স্পিন দুনিয়ায় ‘ভারত’-এর বিচরণ

এক ইনিংসে দশ উইকেট নেওয়ার রেকর্ড মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠির ভারত-নিউজিল্যান্ড টেস্টের আগেও ছিল মাত্র দুইজন বোলারের। সংখ্যাটা এখন হয়েছে তিন। নতুন করে যুক্ত হয়েছেন ভারতীয় বংশদ্ভূত নিউজিল্যান্ড বোলার আজাজ প্যাটেল। মুম্বাইয়েই জন্ম তাঁর। সেই মুম্বাইতেই বিশ্বরেকর্ড। রুপকথার গল্পও যেন হার মেনে যায়।

দুইবার ওয়ানডে বিশ্বকাপ, একবার টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ জেতা দল ভারত। ক্রিকেট দুনিয়ার অন্যতম পরাশক্তি। ভারতের প্রায় ১৩০ কোটি মানুষে রক্তে যেন মিশে আছে ক্রিকেট। বর্তমানে ক্রিকেটে ভারত প্রতিনিয়ত এমন সব খেলোয়াড় উপহার দিচ্ছে যারা কিনা কিংবদন্তি বনে যাচ্ছে নিত্যদিন সঠিক সময় সুযোগ পেলে। কাড়িকাড়ি খেলোয়াড় অপেক্ষমান পাইপলাইনে। আনন্দের বিষয় হল এদের প্রায় সবাই আন্তর্জাতিক মানসম্মত।

ভারতকে তাই ক্রিকেটার খনি বলাই যায়। এই ক্রিকেট খনির বংশদ্ভূত খেলোয়াড়েরাও কম যাননা কোন অংশে। বিশেষ করে স্পিনাররা। বর্তমানে পৃথিবীর বেশকিছু দেশেকে ক্রিকেটের ময়দানে প্রতিনিধিত্ব করছে বেশকিছু ভারতীয় বংশদ্ভূত স্পিনাররা। তাঁদের মধ্য থেকেই কয়েকজনকে নিয়ে সাজানো আজকের আলোচনা।

  • আজাজ প্যাটেল (নিউজিল্যান্ড)

আজাজ প্যাটেল ছিলেন ভারতের মুম্বাইয়ের যোগেশ্বরি বাসিন্দা। তাঁর যখন আট বছর বয়স তখন তাঁর বাবা-মা সিধান্ত নিলেন তাঁরা পাড়ি জমাবেন নিউজিল্যান্ডে অকল্যান্ড শহরে। যেই ভাবা সেই কাজ। সেইখানেই বেড়ে ওঠা, ক্রিকেটে খেলা আজাজের।

৩৩ বছর বয়সী আজাজ নিউজিল্যান্ডের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলা শুরু করেন ২০১২ সালে। বর্তমানে বা-হাতি স্পিনার আজাজ তাঁর ক্রিকেট ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন একজন পেসার হিসেবে। তবে বয়সের কোটা বিশ পেরোনোর আগেই তিনি বনে যান একজন স্পিন বোলার।

২০১২ সাল থেকে প্রথব শ্রেণির ক্রিকেট খেলতে থাকা আজাজের নিউজিল্যান্ডের হয়ে অভিষেক ঘটে ২০১৮ সালে। আর এখন তিনি ক্রিকেটের ১৪৪ বছরের ইতিহাসের অবিস্মরণীয় একজন। এখন পর্যন্ত তিনি নিউজিল্যান্ডের হয়ে অংশ নিয়েছেন এগারো টেস্ট ম্যাচে। ভারতের বিপক্ষে এক ইনিংসে দশ উইকেট নেওয়ার পাশাপাশি আরো তিনটি ইনিংসে পাঁচ উইকেট নেওয়ার কীর্তি রয়েছে তাঁর। তাঁর টেস্ট উইকেট সংখ্যা সর্বোমোট ৪৩টি। অন্যদিকে সাত টি-টোয়েন্টি খেলে তিনি নিয়েছেন আগারোটি উইকেট।

  • রাচিন রবীন্দ্র (নিউজল্যান্ড)

ভারতীয় সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার বাবা রবি কৃষ্ণমূর্তির ছেলে রাচিন রবীন্দ্রের জন্ম ১৯৯৯ সালে নিউজিল্যান্ডের ওয়েলিংটনে। বাবা তারও বহু আগে নিজেকে স্থায়ী করেছিলেন সেথায়। রাচিনের বাবা ক্রিকেট তথা ভারতীয় ক্রিকেটের বড় ভক্ত। বিশেষ করে ভারতীয় কিংবদন্তি ব্যাটার রাহুল দ্রাবিড় ও শচিন টেন্ডুলকারের। তাইতো এই দুই কিংবদন্তির নামের সম্মিলনে ছেলেন নাম রেখেছেন রাচিন।

বাবার উৎসাহে রাচিন নিউজিল্যান্ডের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে পদার্পণ করেন ২০১৮ সালে। তার বছর তিনেক বাদে ২০২১ সালে নিউজিল্যান্ড জাতীয় দলের জার্সি গায়ে তোলার সৌভাগ্য হয় ২২ বছর বয়সী ব্যাটিং অলরাউন্ডার রাচিনের। তারপর থেকে এখন অবধি তিনি ব্ল্যাকক্যাপসদের হয়ে অংশ নিয়েছেন দুইটি টেস্ট ও ছয়টি টি-টোয়েন্টিতে।

দুই ফরম্যাট মিলিয়ে তাঁর আন্তর্জাতিক উইকেট সংখ্যা নয় অপরদিকে ব্যাট হাতে এখন পর্যন্ত ১০৭ রান সংগ্রহ করেছেন রাচিন রবীন্দ্র। তাঁর দৃঢ় ব্যাটিং দক্ষতায় ভারতের বিপক্ষে কানপুরের প্রথম টেস্ট ড্র করে নিউজিল্যান্ড।

  • ইশ সোদি (নিউজিল্যান্ড)

নিউজিল্যান্ড ক্রিকেটের রঙিন পোষাকে নিয়মিত মুখ ডান-হাতি লেগ স্পিন বোলার ইশ সোদি। ২৯ বছর বয়সী সোদি নিজের জায়গা রীতিমত পোক্ত করে ফেলেছেন নিউজিল্যান্ড দলে। ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের লুধিয়ানা থেকে ইশ সোদির পরিবার নিজেদেরকে থিতু করন নিউজিল্যান্ডে অকল্যান্ডে। তাঁর আগে অবশ্য ইশ সোদি পৃথিবীর আলো দেখে ফেলেছিলেন স্বচোখে।

অকল্যান্ডেই ক্রিকেট ক্যারিয়ারের সূত্রপাত ইশ সোদির। স্পিন বিরুপ পিচে নিজের স্পিং শৈলীর আমুল পরিবর্তন ঘটিয়ে এবং নিজেকে সেরা একজনে পরিণত করেন। যার ফলস্বরুপ নিজেকে খুঁজে পান ব্ল্যাকক্যাপস ড্রেসিং রুমে। ২০১৩ সালে বাংলাদেশের বিপক্ষে টেস্ট দিয়ে নিউজিল্যান্ডের সাথে যাত্রা শুরু করেন ইশ সোদি।

এখন পর্যন্ত সোদির নিউজিল্যান্ডে হয়ে খেলা ম্যাচের সংখ্যা টেস্টে ১৭, ওয়ানডেতে ৩৩ ও টি-টোয়েন্টিতে ৩৩টি। সব ফরম্যাট মিলিয়ে ১৬৭ উইকেট পাওয়া ইশের টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের ট্যালিটা তুলনামূলক বেশি সমৃদ্ধ। আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে তাঁর উইকেট সংখ্যা ৮৩টি। তাছাড়া ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে নিউজিল্যান্ডকে ফাইনালে ওঠাতে ইশ রেখেছিলেন গুরুত্বপূর্ণ অবদান।

  •  কেশব মহারাজ (দক্ষিণ আফ্রিকা)

বাবা ছিলেন ক্রিকেটের ঘরোয়া ক্রিকেট খেলেছিলেন তবে জাতীয় দলের হয়ে খেলার সুযোগ খুব একটা পাননি। সেই বাবার ছেলে কেশব মহারাজ। বাবা আত্মানন্দ ভারতীয় বংশদ্ভুত দক্ষিণ আফ্রিকান নাগরিক হবার সুবাদে কেশবের ভারতের সাথে রয়েছে যোগসূত্র। যদিও তাঁর জন্ম ও বেড়ে ওঠা দক্ষিণ আফ্রিকার ডারবানের নাটালে।

বা-হাতি অফ স্পিনার কেশব এখন রীতিমত প্রোটিয়াদের বোলিং আক্রমণের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ এক অস্ত্রে পরিণত হয়েছেন। বাবা না পারলেও তিনি করে দেখিয়েছেন। গায়ে জড়িয়েছেন প্রোটিয়াদের জার্সি। ৩১ বছর বয়সী কেশবের  দক্ষিণ আফ্রিকার জাতীয় ক্রিকেট দলের যাত্রা শুরু ২০১৬ সালে, টেস্ট অভিষেকের মধ্য দিয়ে।

এখন পর্যন্ত প্রোটিয়াদের হয়ে টেস্ট, ওয়ানডে ও টি-টোয়েন্টিতে ম্যাচ খেলেছেন যথাক্রমে ৩৬, ১৫ ও ৬টি। সব ফরম্যাট মিলিয়ে ১৫৫ উইকেট নিয়েছেন কেশভ। তাছাড়া ব্যাট হাতেও ৮৩৫ রান করছেন কেশভ প্রোটিয়াদের হয়ে।

  • সুনীল নারাইন (ওয়েস্ট ইন্ডিজ)

টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের সেনসেশন বলা যেতে পারে ওয়েস্ট ইন্ডিজ স্পিন বোলার সুনীল নারাইনকে। সারা বিশ্বের ফ্রাঞ্চাইজি লিগ দাপিয়ে বেড়ানো নারাইন বর্তমানে ভারতের আইপিএল দল কোলকাতা নাইট রাইডার্সের একজন গুরুত্বপূর্ণ খেলোয়াড়। ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে তাঁর অভিষেক ঘটে ২০১১ সালে। তারপর রীতিমত আলোড়ন সৃষ্টি করেছিলেন পুরো ক্রিকেট বিশ্বে তাঁর বোলিং দিয়ে।

এই খেলোয়াড়েরও যোগসূত্র রয়েছে ভারতের সাথে। তাঁর পূর্বপুরুষেরা বহুকাল আগে ভারত থেক স্থান পরিবর্তন করে স্থায়ী হয়েছিলেন ক্যারিবিয়ান দীপপুঞ্জে। সেই সূত্র ধরে তাঁকে ভারতীয় বংশদ্ভূত খেলোয়াড় বলাই যেতে পারে। মাঝে তাঁর বোলিং অ্যাকশন পরিবর্তনের কারণবশত নিজেকে হারিয়ে ফেলতে বসা নারাইন আবার খুঁজে পেয়েছেন। ধীরে ধীরে ফিরছেন নিজের পুরোনো রুপে।

এখন পর্যন্ত তিনি ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলের হয়ে খেলেছেন ছয়টি টেস্ট, ৬৫টি ওয়ানডে ও ৫১টি টি-টোয়েন্টি। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে ১৬৫ উইকেট নেওয়া নারাইনের এখন ধ্যানজ্ঞান ফ্রাঞ্চাইজি ভিত্তিক ক্রিকেট। সেখানে নিজেকে ব্যাটার হিসেবেও মেলে ধরার সুযোগ পেয়েছেন নারাইন।

ভারতীয় বংশদ্ভূত আরো অনেক খেলোয়াড় বর্তমানে বিভিন্ন দেশের হয়ে ক্রিকেট খেলে যাচ্ছেন। ভবিষ্যতেও হয়ত দেখা মিলবে আরো অনেক খেলোয়াড়দের। তবে এদের মতো নজড় কাড়তে কিংবা দাপটের সাথে ক’জন খেলোয়াড় খেলতে পারবেন বিভিন্ন দেশের হয়ে তা সময় না হয় বলে দেবে।

  • তানভীর সাংঘা  (অস্ট্রেলিয়া)

সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার হয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছেন তানভীর। যদিও তিনি মূলত ভারতীয় বংশোদ্ভূত। তানভীর অস্ট্রেলিয়ার টি-টোয়েন্টি স্পেশালিস্ট। সম্প্রতি তিনি বেশ আলোচিত হয়েছেন।

এই লেগ স্পিনার দেশটির হয়ে ইতোমধ্যেই ১৫ টি টি-টোয়েন্টি ম্যাচ খেলেছেন। সেখানে তাঁর ঝুলিতে আছে ২১ টি উইকেট। এছাড়া বিগ ব্যাশেও সিডনির হয়ে খেলেন তিনি। যদিও, অস্ট্রেলিয়া দলে অ্যাডাম জ্যাম্পা কিংবা অ্যাশটন অ্যাগাররা থাকায় সাংঘার সুযোগ হয় সামান্যই।  তবে, তাঁকে ভবিষ্যতের বড় সম্ভাবনা বলে বিবেচনায় রাখা হয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link