সুপারহিরো অ্যাকশন ঘরানার কমিক সিনেমা ‘দ্য ডার্ক নাইট’ সিনেমায় একটা উক্তি ছিল, ‘ইউ এইদার ডাই আ হিরো অর ইউ লিভ লং এনাফ টু সি ইওরসেলফ বিকাম দ্য ভিলেন।’
আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট থেকে মুশফিকুর রহিমের অবসর নেওয়ার ঘোষণা দেওয়ার পর থেকে শুধু এই উক্তিটাই মনে পড়ছে। তাঁর অবসর নেওয়ার পর থেকেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে যেন স্বস্তির হাওয়া বইছে, অভিবাদন আছে কিন্তু কোথাও কোনো আক্ষেপ নেই, ‘ইশ! আর কিছুদিন খেলে যেতে পারতেন’ এমন সুরও সম্ভবত কারো কাছ থেকে চাউর হয়নি। যেন বহুদিন ধরে সমর্থকদের প্রবল এক আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন।
টেস্ট আর ওয়ানডে, দুই ফরম্যাটেই বাংলাদেশের অন্যতম সেরা ব্যাটার মুশফিক। কিন্তু দুই ফরম্যাটে নিয়মিত পারফর্ম করা ব্যাটারই যে ক্রিকেটের সবচেয়ে ছোট সংস্করণে ভাল করবেন সেটা ভাবা বড্ড ভুল। মুশফিকের ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই৷ দেশের হয়ে কখনোই এ ফরম্যাটে ধারাবাহিক ছিলেন না তিনি। কিন্তু তারপরও সিনিয়র ক্রিকেটার হওয়ার সুবিধা নিয়ে দিনের পর দিন খেলে গিয়েছেন। কোথায় থামা উচিত সেটাই যেন ভুলে গিয়েছিলেন এ ব্যাটার।
১৬ বছরের ক্যারিয়ারে মাত্র ৬ টা হাফ সেঞ্চুরি। এর চেয়েও করুণ অবস্থা তাঁর রানের পরিসংখ্যানে। ১৫০০ রান পূরণ করতে ম্যাচ খেলেছেন ১০২ টা। যা ১৫০০ রান করা ব্যাটারদের মধ্যে সর্বোচ্চ। একই সাথে ১৫০০ রান করা ব্যাটারদের মধ্যে সবচেয়ে কম স্ট্রাইক রেটে ব্যাট করা ব্যাটারেরও নাম মুশফিক।
টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে টানা এ ব্যর্থতা বোধহয় মুশফিককেও শেষ পর্যন্ত স্পর্শ করেছে। তাই জানিয়ে দিলেন, এ ফরম্যাটে বাংলাদেশের হয়ে আর খেলছেন না। দেরিতে হলেও তাঁর অন্তত বোধোদয় হয়েছে। হ্যাঁ। এটা ঠিক, রাজসিক কোনে বিদায় হলো না। কিন্তু সত্যি বলতে এই ফরম্যাটে রাজসিক বিদায়ের সময়টা তিনি বহু আগেই পেরিয়ে এসেছেন।
মুশফিক এই ফরম্যাট থেকে অবসর নিলেন। তাহলে এবার কার পালা? মুশফিক তো আর একাই দলের কাঁটা হয়ে ছিলেন না। আরো অনেকেই ছিলেন। আঙুলটা যে সিনিয়রদের দিকেই যাচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
মুশফিক অবসর নেওয়ায় সিনিয়র বলতে আছেন সাকিব আর রিয়াদ। দলের অধিনায়ক সাকিব তার পারফর্মেন্সে এখন পর্যন্ত অন্তত উজ্জ্বল। এখনো অবধারিত চয়েস, দলের অন্ত:প্রাণ বললেও ভুল হয় না। কিন্তু রিয়াদ? গত এক বছর ধরে বলতে গেলে নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। তাই প্রশ্ন এসেই যায়, মুশফিকের পর তবে কি এবার রিয়াদ? সে প্রশ্নেরই উত্তর খোঁজা যাক।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ বেশিরভাগ সময় ব্যাটিং করেন ৫ অথবা ৬ নাম্বারে। পরিসংখ্যান বলছে, ২০২১ সাল থেকে তিনি ২৬ ইনিংসে সর্বমোট রান করেছেন ৪৯৬। বাংলাদেশের মানদন্ড বিবেচনায় এই সময়কালে ২৩.৬২ গড়টা খারাপ না৷ কিন্তু বিপত্তি বাঁধে তখন যখন দেখা যায় এ সময়কালে তার স্ট্রাইক রেট টা ১০৫.৩১! ২০২২ সালে এসে সেই স্ট্রাইক রেটটা একটু বেড়ে ১১০ হলেও গড় নেমে গিয়েছে ১৮.৮৮ তে।
অর্থাৎ, বিগত প্রায় দুই বছর ধরেই তিনি ধারাবাহিতা আর স্ট্রাইক রেটের সমন্বয়হীনতায় ভুগছেন। আরো যেটা চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সেটা হলো, তিনি আগের মতো আর ইনিংস বিল্ডআপ করতে পারেন না। গড়পড়তা ইনিংস আর জঘন্য স্ট্রাইকরেট রেখেই প্রায়শই আউট হয়ে ফিরে যাচ্ছেন। বলতে গেলে, দলকে বিপদে রেখেই চলে যাচ্ছেন। অর্থাৎ ফিটনেস কিংবা শরীরের রিফ্লেক্স কমে যাওয়ার কারণেই হোক ম্যাচ পরিস্থিতিতে তিনি আর প্রত্যাশিত চাওয়াটা মেটাতে পারছেন না।
শ্রীলঙ্কার ভানুকা রাজাপাকশে, আফগানিস্তানের নাজিবুল্লাহ জাদরান, এরা দু’জনই মাহমুদউল্লাহ রিয়াদের পজিশনে খেলে থাকেন। তো তারা এমন পজিশনে কেমন করেছেন সেটার একটু তুলনামূলক চিত্র তুলে ধরা যাক।
ভানুকা রাজাপাকসের টি-টুয়েন্টি অভিষেক হয়েছিল ২০১৯ সালে। সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত তিনি প্রায় ১৪০ এর কাছাকাছি স্ট্রাইকরেট ধরে রেখেছেন৷ ২০২১ এবং ২০২২, দুই বছরেই তার স্ট্রাইকরেট ছিল ১৪০+। মিডল ওভারগুলোতে রানের গতি বাড়াতে এমন ব্যাটারই তো দরকার টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে।
নাজিবুল্লাহ জাদরানের পুরো টি-টোয়েন্টি ক্যারিয়ারেরই স্ট্রাইকরেট ১৪৩! শেষ দু’বছরে তিনি এই সংখ্যাটাকে নিয়ে গিয়েছেন প্রায় ১৫০ তে! অর্থাৎ সময়ের সাথে তিনি আরো পরিণত হচ্ছেন। এমনকি নাজিবুল্লাহর ব্যাটিং গড়টাও এ দুই বছরে বেশ ঈর্ষণীয়, ৩৮.২০।
এখন প্রশ্ন হলো, বর্তমান টি-টোয়েন্টি ক্রিকেট যেটা ডিমান্ড করে সেটা কি মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ মেটাতে পারছেন? মহাদেশীয় ক্রিকেটারদের সাথে তুলনা করলেই বুঝা যায়, রিয়াদ সেটা মেটাতে তো পারছেনই না বরং প্রায় নিয়মিতই দলকে প্রেশারে ফেলে দিচ্ছেন। যার দরুন নেতিবাচক ফল ভোগ করতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
মাহমুদউল্লাহ রিয়াদকে বাদ দিয়ে আরেকজনকে আনলেই যে এই ফরম্যাটে বাংলাদেশ রাতারাতি পরিবর্তিত হয়ে যাবে, বিষয়টা এমন না। কিন্তু একজন তরুণ ক্রিকেটারকে সুযোগ দিলে তার সার্ভিস বাংলাদেশ অনেকদিন পাবে। রিয়াদ নিশ্চয় এখন ক্যারিয়ারের পিকটাইমে নেই। বলা ভাল, তিনি ক্যারিয়ার সায়াহ্নেই আছেন। খুব বেশি দেওয়ারও কিছু নেই তাঁর। তাহলে তাঁর কারণে আরেকজনের ‘সেরা সময়’কে কেন বলি দিতে হবে?
মুশফিকুর রহিম বিদায় নিয়েছেন। সে বিদায় অনেক দিন আগে থেকেই প্রত্যাশিত ছিল। রিয়াদের বিদায়ক্ষণও অনেক আগেই তৈরি হয়ে গিয়েছে। এখন শুধু তাঁর অন্তিম সিদ্ধান্তের পালা। বিজয়ীর বেশে মাঠ ছাড়বেন নাকি ভিলেন হয়ে মাঠ ছাড়তে বাধ্য হবেন, সেই সিদ্ধান্তও নিশ্চয় রিয়াদ নেবেন।