সুনীল সাগরের গহীনে…

সুনীল গাভাস্কারকে আমি খেলতে দেখিনি। উনি অবসর নেবার প্রায় তিন বছর পরে আমি ক্রিকেট খেলা দেখা ও বোঝার বোধবুদ্ধি লাভ করি। এটা আমার দুর্ভাগ্য। যাঁরা তাঁকে ব্যাট করতে দেখেছেন, তারা অবশ্যই তাঁদের দেখা সেরা মুহূর্তগুলি নিয়ে স্মৃতিচারণ করছেন, করবেন। আমি বরং আজকে একটু অন্যরকম অভিজ্ঞতার কথা ভাগ করে নেবো, যা আমাকে সুনীল গাভাস্কারের ক্রিকেট প্রজ্ঞা, দেশপ্রেম, সাহস ও সূক্ষ্ম রসবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল করে তুলেছে।

সুনীল গাভাস্কারকে টিভিতে লাইভ দেখা আমার কাছে ভাষ্যকার হিসেবে। সেখানেই অন্যদের সঙ্গে তাঁর তফাৎ খুব কম বয়সেই বুঝতে পেরেছিলাম। আধ ঘন্টা ধারাভাষ্য শুনলে অন্তত পাঁচটি এমন বিষয় বা ঘটনার কথা জানতে পারবো যেগুলো হয় আগে জানতাম না নইলে ওঁর দৃষ্টিকোণ দিয়ে দেখিনি কোনোদিন।

২০০৭-০৮ অস্ট্রেলিয়া সফরে যখন অস্ট্রেলিয়া ও আম্পায়ারদের যৌথ জোচ্চুরির মাধ্যমে ভারতকে জেতা সম্ভব এবং ড্র তো অবশ্যই সম্ভব এমন একটা ম্যাচে হারানো হয়, সব ভাষ্যকারকে দেখেছিলাম সঠিক প্রসঙ্গ এড়িয়ে গিয়ে – ভাগ্য, ক্রিকেটে এমন হয়েই থাকে, আম্পায়াররাও মানুষ, ভারত কেন ডিআরএস ব্যবহারে রাজি নয় এইসব বিষয়ে কথা বলে সময় নষ্ট করতে। কেননা তাঁদের চাকরি বাঁচাতে হবে, অন এয়ার বিতর্কিত কিছু বলে প্রচারকারী সংস্থার কোপের মুখে কেউ পড়তে চান না।

গাভাস্কার রীতিমতো গর্জে উঠেছিলেন। প্রায় ১৫ মিনিট হর্ষ ভোগলে সহ অন্যান্য অস্ট্রেলিয়ান ভাষ্যকারদের চুপ করিয়ে রেখে একা বক্তব্য রেখে চলেছিলেন তিনি এবং বলা বাহুল্য, তাঁর ক্রিকেট প্রজ্ঞার কাছে মাথা নত করে চুপ করে থাকতে বাধ্য হন বাকিরা, কেননা প্রত্যেকেই জানতেন, সুনীল গাভাস্কারের বলা প্রতিটা কথা তেতো সত্য।

প্রথমেই তিনি মাইকেল ক্লার্কের সৌরভের ক্যাচ প্রসঙ্গ টেনে বলেন ক্লার্ক নিজে প্রথম স্লিপে ক্যাচ দিয়ে আউট হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল যতক্ষণ না আম্পায়ার আউট দেন। ( সঙ্গে সঙ্গে টিভিতে সেই আউট এর রিপ্লে দেখানো হয়) – রিপ্লে দেখে গাভাস্কার বলতে থাকেন (স্মৃতি থেকে লিখছি, একটু এদিক ওদিক হতে পারে) – ‘Yes, you have nicked it to the first slip. Not to the keeper. What are you waiting for? You are out! as clear as daylight! Why are you not walking?? What kind of honesty is this? And when the same person claims a bump catch we have to accept his word for it? Is it the same gentlemen’s game we played?’

এরপরে আসে সাইমন্ডসের কট বিহাইন্ড প্রসঙ্গ, যেখানে সাইমন্ডস আউট হয়েও আম্পায়ারের দাক্ষিণ্যে বেঁচে যান এবং সেঞ্চুরি করেন। অন্যদিকে দ্রাবিড়, সৌরভ সহ একাধিক ব্যাটসম্যানকে ভুল আউট দেন ( সৌজন্যে বাকনার ও তাঁর সহযোগী)। এ প্রসঙ্গেও গাভাস্কার বলেন – যেখানে একটি দলকেই সব ভুল সিদ্ধান্তের জের বহন করতে হচ্ছে, সেখানে this game is a big leveler – কথাটি হাস্যকর।

তিনি এও বলেন যে সিরিজের শুরুতে দুটি দলের মধ্যে ভদ্রলোকের চুক্তি হয়েছিল, যে ক্লোজ ক্যাচের ক্ষেত্রে ফিল্ডারদের কথা গ্রহণ করতে হবে, কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা যায় সমস্ত ক্লোজ সিদ্ধান্তের ক্ষেত্রে ভারতীয়দের আপিল উপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে থাকেন অস্ট্রেলিয়ান ব্যাটসম্যানরা, আর অধিকাংশ সিদ্ধান্ত তাঁদের পক্ষেই যায়; অপরদিকে ভারতীয়দের ক্ষেত্রে পন্টিংই যেন আম্পায়ারের ভূমিকা পালন করছিলেন এবং এই গোটা অধ্যায়ে গাভাস্কার ছাড়া কাউকে প্রকাশ্যে প্রতিবাদ জানাতে দেখা যায়নি সেদিন।

অনেকেই ৯৩ সালের মুম্বাই দাঙ্গার কথা জানেন, যেখানে গাভাস্কার উন্মত্ত জনতার রোষের সামনে প্রাণভয়ে কাঁপতে থাকা (সম্ভবত ভিন্নধর্মী) এক পরিবারকে (শিশু সহ) রক্ষা করেন। সবচেয়ে যা শ্রদ্ধা আদায় করে নেয়, তা হলো গাভাস্কার সেখানে নিজের খ্যাতি ও পরিচিতিকে ব্যবহার করেছিলেন শরণার্থীর রক্ষার মত মহান কার্যে। তিনি পরিষ্কার বলেন – ‘এই পরিবারের গায়ে একটিও আঁচড় লাগার আগে তোমাদের আমাকে মারতে হবে। আমি বেঁচে থাকতে এদের গায়ে স্পর্শ করতে দেবোনা।’

বলা বাহুল্য, মুম্বাইতে দাঁড়িয়ে গাভাস্কারের সামনে এর পরে যত উন্মত্ত জনতাই হোক না কেন, তাঁরা মাথা নিচু করে পিছু হটতে বাধ্য হয়। এই ঘটনা আমি জেনেছি অনেক পরে, সম্ভবত কোনো বই থেকে।

আরেকটি ঘটনা বলে শেষ করবো, ১৯৮১ সালের মেলবোর্ন টেস্টের সেই কুখ্যাত ওয়াক আউট যা নিয়ে অনেকেই সানি কে দায়ী করেন যে দলের অধিনায়ক হয়ে তিনি অবিমৃষ্যকারীর মতো আচরণ করেছিলেন এবং একচুল জন্য ভারত সেবার ম্যাচ ফোরফিট করা থেকে বেঁচে যায় ম্যানেজার শাহিদ দুরানি ও অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার বাপু নাদকার্নির হস্তক্ষেপে।

কিন্তু প্রকৃত ঘটনা গাভাস্কার প্রকাশ্যে আনেন কমেন্ট্রি করার সময়। অস্ট্রেলিয়ার গেমসমানশিপ ও স্লেজিং এর সঙ্গে সকলেই পরিচিত, সিডনির ঘটনায় তার একটা চিত্র সবাই দেখেছেন। এই টেস্টটি ছিল সিরিজের তৃতীয় টেস্ট এবং আগের দুটি টেস্টে রান না পাওয়া গাভাস্কার মেলবোর্নে রান পেতে মরিয়া ছিলেন। একটা ভালো ইনিংস তৈরী হচ্ছিলো চেতন চৌহানের সঙ্গে একটা ভালো ওপেনিং জুটিও হচ্ছিলো, এমন সময় ব্যক্তিগত ৭০ রানের মাথায় লিলির বলে একটা বেশ বড়সড় ইনসাইড এজ হয়ে বল লাগে তাঁর প্যাডে এবং অবাক হয়ে সানি দেখেন যে আম্পায়ার রেক্স হোয়াইটহেড আঙ্গুল তুলে দিয়েছেন।

গাভাস্কার ব্যাট দিয়ে প্যাডে মেরে ইঙ্গিত করেন যে বলটি তিনি ব্যাট দিয়ে আঘাত করেছিলেন, কিন্তু ততক্ষনে যা হবার হয়ে গেছে। এতেও হতাশা চেপে রেখে তিনি সাজঘরের দিকে হাঁটা লাগিয়েছিলেন, কিন্তু বিপক্ষের শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যানের উইকেট ভাগ্যের জোরে পেয়ে গিয়ে ডেনিস লিলি ও অন্যান্য কয়েকজন সতীর্থ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার গাভাস্কারকে বেশ কিছু অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি করেন এবং ‘গেট লস্ট’, ‘গো টু হেল’ ইত্যাদি শব্দবন্ধের ব্যবহার হয়। এর পরেই প্রতিবাদে সুনীল গাভাস্কার চেতন চৌহানকে নিয়ে মাঠ থেকে বেরিয়ে যাবার জন্যে হাঁটা দেন।

যদিও অবশেষে চেতন কে ফেরত পাঠানো হয় এবং শেষদিনে কপিল কার্টিলেজ ইনজেকশন নিয়ে টেস্টটা ভারতকে জিতিয়ে দেন (প্রথম ইনিংসে ম্যাচের সেরা বিশ্বনাথের ১১৪ ভুললে চলবে না)। সিডনির অপমানের বদলা ভারত যেমন পার্থে পরের টেস্টেই দিয়েছিলো, তেমনি এই ৮১ মেলবোর্ন টেস্টে গাভাস্কারের অপমান যেন গোটা দলকে চাগিয়ে দিয়েছিলো শেষদিন মাত্র ৮৩ রানে অস্ট্রেলিয়াকে অলআউট করে টেস্ট জিতে বদলা নেবার জন্যে।

বলা যায়, অস্ট্রেলিয়ার সাথে ভারতের তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার শুরু এখান থেকেই হয়েছিল, যা পরে ২০০৮ পার্থে পুরোপুরি বিকাশ লাভ করে। গাভাস্কারের কমেন্ট্রি বক্সে বসে বলা কথার সূত্র ধরেই তৎকালীন অধিনায়ক অনিল কুম্বলে বলে যান, – ‘একটাই দল তো ক্রিকেটের স্পিরিট মেনে খেলেছে।’

এই যে বুকের ভিতর অদৃশ্য তেরঙ্গা বহন করে চলা, শ্বেতাঙ্গ আগ্রাসনের বিরুদ্ধে গুটিয়ে না গিয়ে বুক চিতিয়ে জবাব দেওয়া, এগুলো শুরু তো সেই গাভাস্কারই করেছিলেন। অস্ট্রেলিয়ার অসভ্যতার জবাবে ইটের বদলে পাটকেল দেওয়া ভারত যে সৌরভ গাঙ্গুলির সময় থেকে শুরু করে, তার পথপ্রদর্শক ছিলেন সানি।

আমার কাছে সুনীল গাভাস্কার তাই ভারতের সর্বকালের সেরা টেস্ট ওপেনার শুধু নন, ভারতকে বিশ্বমঞ্চে চোখে চোখ রেখে লড়তে শেখানোর এক দিকপাল। যা আরেক দিকপাল কপিলদেবও বিভিন্ন সাক্ষাৎকারে একাধিকবার অকুন্ঠে স্বীকার করেছেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link