পদ্মকার শিভালকার, টেস্ট ‘বঞ্চিত’ গ্রেট

বলা হয়ে থাকে, টেস্ট ফরম্যাটই ক্রিকেটের সর্বোচ্চ মানদণ্ড। এই মানদণ্ডেই কতশত রথী মহারথীর নাম ক্রিকেটের পাতায় উজ্জ্বল বর্ণে লেখা হয়েছে। তবে এমন ক্রিকেটারও ইতিহাসে আছে যাদের মধ্যে প্রবল সম্ভাবনা ছিল কিন্তু ক্যারিয়ারে কখনোই টেস্ট খেলার সুযোগ পাননি। এদের মধ্যে একজন হলেন ভারতের পদ্মকার শিভালকার।

বোম্বের (বর্তমান মুম্বাই) হয়ে টানা ২৭ মৌসুম খেলেছেন এই ক্রিকেটার। এ সময়কালে ১২৪ ম্যাচে ৫৮৯ নেওয়ার পাশাপাশি তাঁর ঝুলিতে ছিল ৪২ টা ফাইফার। এর পরেও জাতীয় দলে কখনোই টেস্ট খেলার সুযোগ মেলেনি পদ্মকার শিভালকারের।

অবশ্য সুযোগ না পাওয়ার ক্ষেত্রে শিভালকার নিজের ভাগ্যকেও দায়ী করতে পারেন। কারণ তিনি যে সময়ের ক্রিকেটার, ঠিক সে সময়েই ভারতের স্পিন শক্তির অন্যতম ভরসার নাম ছিল বিশান সিং বেদী। ভারতের হয়ে সর্বোচ্চ উইকেট শিকারের রেকর্ড তখন এই স্পিনারের দখলে। তাই প্রবল সম্ভাবনা থাকলেও বিশান সিং বেদীকে সরিয়ে ভারতের হয়ে টেস্ট খেলার স্বপ্ন আর পূরণ হয়নি শিভালকারের।

শিভালকারের অবশ্য এই বাইশ গজের আঙ্গিনাতেই পা রাখার কথা ছিল না। তাঁর ক্রিকেটার হয়ে ওঠা অনেকটা দুর্ঘটনার মতোই বলা চলে। এমনিতে ছোটবেলায় টেনিস বল দিয়ে টুকটাক স্পিন করতেন। তবে এর বাইরে ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্ন মোটেই ছিল না শিভালকারের।

তবে একবার এক সকালে শিভালকারের বন্ধু দত্ত সাটেলকার তাঁর বাড়িতে ডেকে পাঠিয়েছিল। তো শিভালকারের এ বন্ধুর আবার ক্রিকেট খেলার সব সরঞ্জামও ছিল। সেই সকালেই ব্যাটিং প্র্যাকটিস করার জন্য শিভালকারকে কয়েকটা বল করতে বলে বন্ধু দত্ত সাটেলকার। সেবারই প্রথম ক্রিকেটের লেদার বল হাতে নেওয়ার অভিজ্ঞতা হয় শিভালকারের।

কাকতালীয় ব্যাপার হলো, ভারতের সাবেক ক্রিকেটার ভিনু মানকড় আবার সেদিন সেখানে উপস্থিত ছিলেন। তো ঐ অল্প সময়েই শিভালকারের স্পিন বোলিং বেশ মনে ধরে যায় ভিনু মানকড়ের। ভারতের সাবেক এ ক্রিকেটার এরপর আর কালক্ষেপণ করলেন না। সাথে সাথেই শিভালকারকে ডেকে বললেন, ‘এই ছেলে, তুমি তো ভাল বল করো। তোমার ক্লাবে খেলা উচিৎ।’

ব্যাস। ভিনু মানকড়ের এমন প্রশংসাতেই ক্রিকেটের প্রতি প্রবল আগ্রহ জন্মে যায় শিভালকারের। পরবর্তীতে বিজয় মাঞ্জরেকারের কাছ থেকে মুম্বাইয়ের শিবাজি পার্ক জিমখানা ক্লাবে খেলার প্রস্তাবও পেলেন। সে সময়ে যেটি মুম্বাইয়ের সবচেয়ে নামী ক্লাব ছিল।

প্রথমে ভিনু মানকড়। এরপর বিজয় মাঞ্জরেকার, জিকে মেননের সান্নিধ্য পেয়ে শিভালকারও এগিয়ে গেলেন দুরন্ত গতিতে। ২২ বছর বয়সে রঞ্জি ট্রফিতে অভিষেক হলো শিভালকারের। এরপর খেলে গিয়েছেন প্রায় দুই যুগ। এ সময়ের মধ্যে তিনি ১৮ বার রঞ্জি ট্রফিজয়ের স্বাদ পেয়েছেন।

বর্ষীয়ান এ স্পিনারের ভারতের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে সফলতার পাশাপাশি আরেকটি বিস্ময়কর অধ্যায়ও রয়েছে। বয়স ৩৫ পেরিয়ে যাওয়ার পর শিভালকারের ফিটনেসে অবনতি দেখা দেয়। এ কারণে দুটি রঞ্জি ট্রফির মৌসুমও মিস করলেন। হয়তো এখানেই ক্যারিয়ারের ইতি টানতে পারতেন। কিন্তু অবাক করা ব্যাপার হলো, ৪৫ বছর বয়সে এসে আবারো নতুন উদ্যমে ক্রিকেট খেলা শুরু করেন এ স্পিনার। খেললেন টানা তিন বছর, ৪৮ বছর বয়স পর্যন্ত। এমন ক্যারিয়ার সায়াহ্নে এসেও শিভালকার কিন্তু শুধু দলের সদস্যই ছিলেন না, মুম্বাইয়ের একাদশে স্পিন লাইনআপে অন্যতম ভরসার নাম।

ক্রিকেট ক্যারিয়ারে বরাবরই তারুণ্যের উদ্দামে চনমনে থাকতেন শিভালকার। ক্রিকেটার ছিলেন, তবে প্রচুর সঙ্গীত প্রিয় মানুষ ছিলেন। সে সময়ের বলিউডের বেশির ভাগ গানই তাঁর আয়ত্বে ছিল। খেলার মাঠে গুনগুন করে গান গাওয়ারও অভ্যাস ছিল শিভালকারের। আর এটিই তাঁকে অন্য ক্রিকেটারদের চাইতে আলাদা করতো।

প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ক্যারিয়ারে দারুণ সমৃদ্ধ হলেও কখনোই টেস্ট ক্রিকেট খেলা হয়নি পদ্মকার শিভালকারের। তবে বরাবরই ভারতের ক্রিকেটে পরিচিত নাম ছিলেন তিনি। সে সময়ে ভারতের সেরা ব্যাটার বিবেচনা করা হতো সুনীল গাভাস্কারকে। সেই গাভাস্কার তাঁর ‘আইডলস’ বইয়ে দুজন টেস্ট না খেলার ক্রিকেটারের নাম আলাদাভাবে স্মরণ করেছিলেন। এর মধ্যে একজন ছিলেন রাজিন্দার গোয়েল। আর অন্যজন হলেন পদ্মকার শিভালকার।

কখনোই টেস্ট না খেলা শিভালকারের ভাগ্য আরেকটু সুপ্রসন্ন হলে হয়তো খেলতে পারতেন। গাভাস্কারের সেই বইয়ে উঠে এসেছিল এমন তথ্যও। শিভালকারের কথা উল্লেখ করে বইয়ে তিনি লেখেন, ‘আমি যখন ভারতের অধিনায়ক, তখন অনেকবার শিভালকারকে দলে নেওয়ার চেষ্টা করেছি। কিন্তু নির্বাচকদের সাথে মতের অমিল আর সে সময় দলে প্রবল প্রতিযোগিতার কারণে আর নেওয়া হয়নি তাঁকে।’

গাভাস্কার তাঁর বইতে এও লিখেছিলেন যে, ‘শিভালকার যে মানের বোলার তাতে তিনি অনায়াসেই টেস্ট ক্রিকেটে খেলতে পারতো। অন্য কোনো দশকে জন্মালে বোধহয় ভারতের ইতিহাসেরই একজন কিংবদন্তী বোলার হতে পারতেন শিভালকার।’

গাভাস্কারের মতোই বলতে হয়, একটা ভুল সময়েই হয়তো জন্মেছিলেন শিভালকার। হয়তো টেস্ট ক্রিকেট ইতিহাসে কিংবদন্তিদের কাতারে নাম লেখাতে পারতেন তিনি। কিন্তু ভাগ্যের নিয়তিতে, টেস্ট ক্রিকেট আঙিনায় শূন্যতেই আঁটকে গিয়েছেন শিভালকার।

অবশ্য টেস্ট ক্রিকেট না হোক, ভারতের প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে শিভালকারের আসন নিশ্চিতভাবেই কিংবদন্তীদের পর্যায়ে। তিনি নিজে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে পা রাখতে পারেননি। তবে তাঁকে অনুসরণ করেই পরবর্তীতে বহু স্পিনারের গল্পগাঁথা রচিত হয়েছে।

সে সময়ে পেসারদের সাম্রাজ্যে এই শিভালকারের গল্প শুনেই অনেকে স্রোতের প্রতিকূলে হেঁটে স্পিনার হওয়ার স্বপ্নে হেঁটেছিল। উপমহাদেশ মানেই স্পিনারদের আঁতুড়ঘর, সময়ের পরিক্রমায় এমন আপ্তবাণী প্রতিষ্ঠায় পদ্মকার শিভালকার গোড়াপত্তনের সারিতেই ছিলেন।

গ্রেট হওয়ার জন্য একজন ক্রিকেটারকে যে সবসময় প্রচলিত নিয়মের ভিতর দিয়েই যেতে হবে, এমন প্রতিষ্ঠিত ধারাবিধি তো নেই। ভারতের ক্রিকেট আকাশে তাই পদ্মকার শিভালকার নামটা একজন চিরন্তন কিংবদন্তীর কাতারেই থাকবে।

লেখক পরিচিতি

বাইশ গজ ব্যাসার্ধ নিয়ে একটি বৃত্ত অঙ্কন করার চেষ্টা করি...

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link