মেসি বিশ্বকাপ না জিতলেও সর্বকালের সেরাই থাকতেন। সেই জবাব দেয় পরিসংখ্যান। ২০১৪ বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা মোট গোল করেছিলেন আটটা। এর মধ্যে লিওনেল মেসির গোল – অ্যাসিস্ট ছিল পাঁচটা। যদি প্রি-অ্যাসিস্টও যোগ করা হয়, তাহলে আট গোলের সাতটা তেই অবদান মেসির। ২০১৫ কোপা আমেরিকায় এক গোল, তিন অ্যাসিস্ট। ২০১৬ কোপা আমেরিকায় চার ম্যাচে পাঁচ গোল আর চার অ্যাসিস্ট।
২০১৪-১৬ টানা তিনটা টুর্নামেন্টে ১৮ ম্যাচে ১০ গোল, ৮ অ্যাসিস্ট, ১১টা ম্যাচ সেরা পুরস্কার, বিশ্বকাপ গোল্ডেন বল, কোপা আমেরিকার টুর্নামেন্ট সেরা। ‘ক্লাব কিংবদন্তি, জাতীয় দলে ফ্লপ’ মেসির আর্জেন্টিনাকে নিয়ে যাত্রাটার সামান্য পরিসংখ্যান। এমন হাজারো পরিসংখ্যানের লাখো রেকর্ড দিয়েও মেসির ইমপ্যাক্ট ব্যাখা করা সম্ভব নয়। একটা অগোছালো টিম নিয়ে তিনি টানা তিনটা ফাইনালে তুলেছেন আর্জেন্টিনাকে।
কিন্তু এত বর্ণাঢ্য যাত্রার আক্ষেপ একটাই,টানা তিনটা টুর্নামেন্টে অতিমানবিক পারফর্ম করেও ট্রফিটা ছু্ঁতে পারেননি মেসি। ২০১৬ সালেই অভিমান, আক্ষেপ আর চোখের জলে বিদায় বলে দেন প্রিয় আকাশী নীল জার্সিটাকে। অথচ ক্লাব প্রতিযোগিতায় সবধরনের ট্রফি ও ব্যক্তিগত পুরস্কার জেতা মেসি সবসময় বলতেন, দেশকে একটা ট্রফি এনে দিতে এসব অর্জনও বির্সজন দিতে প্রস্তুত তিনি।
পরে অবশ্য পুরো দুনিয়ার ভক্তদের অনুরোধে, দেশের টানে শেষ অবধি আবারো ফেরেন জাতীয় দলে। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৯০০০ ফিট উপরে থাকা স্টেডিয়ামে হ্যাট্রিক করে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপে আনেন মেসি। আর্জেন্টিনার স্মরন কালের অন্যতম বাজে টিমের একটা ছিল সেই দলটা। কোয়ার্টার ফাইনালে বাদ পড়ল ফ্রান্সের কাছে। সেই ৪-৩ হারা ম্যাচেও দুইটা অ্যাসিস্ট ছিল মেসির। ২০১৯ কোপাতেও সেমিতেই বিদায়, ট্রানজিশন পিরিয়ড থাকা দল নিয়ে বেশি দূর যাওয়া হয়নি মেসির।
তবে অন্ধকারের পরেই আলো আসে, লড়াই চালিয়ে গেলে মুক্তির স্বাদ আসেই। হার না মানা মেসিও পান দায়মুক্তির মিষ্টির সুভাস। ২০২১ সালে কোপা আমেরিকা জিতলেন মেসি। আর্জেন্টনার ২৮ বছরের শিরোপা খরা কাটলো তার হাত ধরেই। চার গোল আর পাঁচ অ্যাসিস্ট করে হলেন টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড়। ২০২২ সালের মাঝামাঝিতে জিতলেন ফিনালসিমা। ইউরো জয়ী ইতালিকে ৩-০ তে গুড়িয়ে দিয়ে হলেন ম্যাচ সেরা।
টানা ৩৫ ম্যাচ অপরাজিত মেসির আর্জেন্টিনা এবার গেলেন ২০২২ বিশ্বকাপের মঞ্চে। মরুর দেশে সৌদি আরবের কাছেই হারলেন প্রথম ম্যাচ। আবারও শুরু হল তাকে নিয়ে ট্রল, সমালোচনার ঝড়। বড় মঞ্চে নাকি মেসি বা আর্জেন্টিনা কেওই ধোপে টিকে না। মেসি ভক্ত-সমর্থকদের ধৈর্য্য ধরতে বললেন। বললেন, ‘ভরসা হারাবেন না, আমরা আপনাদের আশাহত করব না।’
যেমন কথা, তেমন কাজ। গ্রুপপর্ব থেকেই বাদ পড়ার শঙ্কায় থাকা আর্জেন্টিনার আরেক দফা ত্রাতা হয়ে উঠলেন মেসি। প্রায় দুর্ভেদ্য মেক্সিকোর জালে বল পাঠালেন ডি-বক্সের বাইরে থেকে। গ্রুপ সেরা হয়েই নক আউটে উঠলেন মেসি ও তার দল। এর আগে বিশ্বকাপ নক আউটে গোল ছিল না মেসির। কিন্তু এবার যেন মেসি এসেছিলেন সব অপূর্ণতাকে পূর্ণতা দিতে।
নিজেকে যেন ধরা নিয়ে গেলেন ধরা ছোয়ার বাইরে। শেষ ষোল, কোয়াটার ফাইনাল, সেমিফাইনাল প্রতিটা ম্যাচেই গোল করলেন মেসি। সবশেষে ১৮ ডিসেম্বর ২০২২ রাতে এল সেই মহেন্দ্রক্ষন। বিশ্বকাপ ফাইনাল, প্রতিপক্ষ কিলিয়ান এমবাপ্পের বিশ্বসেরা ফ্রান্স। ফুটবল ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ফাইনাল দেখলো পুরো বিশ্ব। মেসির বিরুদ্ধে বহুকাল যাবত একটা গুঞ্জন ছিল যে চাপে পড়লে তিনি ভেঙে পড়েন। কিন্তু, ফাইনালে সেটাকেও বুড়ো আঙুল দেখান তিনি।
যে পেনাল্টি মিস করা নিয়ে সমালোচিত হতেন, সেই পেনাল্টি থেকেই দলকে শুরুতে এগিয়ে দেন মেসি। এরপর নাটকীয় ফাইনালে ২-২ এ ফ্রান্স ফিরে আসে। কিন্তু ভেঙে পড়েননি তিনি, ১০৮ মিনিটে আবারও গোল করে দলকে ৩-২ এর লিড এনে দেন। এমবাপ্পের অতিমানবীয় পারফরম্যান্সও সেদিন পারেনি মেসিকে সোনালি ট্রফিটা পাওয়া থেকে আটকাতে। ফুটবল ইশ্বরও হয়ত চেয়েছিল ফুটবল বরপুত্র যেন ‘দায়মুক্তি’-টা অবশেষে পেয়েই যান।
পাঁচ বিশ্বকাপের চেষ্টার পরে জিতেছেন সেই কাঙ্খিত সোনালি ট্রফি টুকু, যার আরাধনায় আর্জেন্টিনার কেটেছে ৩৬ বছরের আক্ষেপ। ৭ ম্যাচে সাত গোল, তিন অ্যাসিস্ট, পাঁচটি ম্যাচ সেরার পুরস্কার। হয়েছেন টুর্নামেন্ট সেরা খেলোয়াড়ও। আর্জেন্টিনার মোট গোলের ৬৬ শতাংশে তার সরাসরি অবদান।
দুঃসময়ের কাঁটা ফুঁড়ে বের হয় ফুল, সব হারিয়ে যে উঠে দাঁড়ায়, জয় হয় তারই। মেসি পেরেছেন জিততে, হারকেও হার মানাতে। বনে গেছেন তর্কসাক্ষেপে সর্বকালের সেরা খেলোয়াড়। টানা তিনটা ফাইনাল হারা থেকে টানা তিনটা ফাইনাল জয়।
মেসি বিশ্বকাপ জিতেছে বলে সর্বকালের সেরা নয়, বিশ্বকাপটা শুধু একটা মুকুট তার অর্জনের সোনালি পালকে। সৃষ্টিকর্তাকে ধন্যবাদ, মেসির জন্য, মেসিকে ধন্যবাদ তার অস্তিত্বের জন্য। এই প্রজন্ম যা বলেছে, তা আর নয়ত আগে কেও দেখেছে না হয়ত তো দেখবে।