সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান বাছতে বসলে একটি যুক্তি সর্বদা দেয়া হয়, ‘দুটি আলাদা প্রজন্মর তুলনা চলতে পারে না।’ তা যুক্তিটা অকাট্য। কিন্তু ক্রিকেট রোমান্টিকের মন তা মানে না। সে মনে মনে ভাবে, শচীন টেন্ডুলকার যদি ম্যালকম মার্শাল, অ্যান্ডি রবার্টসদের পেতেন, তাহলে কি একই গড় ধরে রাখতে পারতেন? বা ভিভ রিচার্ডস যদি বডিলাইন সিরিজে খেলতেন, তাহলে বোথাম-উইলিস দের মতো ভোস বা লারউডকেও কি চুইং গামের মতো ছিবড়ে করে ফেলতেন? ডন যদি আজ খেলতেন তাহলে তাঁর গড় কত হতো? এই রকমই কিছু ক্রিকেট ফ্যান্টাসির ডালা খুলে বসলাম। আচ্ছা, ২০০৩ বিশ্বকাপে যদি সৌরভ গাঙ্গুলি টসে জিতে ব্যাটিং নিতেন? কি হতো!
২০০৩ সালের ২৩ মার্চ। রবিবারের দুপুরে মাংস ভাত খেয়ে, বাঙালি দূরদর্শনের সামনে বসে পড়েছিল আরেক বঙ্গসন্তানের বিশ্বজয় দেখার আশায়। কিন্তু প্রথম ওভারেই মোটামুটি সেই আশা শেষ হয়ে যায়। সৌরভ টসে জিতে বোলিং নেন এবং জহির খান প্রথম ওভারে এতো বেশি রান দিয়ে দেন যে ম্যাচের তার ওখানেই কেটে যায়। কিন্তু কি হতো যদি সৌরভ টসে জিতে ব্যাটিং নিতেন? বহু লোককে বলতে শুনেছি (বা লিখতে দেখেছি ) সেই ম্যাচে সৌরভের সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। তা একেবারে চূড়ান্ত রায় দেবার আগে দেখা দরকার, কেন সৌরভ সেই সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন এবং পরিসংখ্যানগত ভাবে তা আদৌ কতটা যুক্তিযুক্ত ছিল।
অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে ভারতের পূর্বতন ম্যাচে (সেঞ্চুরিয়নে) সৌরভ টসে জিতে ব্যাট নেন। এবং ১২৫ রানে অস্ট্রেলিয়া গুটিয়ে দেয় ভারতকে। অনেকেই হয়তো ভাববেন উইকেটে বল অসম্ভব বেশি সিম করছিল। কিন্তু তাঁরা যদি খুঁটিয়ে দেখেন, দেখবেন উইকেটে সে রকম যুযু ছিল না। হ্যাঁ, পিচে অবশ্যই গতি ছিল, কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার পিচে তা থাকবেই। কিন্তু বল একটু পুরোনো হলে পিচ কিন্তু ব্যাটিং সহায়ক।
হরভজন সিং ও অনিল কুম্বলের অষ্টম উইকেটে ৪০ রানের জুটি যার প্রমাণ দেয়। সেই ম্যাচে সৌরভ ও শেওবাগ যে ব্রেট লির যে বল দুটিতে আউট হন, সেই দুটি ছেড়ে দিলে একটি করে অতিরিক্ত রান পাওয়া যেত। এছাড়া শচীন তো আউট হন গিলেস্পির স্লোয়ারে, কাইফ সেট না হয়ে এবং ফিল্ড না দেখে পুল করতে গিয়ে, ও মোঙ্গিয়া কভারের ওপর দিয়ে তুলে মারতে গিয়ে। আমার ব্যক্তিগত ধারণা ভারত সেই ম্যাচে নেমেছিল অত্যন্ত আগ্রাসী মনোভাব নিয়ে, যে অস্ট্রেলিয়াকে শুরু থেকেই মারবো।
আর ঠিক সেই কারণেই ভারত গুটিয়ে যায় ১২৫ রানে। তা জোহানেসবার্গ যেহেতু সেঞ্চুরিওন মাঠের খুব কাছেই এবং দু জায়গাতেই পিচের চরিত্র যেহেতু একই রকম, সৌরভ এবং দল পরিচালন সমিতির হয়তো মনে অজিদের বিরুদ্ধে সেই আগের হারের ক্ষত রয়ে গেছিল। আর তাও হয়তো সৌরভ ফাইনালে টসে জিতে বল করতেন না, যদি না আগেরদিন বৃষ্টি পড়তো এবং পিচে হালকা আর্দ্রতা থাকতো।
এবার আসা যাক জোবার্গ প্রসঙ্গে। সেই বিশ্বকাপে কেনিয়া-বাংলাদেশ বাদে, ফাইনালের আগে অব্দি জোবার্গে হয়েছিল তিনটি ম্যাচ। পাকিস্তান-অস্ট্রেলিয়া, ভারত-শ্রীলঙ্কা এবং দক্ষিণ আফ্রিকা-নিউজিল্যান্ড। এদের মধ্যে দুটি ম্যাচে অধিনায়ক টস জিতে ফিল্ডিং নেন। পাকিস্তানের ওয়াকার ইউনুস এবং শ্রীলংকার সনাথ জয়াসুরিয়া। প্রথমে আসা যাক, পাকিস্তান অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে।
মনে রাখতে হবে, সেই বিশ্বকাপে জোহানেসবার্গে হওয়া সব ম্যাচ শুরু হয় সকাল ন’টা নাগাদ। তা সকালের হালকা আর্দ্রতা এবং তাজা উইকেট এবং সর্বোপরি জোবার্গের পাতলা হাওয়া বল সিম ও সুইং হতে যথেষ্ট সাহায্য করতো। আক্রাম ও শোয়েব এই ম্যাচে এসবের সাহায্যে অস্ট্রেলিয়াকে যথেষ্ট ঝামেলায় ফেলে। কিন্তু বল পুরোনো হতেই ব্যাটিং অনেক সহজ হয়ে যায়। সেই ম্যাচে সাইমন্ডসের ১৪৩ তাই ক্রিকেট বিজ্ঞান মেনেই।
এরপর আসা যাক ভারত-শ্রীলংকা ম্যাচে। সেই ম্যাচেও সনাথ জয়াসুরিয়া টসে জিতে ফিল্ডিং নেন। কারণ ওই একই, সকাল বেলায় বল সিম করবে বেশি। কিন্তু শ্রীলংকার বোলাররা এতই অগোছালো বোলিং করেন, যে ভারত রে-রে করে তুলে ফেলে ১০ ওভারে ৭০। অনেকটা ভারত-অস্ট্রেলিয়া ফাইনাল ম্যাচের স্মল স্কেল প্রিভিউ ঘটে যায় সেই ম্যাচে। এই দুটি ম্যাচ থেকে যে নির্যাস পাওয়া যাচ্ছে, তা হলো, জোবার্গে প্রথম ৮ ওভার বল সিম করবে, পালিশ থাকাকালীন সুইং ও করবে। কিন্তু পনেরো ওভারের পর, ব্যাটিংয়ের স্বর্গরাজ্য।
এবার কল্পনা করা যাক, সৌরভ হোল্ডিংকে বলছেন, ‘আমরা ব্যাট করবো।’ এবং তার আধ ঘন্টা বাদে, দূর থেকে প্রায় একই দেখতে দুই মক্কেল নামছেন ওয়ান্ডারার্সের বিখ্যাত টানেল পেড়িয়ে। এটা নিয়ে কোনো সংশয় নেই, প্রথম ৪০ মিনিট বল সিম করতো। সেই সময় একটু দেখে খেললে, তারপর কিন্তু ভারতের কাছে বড় রান করার বিরাট সুযোগ থাকতো। গ্লেন ম্যাকগ্রা বোলার হিসাবে অসম্ভব ধারাবাহিক এবং কৃপণ হলে কি হবে, তাঁকে যদি কেউ সাহস করে একটু আক্রমণাত্মক খেলতো, তিনি কিন্তু খেই হারিয়ে ফেলতেন।
যেমন হয় ২০০০ সালের চ্যাম্পিয়ন্স ট্রফিতে বা ২০০০ সালে অস্ট্রেলিয়ার মাঠে রাজ্জাকের বিপক্ষে। ফাইনাল অব্দি ৬৬৯ করা শচীন মনে হয় না ফাইনালের মতো ম্যাচে সেই ভূমিকা পালন করতেন বলে। বীরেন্দ্র শেবাগকে লেলিয়ে দিতেন হয়তো। লেগে গেলে অস্ট্রেলিয়া ছারখার। আর তাড়াতাড়ি উইকেট গেলে, সৌরভ তো আছেনই। সেই বিশ্বকাপে বেশ ভালো ফর্মে ছিলেন তিনি। যদিও সেবার এক্সপ্রেস পেসের সামনে বেশ স্তিমিত ছিলেন তিনি এবং ব্যক্তিগত ভাবে আমি মনে করি লির প্রথম স্পেলটা শেষ হলেই উনি নামতে চাইতেন।
সেটি চলার সময় নয়। কাজেই শুরু থেকে অল-আউট আক্রমণ বোধহয় হতো না। বলের মেরিট বুঝে খেলতেন শচীন-সেওয়াগ। আর সেঞ্চুরিয়ানের হারাকিরির পর ভারত হয়তো ফাইনালে আরো সতর্ক থাকতো ।১৫ ওভারে ৬০ রানে ১ উইকেট। এরকম কিছু হয়তো চাইতো সৌরভের ভারত। ম্যাকগ্রা ততক্ষনে ৭ ওভার করে ফেলেছেন, লি ওভার পাঁচেক। রয়েছেন শুধু বিকেল। হগ, লেহম্যান বা সাইমন্ডস কিন্তু সেই বিশ্বকাপের শচীনের সামনে দুধভাত। এমন কি সৌরভের সামনেও। এই ভাবে খেললে ভারত হয়তো ২৭০ বা ২৮০ মতো করতো, যেমন সেমিফাইনালে করে।
চূড়ান্ত রায়: ২৭০ বা ২৮০ অন্য টিমের কাছে বড় রান হলেও সেই অস্ট্রেলিয়ার কাছে যথেষ্ট হতো বলে মনে হয় না। আমি ৭০ এর দশকের ওয়েস্টইন্ডিজকে দেখিনি, তবে এই সময়ের চূড়ান্ত পেশাদার অস্ট্রেলিয়াকে দেখেছি। এবং মনে হয় সব ম্যাচকেই একই ভাবে দেখো, ফাইনাল বলে আলাদা কিছু নেই, এই ধরণের মনোভাবের খুব কাছাকাছি পৌঁছতে পেরেছিল পন্টিংয়ের অস্ট্রেলিয়া। ৭ নম্বরে ব্যাট করতেন বেভান। এছাড়া গিলক্রিস্ট, হেডেন, পন্টিং, এবং সেই বিশ্বকাপে চূড়ান্ত ফর্মে থাকা সাইমন্ডস তো আছেনই।
২৭০ বা ২৮০ নিয়ে খেলতে নামলে অবশ্য ভারত লড়াই করতো। সাড়ে তিন ঘন্টা পর অ্যাড্রেনালিন ক্ষরণ অনেক কম হতো জহিরের। আর হলফ করে বলতে পারি, উনি ঐরকম অগোছালো বোলিং করতেন না দ্বিতীয় ইনিংসে। ইদানিং একজন বিখ্যাত ক্রিকেট আর্চিভিস্টের থেকে কেনা ২০০৩ বিশ্বকাপের কিছু ম্যাচ বল-বাই-বল দেখার চেষ্টা করছি। এবং শুনছি ধারাভাষ্য।
সব ধারাভাষ্যকার কিন্তু একই কথা বলছেন ফাইনালের অনেক আগে থেকেই, যে এখন ভারত জিতছে তাই মনে হচ্ছে না, কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার সাথে ফাইনাল পড়লে ৪ বোলারে খেলার স্ট্র্যাটেজি কিন্তু মার খেতে পারে। যেখানে মোঙ্গিয়ার মতো কেউ কার্যত কিছুই করেননি বিশ্বকাপ জুড়ে, সেখানে কুম্বলে বা আগারকারকে কেন নেয়া হচ্ছে না, সেটা বোথাম থেকে শাস্ত্রী সকলে প্রশ্ন তুলেছেন। আর ঠিক সেটাই ভোগাবে ২৭০ রান ডিফেন্ড করার সময়। অবশ্যই অতটা লজ্জাজনক হার হতো না যদি ভারত প্রথম ব্যাট করতো। আমার শেষ রায়, অস্ট্রেলিয়া ৪৮ তম ওভারে ৩ উইকেটে জিতত।