলাদেশের ইতিহাসে কোচদের সুন্দর প্রস্থানের গল্প নেই বললেই চলে। এমন একটা গল্প অন্তত হাথুরুকে দিয়ে রচিত হোক।