ডারবান ডিজাস্টার

লজ্জা শব্দটায় আপত্তি আছে। লজ্জা এবং দুর্ঘটনার মধ্যে একটা পার্থক্য আছে। সেই পার্থক্য মাথায় রেখেই বলছি, ডারবানে সেই ১৯৬৬ সালে যে ঘটনাটি ঘটে তাকে ঠিক লজ্জা বলা যায় না। যেমন বছর খানেক আগের ‘সামার অফ থার্টি সিক্স’ ও লজ্জা নয়।

স্কোর কার্ড নিয়ে চর্বণ করা এই পোস্টের উদ্দেশ্য নয়। মোটের উপর ডারবানের প্রাণবন্ত উইকেটে ভারত প্রথম ইনিংসে ১০০ এবং পরের ইনিংসে মাত্র ৬৬ রানে গুটিয়ে যায়। প্রথম ইনিংসে শ্রীযুক্ত অতিরিক্ত বাদে আজহার, শচীন, সৌরভ, কুম্বলে দুই অঙ্কে পৌঁছলেও পরের ইনিংসে রাহুল দ্রাবিড় (২৭) ব্যতীত একমাত্র অতিরিক্ত বাবুই ১৬ রান তুলে দেন।

ডারবানের ভয়ঙ্কর উইকেটে অ্যালান ডোনাল্ড, শন পোলক, ল্যান্স ক্লুজনার ভয়ঙ্কর হয়ে উঠলেন। ব্রায়ান ম্যাকমিলান উইকেট না পেলেও চাপ রেখে গেলেন প্রথম ওভারেই বিক্রম রাঠোর এবং সৌরভকে তুলে নিলেন ডোনাল্ড। পরের ওভারেই রামন। ১৫ রানে ৪ উইকেট পড়ে গেল শুরুতেই।

এখানেই নামলেন রাহুল দ্রাবিড়। রবীন্দ্রনাথের ‘নকল গড়’ কবিতায় কুম্ভের মতো একাই ‘ভূমির পরে জানু পাতি, তুলি ধনুস্বর’ রক্ষা করতে লাগলেন ভারতীয় ক্রিকেটকে। ৭৩ বলের ইনিংসে পাঁচটি চার দিয়ে সাজানো ইনিংসে একটি শব্দই ছিল – শৃঙ্খলা। ট্যালেন্ট, টেকনিক, টেম্পারমেন্ট – ক্রিকেটের ৩-টি এর মধ্যে দ্বিতীয়টির ভরসায় তৃতীয়টি দিয়ে এক দিকে মাটি কামড়ে পড়ে থাকলেন। যেন পেস চক্রব্যুহে অভিমন্যু। অন্যদিকে আজহার, মোঙ্গিয়া, কুম্বলে, শ্রীনাথ, জনসন, প্রসাদ এলেন এবং গেলেন।

রাহুলের ইনিংসটি ছিল টেস্ট ক্রিকেটের আদর্শ ইনিংস।

কিন্তু এর পর ভারতীয় ক্রিকেটের ব্যাটিং অর্ডারে একটি পরিবর্তন ঘটে। সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায়ের ব্যাটিং অর্ডার পরিবর্তন করে তিন থেকে পাঁচ এবং আরও পরে ছয় করে দেওয়া হয়। রাহুল দ্রাবিড়কে ছয় থেকে তুলে আনা হয় তিন নম্বরে। মাঝে অবশ্য দ্বিতীয় জন তিন নম্বরে ভারতের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান। কিন্তু তা সত্ত্বেও প্রশ্ন ওঠে, সৌরভকে তিন নম্বর থেকে সরিয়ে দেওয়া কি অবিচার নয়?

মহামান্য পাঠক, আগেভাগেই ‘দাদা ভক্ত’ বলে দাগিয়ে দেবেন না। ঐ সব ভক্তি-টক্তি আমার কোনও কালেই আজহার-আকরাম—মার্টিন ক্রো- স্টিভ ও ছাড়া কারও প্রতি নেই। ক্রিকেট প্রজ্ঞায় বরং গ্রেগ চ্যাপেলকে পণ্ডিত বলেই আমি মনে করি। তাই একটু নিরপেক্ষ মনেই বিশ্লেষণ করি। এবং নিজের দুই কানে হাত রেখে, স্কোর বোর্ড সম্পর্কে নেভিলীয় মন্তব্যটি না মেনে নিরস পরিসংখ্যান ধরেই এগোই।

অভিষেকের পর থেকে পরের পাঁচ মাসে দক্ষিণ আফ্রিকা পর্যন্ত দ্রাবিড় খেলেছিলেন ৬ টি টেস্ট। প্রথম ২ টি ইংল্যান্ডের লর্ডস এবং ট্রেন্ট ব্রীজ ওভালে। পরের টি দেশের মাঠে ফিরোজ শাহ কোটলায়। এবং পরের তিনটি দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে আহমেদাবাদ, কলকাতা এবং কানপুরে।

সৌরভ অবশ্য আমেদাবাদ ম্যাচে খেলেন নি। অর্থাৎ ৫ টেস্টে ৯ টি ইনিংসে ১ বার অপরাজিত থেকে ৪৮৮ রান। ৬১ গড়ে ২ টি শতরান এবং ১টি অর্ধশতরান। ডারবান ডিজাস্টারের পর ১১ ইনিংসে ৫০.৪ গড়ে ৫০৪ রান।

এবার রাহুল দ্রাবিড়ের পরিসংখ্যানে আসা যাক। ডারবানের আগে ১২ টেস্টে ১০ ইনিংসে ৪০২ রান। ৩ টি হাফ সেঞ্চুরী থাকলেও সেঞ্চুরি নেই। গড় ৪০.২। এর মধ্যে মোতেরায় তিনি তিন নম্বরে নেমেও সুবিধা করতে পারেননি। ইডেনে ওপেন করেছিলেন কিন্তু বলার মতো রান নয়। ডারবানের পর এই পরিসংখ্যান বদলে ৪৩৬ রান হয় ৩৯ গড়ে। ডারবানের ঐ ২৭ রানের ইনিংসটি যদিও অমর ইনিংস।

যে টেস্টের কথা বলছি, তার পরের টেস্টে রাহুল ওপেন করলেন। মাত্র ২ রান। পরের ইনিংসে তিন নম্বরে নেমে মাত্র ১২। সৌরভ অবশ্য চার নম্বরে নেমেও ৩০। কিন্তু ট্যাগ পড়ে গেল, ‘সৌরভ টেস্ট ব্যাটসম্যান নন, অতএব, ছুঁড়ে দাও লোয়ার মিডল অর্ডারে’।

আবারও বলছি, তিন নম্বরে রাহুল দ্রাবিড় ঈশ্বর, তবুও এই পরিসংখ্যানটি কেন জানিনা দিতে ইচ্ছে করল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link