বার্সেলোনা আর অ্যাথলেটিক বিলবাওয়ের সম্পর্কটা ঐতিহাসিকভাবেই ছিল বেশ তিক্ততাপূর্ণ। এরই মধ্যে ১৯৯৬/৯৭ মৌসুমে প্রথম বারের মত সান মামেসে পা রাখেন সদ্য বার্সার দায়িত্ব নেয়া ববি রবসন।
প্রতিপক্ষ ডাগ আউটে ছিলেন লুইজ ফার্নান্দেজের মত জাদরেল কোচ। মাঠ আর মাঠের বাইরের আগ্রাসী মনোভাবের জন্য যার হাঁকডাক ছিল গোটা ইউরোপজুড়েই। সেদিন মাঠে দারুণ প্রতাপে তার দল জিতল। আগ্রাসী ফার্নান্দেজের স্লেজিংয়ের প্রত্যুত্তর সাধারণত কেউ দিতে চাইতেন না। রবসনও এড়িয়ে গেলেন।
কিন্তু উত্তরটা এল তখন পর্যন্ত অচেনা, রবসনের পর্তুগীজ দোভাষী, সহকারী হোসে মরিনহোর কাছ থেকে। সে দোভাষী আর ফার্নান্দেজের মধ্যকার বাকবিতণ্ডা পুরো ম্যাচজুড়েই উত্তেজনা ছড়ালও দুই বেঞ্চে। ঘরের মাঠের দর্শকরা অবাক হয়ে দেখলো, একটা পুচকে তাঁদের কোচকে তাঁদেরই মাঠে শাসাচ্ছে!
মরিনহো রেফারির সিদ্ধান্তকে বরাবরই প্রশ্নবিদ্ধ করে আসছিলেন। এক পর্যায়ে ধাক্কাধাক্কিই লেগে গিয়েছিল মরিনহো-ফার্নান্দেজের। ‘যেখানে দুনিয়া আমার বিপক্ষে কথা বলতে ভয় পায় সেখানে কোথাকার কোন অচেনা অজানা এক পুচকে ছোকড়া নাকি আমার বিরুদ্ধে লড়ছে!’-বিলবাওয়ের ফরাসী কোচের রাগটা মূলত সৃষ্টি হয় এ অহম থেকেই।
তবে সে ধাক্কাধাক্কি মরিনহোকে দমাতে পারেনি মোটেও। কারণ, ইউরোপের শীর্ষস্থানীয় চারটা লিগে নিজেকে প্রমাণিত করা, দুটো দলকে ট্রেবল জেতানো একমাত্র কোচ হওয়ার অনেক আগ থেকেই তার ভেতরে একটা একরোখা স্বত্বা ছিল। এ দাম্ভিকতাটাই জীবনের আর সব সাফল্যের ভিত্তি ছিল তার, এটাই সে যাত্রায় সময়ের অন্যতম সেরা কোচের বিরুদ্ধে লড়তে আত্মবিশ্বাস জুগিয়েছিল।
তবে ব্যাপারটা অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছায় এক সময়য়। সেদিন মরিনহোকে মারের হাত থেকে বাঁচিয়েছিলেন দলে তার সবচেয়ে কাছের লোকটা, পেপ গার্দিওলা!
স্পোর্টিং লিসবন আর পোর্তোয় চার বছর রবসনের সহকারী হয়ে কাজ করার পর তারই সঙ্গে বার্সায় আসাই নিয়তি হল মরিনহোর। তবে দুজনের প্যাকেজকে নয়, বার্সা চেয়েছিল কেবল রবসনকেই। সহকারী হিসেবে সাবেক অধিনায়ক হোসে অ্যালেক্সাঙ্কোকে তৈরিই রেখেছিল তারা। রবসনের গোঁ, মরিনহোকেই প্রয়োজন তার। শেষমেশ যার কাছে হার মানে বার্সা।
‘সে যখন এসেছে তখন তার কাজটা ছিল কেবলই অনুবাদক’-রবসন আর মরিনহোর সঙ্গে কাজ করা এক সিনিয়র সদস্য তার ব্যাপারে বলেন, ‘কিন্তু সে একজন সহকারী কোচও ছিল। দুটো ভূমিকা পুরোপুরি বেমানান ছিল, যা দু-তিনটা সংবাদ সম্মেলন শেষে সবার সামনে চলে আসে। রবসনের কথা অনুবাদ করার পরিবর্তে তিনি নিজের মতামতটাও যোগ করে দিতেন। আর গুরুকে রক্ষা করার কাজটাও করতেন তিনি, যেটা করতে গিয়ে সাংবাদিকদের সঙ্গে বিবাদেও জড়িয়েছেন বেশ ক’বার। আর তাই তাকে অনুবাদের কাজ থেকে তুলে নিতে হয়েছিল আমাদের।’
সাংবাদিকরাও একে ভিন্নভাবে মনে রেখেছেন। তৎকালীন স্থানীয় দৈনিক এ এসের প্রতিবেদক সান্তি হিমেনেজ জানান, নিজেদের মতামত থাকার কারণে রবসনের কথার হুবহু অনুবাদ করতে পারতেন না মরিনহো। সমসাময়িক কিছু ইংরেজি জানা প্রতিবেদক জানান, রবসনের কথাগুলো বেছে বেছে অনুবাদ করছিলেন তিনি! এর কিছু পর থেকে ড্রেসিংরুমে অনুবাদ চললেও, সংবাদ মাধ্যমে কাজটা বন্ধ হয়ে গিয়েছিল মরিনহোর।
এরও বছর চারেক আগে নিজের ভাষাগত দক্ষতার কারণেই তৎকালীন লিসবন প্রেসিডেন্ট সুসা সিনাত্রার কল্যাণে রবসনের সান্নিধ্যে এসেছিলেন মরিনহো। স্কুলশিক্ষক মরিনহোর বাবা ফেলিক্স মরিনহো ছিলেন স্থানীয় দল ভিতোরিয়া সেতুবালের গোলরক্ষক। এরপর ক্লাবটির ম্যানেজার হয়েছিলেন ফেলিক্স। সে সূত্র ধরেই ফুটবলে আসা, তারপর রবসনের সান্নিধ্যে।
‘সে ছিল একটা রত্ন। সে আমাকে রক্ষা করতো বিভিন্ন সময়ে, যে তিনটা ক্লাবে আমরা একসঙ্গে ছিলাম তার খেলোয়াড়দের সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির সময়ে আমাকে সাহায্য করতো। যখনই সাহায্যের প্রয়োজন হত সে পাশে এসে দাঁড়াতো, এমনকি কখনো সখনো নিজেকে বিপদে ফেলেও!’-শুরুর দিনগুলোর মরিনহোকে এমন ভাবেই বর্ণনা করেছিলেন রবসন।
তবে মরিনহো যে সবসময়ই রবসনকে ভালো খবর দিতেন ব্যাপারটা মোটেও তেমন ছিল না। ১৯৯৩ উয়েফা কাপে যখন লিসবন ক্যাসিনো সালজবুর্গের কাছে হারে তখনো লিগে দলটা শীর্ষেই ছিল। তবুও সে হারটা তাঁতিয়ে দিয়েছিল লিসবন সভাপতিকে। ম্যাচ শেষে বিমানের ইন্টারকমে এসে ঝাঁঝালো কিছু একটা বললেন। মরিনহো রবসনকে জানালেন, খেলার ফলটা লিসবনের জন্য অপমানকর ছিল আর দেশে ফিরেই রবসনের সঙ্গে কথা বলতে চান তিনি।
সভাপতির সঙ্গে কথা হয়েছিল রবসনের, তবে সেটা সুখকর কিছু মোটেও ছিল না। পুরো স্টাফদের সামনে তাকে বরখাস্ত হতে হয়েছিল, জীবনে প্রথমবারের মত। এ অভিজ্ঞতাটা অবশ্য মরিনহোর জীবনে দ্বিতীয়বারের মত এসেছিল। প্রথমবার ১০ বছরের শিশু মরিনহো বড়দিনের উৎসবমুখর পরিবেশে বাবার চাকরীচ্যুত হবার খবরটা পেয়েছিলেন।
রবসন আর মরিনহোকে খুব বেশি সময় বেকার থাকতে হয়নি, পরের জানুয়ারিতেই লিসবনের চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পোর্তোর কোচ হন রবসন, বলা বাহুল্য সেটা ছিল মরিনহোর পরামর্শ শুনেই! আর পর্তুগীজ তরুণের হল পদোন্নতি। দোভাষী থেকে এবার পুরোদস্তুর সহকারী কোচ।
সরাসরি এই পদোন্নতির কারণ? রবসন নিজেই জানালেন, ‘তাকে স্কাউটিং করতে পাঠাতাম। ফিরে এসে সে যে মানের প্রতিবেদন দিত তা ছিল বিশ্বমানের।’ এ কাজে অবশ্য মরিনহো নতুনও ছিলেন না মোটেও। ১৪ বছর বয়স থেকেই বাবার সঙ্গে এটা করে এসেছেন তিনি। তার বাবা ১৫ বছর বয়সী মরিনহোকে বলেছিলেন কাজটা তো তোমার জীবিকা হতে পারবে না! চোয়ালবদ্ধ মরিনহোর সেদিনই সংকল্প করেছিলেন ফুটবল কোচিংয়ে আসার।
তারপর ফুটবলার হবার চেষ্টায় কিছুটা সফল হয়েছিলেন তিনি। খেলেছিলেন পর্তুগীজ দ্বিতীয় বিভাগ ফুটবলে। নিজের সীমাবদ্ধতা বুঝে এরপর বেশ কিছু কোচিং কোর্সে নাম লেখান তিনি। ভিতোরিয়া সেতুবালের যুব দলের কোচিংও করিয়েছেন বেশ কিছুদিন। দ্বিতীয় বিভাগের দল এস্ত্রেলা দে আমাদোরায় ছিলেন ফিটনেস ট্রেইনার হিসেবেও। ১৯৯২ এ যখন লিসবন বিমানবন্দরে যখন রবসনের সঙ্গে প্রথমবার দেখা হল, অভিজ্ঞতার ঝুলিটা তাই অতোটা হালকাও ছিল না তার।
পোর্তোতেও দু’জনে কঠিন সময়ের মুখোমুখি হয়েছেন। ২৬ বছর মিডফিল্ডার রুই ফিলিপ গাড়ি দুর্ঘটনার কবলে পড়েছিলেন ৷ তবে মাঠে সব ঠিকঠাকই চলছিল। ১৯৯৪ চ্যাম্পিয়নস লিগে সেমিতে পৌঁছেছিল দলটা৷ যদিও ক্রুইফের বার্সার কাছে ৩-০ ব্যবধানে হেরেছিল রবসন-মরিনহোর পোর্তো।
তবে, রবসনকে ঠিকই চিনতে পেরেছিল বার্সা। পরের দুই মৌসুমে পোর্তোকে দুটো লিগ আর একটা কাপ জেতানোয় ১৯৯৬ সালে তাকে পেতে আগ্রহ দেখায় কাতালান ক্লাবটি। দুই মাস দীর্ঘ আলোচনার পর মরিনহোর সঙ্গে শলাপরামর্শ শেষে সে বছর জুলাইয়ে যোগ দিলেন বার্সায়। গোঁ ধরে মরিনহোকে সহকারী হিসেবে রাখতেও রাজি করালেন।
ব্যাপারটা তার জীবনে এমন দাগই কেটেছিল, যে কারণে ঔদ্ধত্বের জন্য বিখ্যাত মরিনহোও শ্রদ্ধাভরে রবসনের কথা স্মরণ করেছেন বহুবার! বলেছেন, ‘দুটো ক্লাবে কাজ করতে আমাকে সাহায্য করেছেন তিনি। তারপর এনেছেন বিশ্বেরই অন্যতম বড় এক ক্লাবে। তার কাছে আমি ঋণী।’
এমনকি বিশ্বসেরা হওয়ার দীক্ষাটাও তার কাছেই পেয়েছিলেন, অভিমত মরিনহোর। বলেন, ‘আমরা দুজনে ভিন্ন ঘরাণার ছিলাম। তবে সেরা কোচ হওয়ার জন্য কী করা দরকার সেটা তার কাছেই জেনেছিলাম।’
বার্সায় কিছুটা পরিবর্তন আনতে হয়েছিল রবসন-মরিনহো জুটিকে। কারণ, বার্সা ক্রুইফের দর্শনটাকেই ধরে রাখতে চেয়েছিল। তবে মরিনহো ঠিকই মানিয়ে নিয়েছিলেন কাতালুনিয়ায়। খেলোয়াড়দের আরও কাছে, সাংবাদিকদের সঙ্গে আরেকটু বন্ধুসুলভ হয়ে উঠেছিলেন এ সময়ে। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে অ্যাওয়ে ম্যাচের আগে সাংবাদিকদের সঙ্গে শহর চষে বেড়ানো ছিল তার নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার।
সাংবাদিকদের সঙ্গে তার সখ্যতার ব্যাপারে এল পাইস প্রতিবেদক লু মার্টিন বলেন, ‘আমাদের সঙ্গে য়ার সম্পর্ক এত ভাল ছিল, তাকে আমরা আমাদের ভেতরকার গুজবও জানাতাম। একদিন রবসনের সঙ্গে তার সম্পর্কে শারীরিক সম্পর্কের ব্যাপারে খুনসুটি করেছিলাম। প্রত্যুত্তরে হাসতে হাসতে সে বলেছিল, ‘তোমার বোনকে নিয়ে এসো, দেখি ব্যাপারটা সত্য কিনা!’ আমার আরও মনে পড়ে, সে বলেছি, ‘যারা আমাকে ভালোবাসে কিংবা ঘৃণা করে, আমার ব্যাপারে তাদের মতামত নিয়ে আমি কখনো ভাবি না।’
বার্সায় বন্ধুদের কাছে ‘হোসে’ নামে পরিচিত ছিলেন তিনি। খুব কাছের জনরা ডাকতো ‘জে’ নামে। বার্সেলোনায় খেলোয়াড়দের সঙ্গে একটা পেশাদারী দূরত্ব রাখতেন রবসন। তবে মরিনহোর ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ছিল উল্টো। সে মৌসুমেই দলে আসা পর্তুগীজভাষী রোনালদোর সঙ্গে সখ্যতা হয়ে গিয়েছিল কিছুদিনেই, যা প্রথম মৌসুমেই রোনালদোর সেরাটা বের করে এনেছিল।
আরেকজন কাছের মানুষ ছিলেন পেপ গার্দিওলা। দলের তৎকালীন অধিনায়ক প্রায়ই খেলার মাঠের কৌশল নিয়ে আড্ডায় ঘণ্টার পর ঘণ্টা পার করে দিতেন মরিনহোর সঙ্গে। তবে একে ঠিক বন্ধুত্ব বলতে নারাজ গার্দিওলা। ২০১১ চ্যাম্পিয়ন্স লিগ সেমিফাইনালে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ডেরায় থেকে মুখোমুখি হওয়ার আগে গার্দিওলা বলেন, ‘আমাদের কোন সন্দেহ থাকলে আমরা কথা বলতাম, ধারণা অদলবদল করতাম কিন্তু সেটাই আমাদের সম্পর্কের গতিপথ ঠিক করে দিয়েছিল, তেমনটা আমার মনে হয় না। ঠিক বন্ধুত্ব নয়, তবে কাজ চালিয়ে নেয়ার মতো একটা সম্পর্ক ছিল আমাদের।’
মরিনহো জানান, এই বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্কটাই ক্লাবের খেলোয়াড়দের মন জিতে নেয়ার ভাল উপায় ছিল। তিনি বলেন, ‘এমন মানের খেলোয়াড়দের কোচ হলে আপনি সাহায্য করতে পারবেন না, তবে শিখতে পারবেন। এমনকি আপনি মানবিক সম্পর্কের ব্যাপারেও জানতে পারবেন। এ মানের খেলোয়াড়রা কেবল আপনি কোচ বলেই আপনার কথা মেনে নেবে না। নিজের যুক্তি প্রমাণ করতে হবে। এখানে কোচ হচ্ছেন একজন পথপ্রদর্শক, যিনি সংকেত দেন, খেলোয়াড়রা সেটা বুঝে নেয়। আমার দর্শন হচ্ছে পথ দেখানো আর আবিষ্কার করা।’
মরিনহো খুবই মনোযোগী ছিলেন, সামনের প্রতিপক্ষকে নিয়ে ভিডিও বিশ্লেষণ বানানোর কাজটা ছিল তার উপর। খেলোয়াড়রা এটাকে ভালোবাসতেন। এক মৌসুমের জন্য বার্সায় খেলা লঁরা ব্ল সেসব ভিডিওকে সাথে করে বাড়িতেও নিয়ে যেতেন, বাড়তি প্রস্তুতির জন্য।
রবসন তার একমাত্র মৌসুমে স্প্যানিশ কাপ, সুপার কাপ ও ইউরোপিয়ান কাপ উইনার্স কাপ জিতেছিলেন। লিগ জিততে পারেননি সে মৌসুমে, ফলে চাকরীচ্যুত হতে হয় তাকে। তার জায়গা নেন লুই ফন হাল। ৫ বছর রবসনের সঙ্গী হয়ে মরিনহো শিখলেন, ‘গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা হল যখন আপনি জিতবেন আপনিই সেরা সে কথা ভাবা চলবে না মোটেও, আবার হারলে ভাববেন না আপনি খুবই খারাপ। রবসন বিভিন্ন পদ্ধতি নিয়ে পড়াশোনা কিংবা অনুশীলনের পরিকল্পনা নিয়ে মোটেও চিন্তিত ছিলেন না। পুরোপুরি মাঠের মানুষ ছিলেন তিনি, যিনি খেলোয়াড়দের সঙ্গে সরাসরি যোগাযোগে বিশ্বাসী ছিলেন, পুরোপুরি আক্রমণনির্ভর কোচ ছিলেন তিনি। রবসনের কাজ ছিল শুধু ফাইনাল থার্ড নিয়েই। আর তাই রক্ষণ নিয়ে আমার বাড়তি কাজ করতে হত।’
রবসন চলে যাওয়ার পর মরিনহোর সঙ্গে দীর্ঘ পাঁচ বছরের কোচ-সহকারী সম্পর্কের ইতি ঘটে। তবে মরিনহোর ইচ্ছা ছিল পর্তুগালে ফিরে যাওয়ার। কাতালুনিয়ায় থেকে গিয়েছিলেন রবসনের কথায়। এমনকি স্প্যানিশ সংবাদ মাধ্যমে গুঞ্জন ছিলো, মরিনহোকেই কোচ হিসেবে নেয়ার জন্যেও সুপারিশ করেছিলেন রবসন!
ফন হালের অধীনে কাজ আরেকটু বাড়লো মরিনহোর। আগের স্কাউটিংয়ের কাজটা তো ছিলই, একটু ভিন্নমাত্রাও যোগ হয় এতে। সাবেক আয়াক্স কোচ তাকে প্রতি ম্যাচে গ্যালারি থেকে দেখার আদেশ দিয়েছিলেন, ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখার জন্যেই ছিলো এই কৌশল। বিরতির শুরুতেই মরিনহোর রিপোর্ট অনুসারে দলকে আবারও ঢেলে সাজাতেন ফন হাল।
মরিনহোর একগুঁয়েমি ডাচ এই কোচও দেখেছেন। কোচ কোথাও ভুল করলে ধরিয়ে দিতেও দ্বিধায় ভুগতেন না তিনি। আর তাই খুব অল্প দিনেই ফন হালের সবচেয়ে কাছের সহকারী বনে যান মরিনহো। দলের সবার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র খুঁটিনাটি জানার কারণে ক্লাবের খেলোয়াড়দের মাঝেও জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন তিনি। ভিন্ন কিছু হয়ে ওঠার আভাস সে সময় থেকেই দিতে শুরু করেছিলেন তিনি।
তবে মৌসুমদুই যেতেই অবসাদ পেয়ে বসে মরিনহোকে। ১৯৯৯ মৌসুমে ন্যু ক্যাম্পে চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ফাইনাল ছিলো বলে ক্লাবের প্রধান লক্ষ্য ছিলো চ্যাম্পিয়ন হওয়া। কিন্তু ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড আর বায়ার্ন মিউনিখের সঙ্গে গ্রুপ অফ ডেথ নিয়তি হয় তাদের। প্রথম রাউন্ড থেকেই বিদায় নেয় বার্সা। ফন হালের পতনের সেই শুরু। মরিনহোও জেনে গিয়েছিলেন, এখানে আর বেশিদিন থাকা হবে না তার। যদিও ব্রাগা কোচ হওয়ার প্রস্তাব তিনি ফিরিয়ে দিয়েছিলেন সে বছরই, ন্যু ক্যাম্পেই এর চেয়ে বেশি আয় ছিল তার।
ততদিনে অর্থের মূল্যও বুঝে গিয়েছিলেন তিনি। রিভালদো তাকে বলেছিলেন, ‘শিরোপা তোমার ঋণগুলো এসে শোধ করে দেবে না।’ অর্থের জন্যই বার্সায় আরও একটা নিরানন্দ বছর কাটিয়েছিলেন তিনি। মরিনহো পরে জানিয়েছিলেন, সে সময়ে তিনি ‘একজন হতাশ কোচ, খুবই রুঢ় ও ছিদ্রান্বেষী’ হয়ে পড়েছিলেন। তার উপর যোগ হয়েছিলো সভাপতি বদল। নতুন সভাপতিকে মোটেও মনোপুত হয়নি তার, ফলে মৌসুমের শেষেই ক্লাব ছাড়েন তিনি।
বার্সায় তিনি কেমন প্রভাবশালী ছিলেন তার একটা ধারণা মিলে সাবেক বার্সা ডিফেন্ডার রেইজিগারের কথায়। তিনি বলেন, ‘তার চলে যাওয়ার পর সব খেলোয়াড় তার শূণ্যতা অনুভব করছিলো। একজন সহকারী কোচ হিসেবে এটা অনেক বড় একটা পাওয়াই ছিল তার।’
পর্তুগালে ফিরে পুরো গ্রীষ্ম বেকার বসে রইলেন। সাবেক গুরু রবসন অবশ্য আবারও সহকারী হওয়ার জন্যে তাকে নিউক্যাসলে ডেকেছিলেন, কিন্তু মরিনহো অপেক্ষায় ছিলেন বড় কিছুর। ২০০০ এর মধ্য-সেপ্টেম্বরে য়্যুপ হেইঙ্কেসের জায়গা নিলেন বেনফিকায়। কোচ হিসেবে মরিনহোর অভিষেক হলেও আগমনী বার্তা শোনাতে আরও বছর চার অপেক্ষা করতে হল তাকে। বেনফিকা থেকে বরখাস্ত হয়ে চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী পোর্তোকে ২০০৩-০৪ মৌসুমের সম্ভাব্য তিনটি বড় শিরোপাই জেতান মরিনহো।
এর এক সপ্তাহ পর চেলসিতে যোগ দেন, ভাষাগত যোগ্যতা আর সদম্ভ আচরণের সঙ্গে এখন যোগ হয়েছিল বিশাল অভিজ্ঞতার ঝুলিও। ‘দ্য স্পেশাল ওয়ান’ হতে আর কোন বাঁধা ছিল না মরিনহোর।