শৈশবে খেলতেন ফুটবল। কিন্তু কোচের কথায় সেটি ছেড়ে অ্যাথলেট হয়েছেন ইমরানুর রহমান। চোঁখে বড় স্বপ্ন নিয়ে এসছেন বাংলাদেশে। অংশ নিছেন শহীদ শেখ কামাল ৪৫ তম জাতীয় অ্যাথলেটিক্স প্রতিযোগিতায়। প্রথমবারই বাজিমাত করেছেন। নিজেদের প্রিয় ইভেন্ট ১০০ মিটার স্প্রিন্টে নতুন জাতীয় রেকর্ড গড়ে স্বর্ণ জিতেছেন। স্বর্ণ জিতে একটা স্বপ্ন পূরণ করার পর এবার নতুন স্বপ্ন দেখছেন ইমরানুর।
ইংল্যান্ডে জন্ম ও বেড়ে ওঠার পরও এখন তার স্বপ্ন বাংলাদেশকে নিয়ে। তার প্রথম লক্ষ্য আগামী সাউথ এশিয়ান (এসএ) গেমসে স্বর্ন জেতা। কয়েকমাস আগে ট্রায়াল দিতে লাল সবুজের দেশে এসেছিলেন। এরপর বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স সংস্থার কাছে আবেদন করেছিলেন বাংলাদেশের হয়ে খেলার। সেই অনুমতি পাওয়ার পর প্রথমবার জাতীয় অ্যাথলেটিক্সে খেলেছিলেন। শুরুটা এককথায় দুর্দান্ত হওয়ায় তাকে নিয়ে স্বপ্ন বাড়ছে।
মূলত ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আব্দুর রকিব মন্টুর যোগাযোগের প্রেক্ষিতে ইমরানুরের বাংলাদেশে আগমন। দুজন আবার সিলেট বিভাগের নাগরিক। মন্টু সিলেট জেলার আর ইমরানুর মৌলভীবাজারের। নিজের ক্যারিয়ার নিয়ে স্বপ্ন দেখা এই মানুষটির উপর ভর করে সোনালী দিনে ফিরতে চায় বাংলাদেশের অ্যাথলেটিক্স।
যে ধরনের সুযোগ সুবিধা নিয়ে অ্যাথলেট হিসেবে বেড়ে ওঠা তার কিছুই নেই বাংলাদেশে। নিজের জন্য মাসিক ৬ লাখ টাকা বেতন দিয়ে কোচ রেখেছেন। পাশাপাশি স্কিল ডেভলপমেন্টের জন্য রয়েেেছ স্ট্রেন্থ এন্ড কন্ডিশনিং কোচ, পুষ্টিবিদসহ আরো চারজন। যাদের গাইডলাইনেই নিজেকে প্রস্তুত করছেন বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক পদক এনে দিতে। নিয়মিতভাবে দৈনিক ৩ ঘন্টা করে অনুশীলন করা ইমরান বিশ্বাস করেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়ে নিয়ম মেনে চললে সফলতা আসবেই।
যার প্রথম ধাপটা বেশ সফলতার সঙ্গেই পেরিয়েছেন ২৮ বছর বয়সী এই অ্যাথলেট। ভেঙ্গেছেন ২২ বছরের পুরনো জাতীয় রেকর্ড। যুক্তরাজ্য প্রবাসী ইমরানুর রহমানই এখন আস্থা আর ভরসার নাম। রাজধানীর আর্মি স্টেডিয়ামে ১০.৫০ সেকেন্ড সময় নিয়ে এই কীর্তি গড়েন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর এই অ্যাথলেট। ১৯৯৯ সালে গড়া মাহবুব আলমের ১০.৫৪ সেকেন্ডের রেকর্ড ভেঙ্গে দেন। জন্মভিটা লন্ডন থেকে উড়ে এসে রেকর্ড গড়া ইমরানকে দেখেই যেন অনুপ্রাণিত হয়ে টানা ১১বারের সেরা শিরিন আক্তারের কাছ থেকে দ্রুততম মানবীর খেতাব ছিনিয়ে নিয়েছেন বিকেএসপির সুমাইয়া দেওয়ান।
সে হিসেবে জাতীয় অ্যাথলেটিক্স এবার একসাথে দুজন দ্রুততম মানব-মানবীকে পেয়েছে। ইরমানুরকে চ্যালেঞ্জ জানানো মোহাম্মদ ইসমাইল অবশ্য তৃতীয় হয়েছেন। অথচ পুরুষদের ১০০ মিটারে সেরা ছিলেন নৌবাহিনীর এই অ্যাথলেট। টোকিও অলিম্পিকে খেলার সুযোগ না পেয়ে ফেডারেশনের কঠোর সমালোচনা করে ১ বছরের নিষেধাজ্ঞা পেয়েছিলেন।
এরপর নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে অবশ্য ২ মাস পরে মুক্তি পেলেও সেরা সাফল্য পাননি। ইসমাইল ১০.৬৯ ও একই দলের রাকিবুল হাসান ১০.৬৬ সেকেন্ড সময় নিলেও ইমরানুরের কীর্তিতে তারা ম্লান হয়ে গেছেন। মূলত শারিরীক গঠনই সবাইকে ছাড়িয়ে গেছেন এই অ্যাথলেট। যদিও নিজের সেরা টাইমিংয়ের ধারেকাছে থাকতে পারেননি। সে কারণে খানিকটা হতাশই হতে হয়েছে গেল ২৭ ডিসেম্বর দেশে আসা ইমরানুরকে।
গত বছর আগস্টে লন্ডনে একটি টুর্নামেন্টে ১০.২৭ সেকেন্ডে দৌড় শেষ করেছিলেন। ঢাকায় এসে তার প্রতিফলন রাখতে না পারার কারণ হিসেবে ভ্রমণক্লান্তির সঙ্গে আর্মি স্টেডিয়ামের শক্ত ট্র্যাককে দুষেছেন তিনি, ‘জাতীয় আসরে অংশ নেওয়ার আগে খুব বেশি বিশ্রাম ও অনুশীলনের সময় পাইনি। বিশেষ করে অনেকটা দীর্ঘ সময় বিমান ভ্রমণের ক্লান্তিই বড় কারণ। পুরোপুরি ফিট না হয়েই যেমন দৌড়েছি ঠিক তেমনি আর্মি স্টেডিয়ামের ট্র্যাকটিও বেশ শক্ত ছিল। তারপরও নতুন রেকর্ড করতে পেরে ভাল লাগছে’।
ইমরানুরের স্বপ্ন নিজের টাইমিংটা ১০.১০ সেকেন্ড কিংবা তার নিচে নিয়ে যাওয়া। লন্ডনে নিজের কোচ স্টিফ ভজের অধীনে দীর্ঘমেয়াদি অনুশীলন করার পরিকল্পনা রয়েছে তার। ১৯৯২ সালে ইমরানের বাবা ইংল্যান্ড গিয়েছেন। তার বাবা-মা দুই জনই বাংলাদেশি তারা এখন ইংল্যান্ডে স্থায়ী। ইংল্যান্ডে থাকলেও বাংলাদেশের প্রতি টান রয়েছে তার। এখন বাংলাদেশের পাসপোর্ট হাতে পেলে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার স্বপ্ন রয়েছে, ’কোচের কথায় ফুটবল ছেড়ে ২০১২ সাল থেকে আমি ট্র্যাকে দৌড়াচ্ছি।
নিয়মিতভাবে ইনডোরে ৬০ মিটার এবং আউটডোরে ১০০ মিটার দৌড়াই। এখন আমি বাংলাদেশের পাসপোর্টের জন্য আবেদন করেছি। সেটি পেয়ে গেলে ভবিষ্যতের টুর্নামেন্টগুলো নিয়ে পরিকল্পনা করব। সেটা হলে আগামী এসএ গেমসে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে স্বর্ণপদক জিততে চাই আমি’। ইংল্যান্ডে ১৬-১৭ বছর বয়সে অ্যাথলেটিকসে নাম লেখান ইমরানুর।
২০১৪ ও ২০১৬ সালে ব্রিটিশ ইউনিভার্সিটি ইনডোর অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ৬০ মিটার স্প্রিন্টে সেরা হয়ে নিজেকে চেনানো শুরু করেন। এরপর ২০২১ সালে লি ভ্যালি অ্যাথলেটিকস প্রতিযোগিতায় ১০০ মিটার স্প্রিন্টেও দ্বিতীয় স্থান অর্জন করতে সময় নেন ১০.২৭ সেকেন্ড। তারপর বাংলাদেশে এসে গত বছরের অক্টোবরে বিকেএসপিতে ট্রায়ালে ১০০ মিটার স্প্রিন্টে সময় নিয়েছিলেন ১০.৪০ সেকেন্ড!
তবে এবারের জাতীয় প্রতিযোগিতায় অনেক বছর পর ইলেট্রনিক টাইমার ব্যহার করা হলেও স্কোরবোর্ড নিয়ে ধোঁয়াশা রয়েছে। ইলেকট্রনিক স্কোর বোর্ডে দৌড় শুরু করার সময় ব্যবহার করা হয়েছে বন্দুক। যদিও এর সঙ্গে সেন্সর যুক্ত থাকে। কিন্তু সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে কাঠের যন্ত্র! সেসবকে পেছনে ফেলে ইমরানুর রহমানকে নিয়ে এখন স্বপ্ন দেখছেন অ্যাথলেটিক ফেডারেশনের সাধারন সম্পাদক আব্দুর রকিম মন্টু, ‘ইমরানুরকে খুজে পাওয়ার পর গত এক বছর ধরে বাংলাদেশের হয়ে খেলানোর চেষ্টা করেছি। এবারের জাতীয় আসরের আগে বিশ্ব অ্যাথলেটিক্স সংস্থা আমাদের অনুমতি দেয়। এখন ভবিষ্যতের জন্য তাকে আমরা তৈরি করছি।’