বর্তমান সময়ে ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি ভারত৷ ঘরোয়া ক্রিকেট থেকে প্রতিনিয়ত অনেক ভালো মানের ক্রিকেটার উঠে আসছে। এর মূলে আছে ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল) সহ, রঞ্জি ট্রফি, দুলিপ ট্রফি। সম্প্রতি আইসিসি টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালের জন্য দল ঘোষণার সাথে সাথে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে সিরিজের জন্য আলাদা স্কোয়াড ঘোষণা করেছে বোর্ড অব কন্ট্রোল ফর ক্রিকেট ইন ইন্ডিয়া (বিসিসিআই)। একই সময়ে দুইটা আলাদা দল ঘোষণা করা নেহাৎ কম কিছু নয়!
ভারত বলেই সম্ভবত এটা সম্ভব। পাইপলাইনে অজস্র খেলোয়াড় আছে যারা জাতীয় দলে খেলতে মুখিয়ে আছে। অন্যান্য দল যেখানে এক স্কোয়াড ঘোষণা করতে কপালে চিন্তার ভাজ পড়ে সেখানে একই সময় আলাদা দুইটি স্কোয়াড ঘোষণা করে নিজের শক্তিশালী পাইপলাইন সম্পর্কে ক্রিকেট দুনিয়ায় আরেকটু জানান দিলো দুইবারের বিশ্ব চ্যাম্পিয়নরা।
ভারতের এই উন্নতি আর শক্তিশালী পাইপলাইন একদিনে তৈরি হয়নি। এর পেছনে আছে লম্বা সময়ের পরিশ্রম আর চেষ্টা। ঘরোয়া ক্রিকেটের অবকাঠামোগত উন্নয়ন, মানসম্মত উইকেট সহ বিভিন্ন অত্যাধুনিক সুযোগ সুবিধার কারণে তাদের এতো উন্নতি।
২০১৮-১৯ সালে ভারতের অস্ট্রেলিয়া সফরে মেলবোর্নে এক টেস্টে লাঞ্চ বিরতিতে ভারতের প্রধান নির্বাচক এমএসকে প্রসাদকে অস্ট্রেলিয়ার প্রধান নির্বাচক ট্রেভর হনসকে জিজ্ঞেস করেন ভারত বেশ দূর্দান্ত কিছু বোলার তৈরি করেছে। প্রসাদ তখন সাবেক ভারতীয় হেড কোচ গ্রেগ চ্যাপেলকে দেখিয়ে বলেন এটা তার সময় থেকেই হয়ে আসছে।
প্রসাদের ভাষ্যমতে চ্যাপেল ঘরোয়া ক্রিকেট বেশ ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করে এরপর ১০-১৫ জন পেসারকে তিনি বাছাই করেন। যার মধ্যে ছিলেন মুনাফ প্যাটেল, ইরফান পাঠান, আরপি সিং, শ্রীশান্ত সবাই গ্রেগ চ্যাপেলের সময়ই উঠে এসেছিলেন। তারা ভারতের হয়ে বেশ কিছু সময় সার্ভিস দেয়। এটা শুনার পর মজার ছলেই হনস বলেছিলেন ওহ গ্রেগ এটা তুমি কি ক্ষতি করলে আমাদের! ভারত আমাদেরকে হারিয়ে দিচ্ছে।
ভারতের এই পাইপলাইনের শক্তিমত্তা দুই বছর পর ২০২০-২১ মৌসুমে অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সিরিজ জয়ের মাধ্যমেই আবার প্রমাণিত হলো। প্রথম টেস্টের পর বিরাট কোহলি, মোহাম্মদ শামি নেই! ভারতের ৩৬ রানে অলআউট, উমেশ যাদব ছিলেন না দুই টেস্টে, হনুমা বিহারি, রবিচন্দ্রন অশ্বিনরাও ইনজুরিতে এক ম্যাচ করে মিস করেন! ভারতের পাঁচজন খেলোয়াড় অভিষিক্ত হয় পুরো সিরিজে। তবুও অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে সিরিজ জয় করেই দেশে ফিরে ভারত। অস্ট্রেলিয়ার মাটিতে ভারত প্রমাণ করে তাদের পাইপলাইন কতটা শক্তিশালী।
সবশেষ ১৯৯৬ সালে একসাথে এক ম্যাচে এতো খেলোয়াড় অভিষেক করায় ভারত। ৬ জন খেলোয়াড ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সেই টেস্টে অভিষিক্ত হন। যার মধ্যে দুইজন হলেন রাহুল দ্রাবিড় এবং পরশ মামব্রে। সেই দুইজনই বর্তমানে ভারতের তরুন ক্রিকেটারদের গড়ার অন্যতম কারিগর।
রাহুল দ্রাবিড় দীর্ঘ সময় খেললেও মামব্রে সেই ৯৬ এর টেস্টের পর আর খেলতে পারেননি। দ্রাবিড় বর্তমানে জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির ডিরেক্টর হিসেবে কাজ করছেন এবং সেখানেই মামব্রে বোলিং কোচ হিসেবে নিযুক্ত আছেন।
অনূর্ধ্ব-১৯ ও অনূর্ধ্ব -১৬ তে মোট ৩৮ টি দল খেলে ভারতের ঘরোয়া ক্রিকেটে। এই খেলোয়াড়দের মধ্যে জাতীয় দলের জন্য কাউকে বাছাই করা খুবই কষ্টসাধ্য ব্যাপার। যার ফলে জুনিয়র নির্বাচক কমিটি রাহুল দ্রাবিড়ের সাথে কথা বলে বলে একটি সিদ্ধান্তে আসে৷ এই ৩৮টি দল থেকে ১৫০টি খেলোয়াড়কে বাছাই করা হবে! এবং এদেরকে ৬ দলে ভাগ করা হবে।
এই ৬ দলকে একমাসের জন্য ক্যাম্পে পাঠানো হবে জোনাল ক্রিকেট অ্যাকাডেমিতে। যেখানে তাদের জন্য থাকবে আন্তর্জাতিক মানের ফিজিও এবং ট্রেইনার। এছাড়া জাতীয় ক্রিকেট অ্যাকাডেমির কোচরা তো আছেই৷ এবং এই ক্যাম্প সাবেক অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের দ্বারাই পরিচালনা করা হয়।
ভারতের অনূর্ধ্ব-১৯ দলে খেলোয়ারদের নেওয়া হয় শুধু যে শিরোপা জিতবে এমনটা ভেবে নয়! বরং তারা অনেক উপরের লেভেলে যেয়ে সফল হতে পারবে সেটা বিবেচনা করেই মূলত খেলোয়াড় বাছাই করা হয়৷
এই জুনিয়র ক্রিকেটারদের ফিটনেস, রান, উইকেট, পারফরম্যান্স সব কিছুই নিয়মিত রেকর্ড করা হয়। এবং এই ৩৮ টি দল থেকে সেরা ৫০ জনকে বাছাই করা হয়৷ তারপর তাদেরকে দুই দলে ভাগ করে দুই মাসের জন্য আলাদা ক্যাম্পে পাঠানো হয়।
এটা মূলত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ১৮ মাস আগে শুরু হয়। এভাবেই সেরা ১৫ জন খেলোয়াড়কে বাছাই করে স্কোয়াড তৈরি করা হয়। বিভিন্ন ধাপে ধাপে খেলোয়াড়দের নির্বাচন করায় এদের মধ্যে বেশিরভাগই পরবর্তীতে দীর্ঘদিন প্রোফেশনাল ক্রিকেটে সার্ভিস দিতে পারে৷
জাসপ্রেত বুমরাহ, মোহাম্মদ শামি, সিরাজ কিংবা রবিচন্দন অশ্বিনরা এভাবেই অনূর্ধ্ব-১৯ ক্রিকেট থেকে উঠে এসেছেন। মূলত রাহুল দ্রাবিড় জাতীয় ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনে দায়িত্ব নেবার পর থেকেই বেশ পরিবর্তন হয় সব কিছুতে। এ দলের ক্রিকেট স্ট্রাকচার নতুন ভাবে তৈরি করা হয়৷ বছরে দেশে কিংবা দেশের বাইরে কয়টি সিরিজ খেলবে সবকিছুই চিন্তা ভাবনার মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়।
ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের এই কোচরা এ দলের রাডারে থাকা ক্রিকেটারদের থেকে ৫০-৬০ জন খেলোয়াড়ের তালিকা করেন। মূলত যারা ধারাবাহিক ভাবে পারফর্ম করেন তারাই এই তালিকায় জায়গা পান। এরপর সেখান থেকেই ঘরোয়া ক্রিকেটের বিভিন্ন ফরম্যাটে তাদেরকে খেলানো হয়৷ এভাবে একটা খেলোয়াড় তৈরি হয়, অভিজ্ঞতা অর্জন করে এবং সবশেষ রঞ্জি ট্রফি, আইপিএল এসব মাধ্যম দিয়ে জাতীয় দলে যাওয়ার চেষ্টা করে।
মূলত তাদের জুনিয়র লেভেলের ক্রিকেটে আন্তর্জাতিক মানের উইকেট, বিভিন্ন ধাপে ধাপে ক্রিকেটারদের বাছাই, অত্যাধুনিক ট্রেনিং ব্যবস্থা ছাড়াও ভারতের পাইপলাইনের এই শক্তিমত্তার পেছনের অন্যতম কারিগরদের একজন হলেন রাহুল দ্রাবিড়। ন্যাশনাল ক্রিকেট অ্যাসোসিয়েশনের দায়িত্বে আসার পর থেকেই তাদের রুট লেভেলের ক্রিকেটের আমূল পরিবর্তন আসে।
তাঁর হাত ধরেই উঠে আসছে অনেক ক্রিকেটার। অবশ্য সব ধরনের সুযোগ সুবিধা থাকায় ভারতীয় ক্রিকেটের এই পর্যায়ে আসা। অন্যান্য দেশের তুলনায় এই দিকগুলোতে এগিয়ে থাকার কারণে ভারতের পাইপলাইনে আজ অজস্র খেলোয়াড় রয়েছে যারা জাতীয় দলে সার্ভিস দিতে প্রস্তুত।
– ক্রিকেট মান্থলির ছায়া অবলম্বনে