একটি দেশ। যাদের গল্পটা অর্থনৈতিক অস্থিরতা, কারফিউ আন্দোলন, পাওয়ার কাট সহ আরো নানান অস্থিরতায় ভরা। এত সব অস্থিরতায় জর্জরিত হয়ে দেউলিয়া হওয়া দেশটির গল্প গুলো নিরাশার, হতাশার, ভঙ্গুরতার। তবে আঁধারের মাঝেও তো আলো খোঁজার সুপ্ত ইচ্ছা থাকে। লঙ্কানদের জন্য সেই আলোটা হচ্ছে ‘ক্রিকেট’।
বাইশ গজের সাফল্য তাদের এক করে দেয়, লক্ষ লক্ষ মানুষের মুখে হাসি ফোঁটায়। সম্মিলিত হয়ে তাদের ঐ এক চিলতে হাসিই যে গোটা একটা শহরকে আলোকিত করে দেওয়ার জন্য যথেষ্ট। তাই ক্রিকেটে শ্রীলঙ্কার জয় প্রত্যেক লঙ্কানদের জন্য উৎসবের এক দারুণ উপলক্ষ। সেই উপলক্ষ সাধন করার তাগিদটা নিশ্চয় দাসুন শানাকা, রাজাপাকশে, হাসারাঙ্গাদের আছে।
শ্রীলঙ্কার এই ক্রিকেট দলটাকে এক কথায় বলা যায় সংকটকে শক্তিতে পরিণত করার অভূতপূর্ব এক উদাহরণ। দেশ সংকটে, কিন্তু কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সেই সংকট মোকাবেলায় অদম্য মানসিকতা। এই যেমন আফগানিস্তানের বিপক্ষে ম্যাচ হারার পরে অধিনায়ক দাসুন শানাকা যে ভাবার্থে বাংলাদেশকে সহজ প্রতিপক্ষ বোঝাতে চাইলেন তা অন্য ভাবার্থ হয়ে পৌঁছে গেল সর্বত্র। সেখান থেকেই বাগবিতণ্ডার শুরু। কথার লড়াই চলতে থাকলো ম্যাচ শেষ হওয়ার আগ পর্যন্ত।
কিন্তু, দুদিন বাদেই বাংলাদেশকে হারানোর পর প্রেস কনফারেন্সে এসে রাজাপাকসে বিনয়ী কণ্ঠে এমন ভাবে খোলাসা করলেন যেন, সব কিছুই ছিল পানির মতো স্বচ্ছ। আদৌতে জল ঘোলা হয়েছে কিছু ভুল বোঝাবুঝির কারনে। রাজপাকসের সে প্রেস কনফারেন্সে যেন উঠে আসলো লঙ্কানদের শান্তিপ্রিয় মানসিকতা। একই সাথে পুরো বিশ্ব দেখলো সমালোচনায় বিদ্ধ হতে থাকা এক ক্যাপ্টেনকে একজন টিমমেট কিভাবে জনতোপের মুখ থেকে ফিরিয়ে আনলো। শ্রীলঙ্কার এই দলটা তাই একতার অনন্য এক উদাহরণ।
মাঠের ক্রিকেটেও টিম হয়ে খেলার অনন্য দৃষ্টান্ত শ্রীলঙ্কার। এবারের এশিয়া কাপে খুব ভাল তেমন কেউই করেননি। কিন্তু পরিস্থিতির প্রয়োজনে ছোট ছোট কন্ট্রিবিউশন সবাই রেখেছে। আর ঐ ছোট ছোট কন্ট্রিবিউশনই ফাইনালে নিয়ে গিয়েছে টিম শ্রীলঙ্কাকে, বিজয়ী করেছে এশিয়া কাপে। এবার ফাইনালটাও নিজেদের করে নেওয়ার মিশনে চোখ ছিল তাঁদের। একই সাথে এই এগারো জনের দিকে তাকিয়ে ছিল শ্রীলঙ্কার আরো লক্ষ কোটি চোখ। সেই তাকিয়ে থাকার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে।
ভানুকা রাজাপাকশেও তাই মনে করেন। তিনি বলেন, ‘এই সংকটময় পরিস্থিতিতে আমরা শুধু একটি কাজই করতে পারি। ক্রিকেট মাঠে ম্যাচ জিতে পুরো দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোঁটাতে পারি।’ জয়াবর্ধনে, সাঙ্গাকারা পরবর্তী যুগে শ্রীলঙ্কা দল কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল বেশ। তবে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য তো সময় লাগে। এই পরিপ্রেক্ষিতে রাজাপাকসে বলেন, ‘আমরা ১২ থেকে ১৫ মাস একসাথে খেলছি। আমরা ক্রমাগত উন্নতি করছি। দুই দশক আগেও শ্রীলঙ্কা একতা ব্র্যান্ড ছিল। আমরা সেই ব্র্যান্ডটি পুনরুদ্ধার করতে চাই।’
রাজাপাকসের কথাতেই স্পষ্ট, শ্রীলঙ্কা অতল গহ্বরে হারিয়ে যাওয়া কোনো দল না। দুই পা পিছু হাটলেও সামনে পাঁচ পা এগিয়ে যাওয়ার দৃঢ় প্রত্যয় তাদের আছে। এমন মানসিকতা অবশ্য লঙ্কানদের মানসিকতাতেই মিশে আছে। ১৯৯৬ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কা তখন গড়পড়তা একটা দল। কিন্তু অধিনায়ক অর্জুনা রাণাতুঙ্গার হার না মানার অপরাজেয় মানসিকতা। সেই মানসিকতায় মাঠের ক্রিকেটেও শ্রীলঙ্কা জিতে নিল সে বারের বিশ্বকাপ। অগ্রজদের কাছ থেকে তাই এ শিক্ষা ভালভাবেই নিয়েছে অনুজরা।
শ্রীলঙ্কার রাজনৈতিক অস্থিরতার আগেও তাদের ক্রিকেট বোর্ডের অবস্থা ছিল আরো নাজুক। সেই অবস্থার কারণে গত বছর ভারত তাদের দ্বিতীয় সারির দল পাঠায় । যাতে করে লঙ্কান ক্রিকেট বোর্ড কিছু রাজস্ব উৎপাদন করতে পারে। এমনকি ভারতের সে দলটি তখনকার পূর্ণ শক্তির শ্রীলঙ্কা দলের চেয়ে ভাল ছিল। কিন্তু সেই ট্যুরই শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটারদের তাঁতিয়ে দেয়। ঐ সিরিজে ভাল পারফর্ম করার কারণে আইপিএলের বেশ কিছু ফ্রাঞ্চাইজিদের চোখে পড়েন শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা। ঠিক পরের আইপিএলেই ডাক পেয়ে যান, হাসারাঙ্গা, রাজাপাকসে, থিকশানা। অথচ তাঁর আগে বেশ কিছু বছর ধরে শ্রীলঙ্কার ক্রিকেটাররা আইপিএলে বঞ্চিত ছিল।
শ্রীলঙ্কার এই দলটায় কুমার সাঙ্গাকারা কিংবা জয়াবর্ধনের মতো ক্রিকেটার নেই। কিন্তু এক ঝাঁক তরুণ ক্রিকেটার আছে যাদের নিজেদের প্রমাণ করার নিরন্তর অভিপ্রায় আছে। সে শক্তিই তাদের এক করেছে। একই সাথে পুরনো শ্রীলঙ্কাকে নতুন করে ফিরিয়ে আনার স্বপ্নের পথে তাদের এগিয়ে দিয়েছে। অগ্রগামী এ অনুজরা সে স্বপ্নজয় নিশ্চয়ই একদিন করবে। আর সেই শুরুটা হল ষষ্ঠবারের মত এশিয়া কাপ জয় দিয়ে।