এই প্রশ্নের উত্তরে যাওয়ার আগে একটা সরল কথা বলে নেওয়া যাক, সাকিব আল হাসানকে নিয়ে একটা চরম বিপাকে আছে বাংলাদেশের টেস্ট ক্রিকেট। না পারা যাচ্ছে তার প্রতিনিয়ত বাড়তে থাকা ছুটির দাবি সরল ভাবে মেনে নিতে। আবার বিশ্বের অন্যতম সেরা এই অলরাউন্ডারকে উগরে ফেলাও যাচ্ছে না।
সোজা কথায়, সাকিব এখন বিপরীর্থাতে গলার কাটা হয়ে গেছেন। তাকে দরকার; কিন্তু নিজেদের সময় মতো পাওয়া যাচ্ছে না।
২০১৮ সাল থেকেই টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে সাকিবের এই ছুটির ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। ২০১৮ সালের শুরু থেকে এই ২০২১ সালের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশ ২২টি টেস্ট খেলছে। এর মধ্যে চলতি টেস্টসহ মাত্র ৮টি টেস্টে এই অলরাউন্ডারকে পাওয়া গেছে।
মানে, গত চার বছরে দেশের ১৪টি টেস্টেই অনুপস্থিত ছিলেন সাকিব আল হাসান। এর মধ্যে কখনো কখনো ইনজুরি সমস্য হয়েছে, সেটা অস্বীকার করার উপায় নেই। তবে বেশিরভাগ সময়ই ‘পারিবারিক কারণে’ তিনি ছুটি নিয়ে খেলা থেকে দূরে থেকেছেন।
এখন কথা হলো, সাকিব কী কাজটা ঠিক করছেন? তিনি কী বাংলাদেশের ক্রিকেটের অসহায়ত্বের সুযোগ নিচ্ছেন?
সাদা চোখে তাই মনে হতে পারে।
সাকিব যখন ইচ্ছে হচ্ছে খেলছেন। তিনি খেলতে রাজী হলে তাকে বাদ দেওয়ার মত ক্ষমতা এখনও বাংলাদেশের হয়নি। আবার তাকে টেস্ট থেকে ঝেড়ে ফেলার মত অবস্থাতেও বাংলাদেশ যায়নি। কিন্তু গুরুত্বপূর্ন সময়ে তিনি সরে দাড়াচ্ছেন। ফলে মনে হতে পারে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের এই যে সাকিব নির্ভরতা, সেটাকে কাজে লাগিয়ে ‘আরাম’ করে বেড়াচ্ছেন সাকিব।
কিন্তু আসলে কী ব্যাপারটা তাই? একটু অজনপ্রিয় কথা বলা যাক। আমি বরং মনে করি, বাংলাদেশের এই অতি সাকিব নির্ভরতার কারণে, সাকিব চাইলেও টেস্ট থেকে সরে যেতে পারছেন না। তার আসলে মনের বিপক্ষেই বাংলাদেশ দলকে সহানুভূতি দেখিয়ে মাঝে মাঝে টেস্ট খেলতে হচ্ছে।
দেখুন, সাকিবের বয়স কাগজে কলমেই আর ক দিন পর ৩৫ হয়ে যাবে।
সারা বিশ্বের ব্যস্ত ক্রিকেটাররাই এই সময়ে বেছে বেছে খেলতে শুরু করেন। তারা এই সময়ে এসে ঠিক করেন যে, সব ফরম্যাট আর তিনি খেলবেন না। বিশেষ করে টেস্ট থেকেই নিজেকে সরিয়ে নেন এই বয়সী ক্রিকেটাররা। ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটের দাপট এই প্রবণতাকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।
ওয়েস্ট ইন্ডিজ থেকে শুরু করে নিউজিল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া, ইংল্যান্ডেরও অনেক ক্রিকেটার এখন টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ার, ফ্রাঞ্চাইজি ক্যারিয়ার বড় করার জন্য ৩০ পার হতেই টেস্ট ক্রিকেটকে সরিয়ে নিচ্ছেন। এখন কথা হচ্ছে, সাকিব সেটা করলে অন্যায় কেনো হবে?
সাকিব বাংলাদেশের একমাত্র আর্ন্তজাতিক গুরুত্বপূর্ন তারকা। বাকী খেলোয়াড়দের আসলে ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে ওরকম কদর নেই। যে মুস্তাফিজের আছে, তারও বয়স ঢের কম। ফলে সাকিবকে আসলেই একজন গেইলের মত করেই ভাবতে হয়। তাকে আমাদের আঞ্চলিক প্রেক্ষাপটে ভাবলে চলে না। ফলে তিনি ভাবতেই পারেন যে, টেস্ট থেকে মুক্তি পেলে তিনি আরেকটু আয়েসের সাথে জীবনটা কাটাতে পারতেন। আরেকটু লম্বা করতে পারতেন ক্যারিয়ারটা। এই ভাবার অধিকার অবশ্যই সাকিবের আছে।
কিন্তু কেনো তিনি সেটা করতে পারছেন না?
কারণ, তিনি এরকম সিদ্ধান্ত নিলে বাংলাদেশে ‘ছিঃ ছিঃ’ শুরু হয়ে যাবে। এমনিতেই আমরা জাতি হিসেবে ঈর্ষাপরায়ন। সাকিব আল হাসানের এই বাড়বাড়ন্ত আমাদের সহ্য হয় না। ফলে তিনি টেস্টকে ‘বিদায়’ বলে নিন্দা শুরু হবে। এই নিন্দার সবটুকু ঈর্ষাপ্রসূত, তাও নয়। এখানে অসহায়ত্বও আছে। আসলে সাকিবকে ছাড়া তো আমরা ক্রিকেট কল্পনাই করতে পারছি না।
বাংলাদেশ দলে সাকিবের বিকল্প হয়ে ওঠার আশেপাশেও কেউ নেই। ফলে সাকিবের অনুপস্থিতিটা বড় বেশি চোখে পড়ে। সাকিব না থাকলে আমাদের একজন বোলার বা ব্যাটসম্যান কম নিয়ে খেলতে হয়। ফলে দীনতা একদম কঙ্কাল হয়ে প্রকাশ পড়ে যায়। ‘হায় হায়’ রবটাও তাই বেশি হয়ে ওঠে।
আমার সাথে সাকিব আল হাসানের এসব বিষয়ে কখনো কথা হয়নি।
তবে অনুমান করতে পারি যে, একজন বাংলাদেশী হিসেবে তিনি যেমন গর্ববোধ করেন, তেমনই এই অসহায়ত্ব বুঝতে পারেন। তেমনই ‘হায় হায়’ এবং ‘ছিঃ ছিঃ’ যে হবে, সেটাও অনুমান করতে পারেন। তাই নিজেকে নিরাপদ রাখতে, দলটার পাশে সম্ভব হলে একটু থাকতেই সাকিব বারে বারে একটু সুযোগ পেলে ফিরে আসেন। কিন্তু সুযোগ তো সবসময় মেলে না।
সাকিব আর খুব বেশিদিন এভাবেও চালাতে পারবেন না। সময় ছোবল বসাবেই। সাকিব একসময় আর খেলতেই পারবেন না। আমরা তখন কী করবো? এমন করেই ‘হায় হায়’ করতে থাকবো? এমন করেই আমরা সাকিব আল হাসানের কথা ভেবে রাগ করবো এবং চোখের জল ফেলবো?
নাকিব সাকিবকে ছাড়া চলতেও শিখবো? সেই সাকিবহীন পথ চলার প্রস্তুতিটা কোথায়?