ছোটবেলায় গলিতে ক্রিকেট খেলার সময় আমাদের ব্যাট ধরার স্টাইলটা ছিল সবচেয়ে মজার। দুই পাঁয়ের মাঝখানে ব্যাট ধরে আমরা বেশ জোরে জোরে ব্যাট মাটিতে স্পর্শ করতাম। ভাবটা এমন ছিল যে ব্যাট যত জোরে মাটিতে ঠেকানো যায় ছয়টাও বোধহয় ততই বড় হবে।
তবে সেই স্ট্র্যাটিজিতে সমস্যা বাঁধাতো ব্যাটের মালিক বন্ধুটি। বেচারা প্রতি বলের আগে একবার করে মনে করিয়ে দিয়ে যেতো ব্যাটটার প্রতি একটু মায়া দেখানোর জন্য।
তবে প্রশ্ন হচ্ছে এই ব্যাট ধরাটা, এই ব্যাট দিয়ে মাটিকে আঘাত করাটা আমরা শিখলাম কী করে। হয়তো আমরা আমাদের বড় ভাইদের দেখে শিখেছি। কিন্তু কে এই স্টাইলটা পুরো দুনিয়ায় ছড়িয়ে দিল যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হচ্ছে। এই প্রশ্নের উত্তর আমাদের জানা নেই।
তবে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিশেষ এই স্টাইলের সাথে পরিচয় করিয়েছিলেন পাকিস্তানের ব্যাটসম্যান ইজাজ আহমেদ। পাকিস্তানের হয়ে প্রায় ১৭ বছর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলা অসাধারণ এই ব্যাটসম্যানও ঐ সময়ে পাকিস্তানের সেরা ফিল্ডারদের একজন তিনি।
১৯৮৬ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে এবং ১৯৮৭ সালে ভারতের বিপক্ষে টেস্ট অভিষেক হয় ইজাজ আহমেদের। পাকিস্তান ক্রিকেটে ইমরান খান দের স্বর্ণালি যুগে খেলতে এসেও দলে তৈরি করেছিলেন নিজের একটি আলাদা অবস্থান।
টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর ১২ টি সেঞ্চুরির মধ্যে ছয়টিই করেছেন অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। অজিদের বিপক্ষে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ৪৭.১৩। তিনি বাদে পাকিস্তানের শুধু জাভেদ মিয়াদাদেরই অজিদের বিপক্ষে ছয়টি টেস্ট সেঞ্চুরি করার কৃতিত্ব রয়েছে। ইজাজ আহমেদ মোট ৬০ টি টেস্ট খেলে ৩৭ গড়ে করেছেন ৩৩১৫ রান।
তবে, ইজাজ আহমেদের মূল শক্তির জায়গা ছিল রঙিন পোশাকের ক্রিকেট। তাঁর আক্রমনাত্মক ব্যাটিং বিপক্ষ দলের জন্য ছিল বড় দুশ্চিন্তার বিষয়। ১৯৯৭ সালে লাহোরে ভারতের বিপক্ষে তিনি ৬৮ বলে সেঞ্চুরির রেকর্ড করেন। ওই ম্যাচে তিনি তাঁর ক্যারিয়ার সর্বোচ্চ ১৩৯ রানে অপরাজিত থাকেন।
ইজাজ আহমেদ ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ জয়ী পাকিস্তান দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য ছিলেন। পাকিস্তানের সপ্তম ক্রিকেটার হিসেবে তিনি পাকিস্তানের হয়ে ২৫০ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলেন।২০০৩ সালে আন্তর্কাতিক ক্রিকেট থেকে অবসর নেয়ার আগে তিনি সংগ্রহ করেছেন ৬৫৬৪ রান। ওয়ানডে ক্রিকেটে তাঁর ব্যাটিং গড় ছিল ৩২.৩৩।
ইজাজের সহজাত স্ট্রোক খেলায় দারুণ দখল ছিল। টেস্ট কিংবা ওয়ানডে – সব জায়গাতেই পরিস্থিতি বুঝে খেলতে জানতেন। তার ছিল ইস্পাতসম টেম্পারমেন্ট, আক্রমণাত্মক মানসিকতা। ফিল্ডার হিসেবেও ইজাজ আহমেদ ছিলেন অসাধারণ।
মনে করা হয় তিনি পাকিস্তানের সর্বকালের সেরা ফিল্ডারদের একজন। শুধু ফিল্ডিং করে দলের অনেক ম্যাচ জয়ে ভূমিকা রেখেছিলেন তিনি। পরবর্তীতে তিনি পাকিস্তানের ফিল্ডিং কোচের দায়িত্ব ও পালন করেন। ২০১৯ সালে তিনি পাকিস্তান অনুর্ধব-১৯ দলের প্রধান কোচ হিসেবে নিয়োগ প্রাপ্ত হন।
সব মিলিয়ে ইজাজ আহমেদ পাকিস্তান ক্রিকেটের নক্ষত্র। তবে তাঁর সময়টা হয়তো ভুল ছিল। তিনি যেই সময়টাতে আলো ছড়াতে এসেছিলেন তখন পাকিস্তানের ক্রিকেটে ছিল চাঁদের হাট।
তাই হয়তো অনেকটা আড়াল থেকে, নিভৃত্বেই এখনো পাকিস্তান ক্রিকেটকে দু’হাত ভরে দিয়ে যাচ্ছেন তবে তাঁর প্রতিদান সেভাবে পাননি। যেই যুগে ইমরান খান, জাভেদ মিয়াদাদ, ওয়াসিম আকরামদের মত গ্রেটদের নিয়ে গল্প হয়, সেই গল্পে ইজাজ আহমেদকে রাখেন ক’জন।
ব্যাপার হল, ইজাজ আহমেদ জমকালো কোনো চরিত্র ছিলেন না। আরেকটু ভাল করে বললে, তিনি ওয়াসিম-ইমরানদের মত সুপারস্টার ছিলেন না। তাই অনেক কার্যকর হলেও তাঁকে নিয়ে আলোচনা হয় খুবই সামান্য।