পাঁচ ফুট এগারোকে কুর্নিশ করুন

খুব ক্লিশে হয়ে যাওয়া একটি বাক‍্য – ‘জীবন কখনো কখনো কল্পনার থেকে ও বেশি নাটকীয়, বেশি রোমাঞ্চের।’ এবং কথাটা ভিষণ রকম সত‍্যি হয়ে ওঠে নদীয়ার চাকদহের এক বাসিন্দার দিকে তাকালে। ঊনচল্লিশ ছুঁয়ে চল্লিশ এ পা রাখবেন তিনি! কিন্তু চাকদহের ঝুলন গোস্বামীর তাতে থোড়াই কিছু এসে যায়! আসলে বয়স শুধু নয়, কোন কিছুকেই পাত্তা দিলে ঝুলনের এখানে এসে পৌছোনো হত না। চাকদহ থেকে যে দৌড় শুরু হয়েছিল কলকাতার বিবেকানন্দ পার্ক হয়ে সে দৌড় এখনো চলছে। এবং চলছেই।

উরকেরি ভেঙ্কট রমন, ডব্লিউ ভি রামন – তাঁর খেলা আমি দেখেছি। ক্রিকেটার হিসেবে নেহায়েৎই মিডিওকার রমনের কোচ হিসেবে কিছু সুনাম আছে। বাংলা রঞ্জি দলের ও কোচ ছিলেন তিনি এবং এই তামিলের সম্বন্ধে একটি কথা ঘোরাফেরা করে বাংলা ক্রিকেট মহলে যে, তিনি অসম্ভব রকমের পারফেকশনিস্ট ছিলেন। সাফল্যের চাবিকাঠি একটাই বলে মনে করতেন তিনি। সেই শব্দের নাম পরিশ্রম। এবং সেই রমনও যার সম্বন্ধে বলছেন, ‘এক এক সময় ওর পরিশ্রম দেখে আমার ই ক্লান্তি লাগতো!’

চিন্তা করুন! একজন অতি খুঁতখুঁতে কোচ বলছেন এই কথা! এবং এবার আপনাকে চোখ মেলে তাকাতেই হবে পাঁচ ফুট এগারোর মেয়েটার দিকে। কিছুদিন আগেই ভারতের হারে তাঁর দিকে কিছুটা হলেও আঙুল উঠেছিল। শেষ ওভারে দু দুটি নো বল করেছিলেন তিনি। কিন্তু ওই যে বললাম ঝুলন গোস্বামী ওইসব আঙুল ওঠাকে পরোয়া করেনই নি কোনো দিন।

আর করেন না বলেই দু’দিন পরেই ভারতের জয়ে বড় ভূমিকা নিলেন। প্রথমে দশ ওভারে ৩৭ রান দিয়ে তিন উইকেট এবং পরে শেষ ওভারে চার মেরে ম‍্যাচ জেতানো। কিন্তু এতেও যে ওই পাঁচ ফুট এগারোর মেয়ে খুব আকাশে উড়ছেন, এমনটা ভাববেন না। ঝুলন এমনই সাফল্য বা ব‍্যর্থতা – কোনোটাই তেমন ছোঁয় না তাকে। তিনি শুধু নি:শব্দে পারফর্ম করেন।

চাকদহ থেকে কাঁধে বিশাল কিটব‍্যাগ ঝুলিয়ে শিয়ালদহ হয়ে বিবেকানন্দ পার্ক যেতো যে মেয়েটা, সে ২০০২ থেকে ২০২১ পর্যন্ত একটা স্বপ্নের দৌড় দিচ্ছে। আবার ও পড়ুন। ঊনিশ বছর! ঊনিশ বছর ধরে এই লেভেলে পারফর্ম করে যাচ্ছে একটা মেয়ে। নারী ক্রিকেট! তার দিকে আমরা তেমন তাকাবার সময়-টময় পেলাম কোথায়?

আর এখানেই ঝুলনের লড়াইটা কঠিন ছিল। সব ফোকাস টেনে নিয়েছে পুরুষদের ক্রিকেট। আর তিনি নীরবে নিজের দুশো ভাগ দিয়েছেন কারোর তোয়াক্কা না করেই। ভাবতে পারেন চাকদহের একটা মেয়ে সমসময়ের সবচেয়ে গতিশীল বোলারদের একজন! ক‍্যাথরিন ফিটজপ‍্যাটরিকের সঙ্গে তাঁর নামটাই উচ্চারিত হয় দ্রুততম হিসেবে। একটার পর একটা সাফল‍্য ছুঁয়েছে তাঁকে। বিশ্বের দ্রুততম নারী পেসার, আইসিসি’র বর্ষসেরা নারী ক্রিকেটার, সেরা অলরাউন্ডার, বিশ্বের সর্বোচ্চ উইকেটশিকারী -ওই যে প্রথমেই বললাম বাস্তব কল্পনাকেও ছাড়ায় কখনো কখনো।

আর ছাড়ায় চাকদার ঝুলন গোস্বামীর মত কারো কারোর জন্যই। গোটা জীবনটাই ক্রিকেট কে সঁপে দিয়েছেন মেয়েটা ।১৯৯৭ এ বেলিন্ডা ক্লার্ক কে দেখে যে মেয়েটা ক্রিকেটে ঝাঁপিয়েছিল , আজ সে এক ই সঙ্গে ভারতীয় দলের বোলিং পরামর্শ দাতা এবং খেলোয়াড়। গোটা ক‍্যারিয়ার জুড়ে ছশো এক উইকেট!

আমরা যারা জীবনে ডাহা ফেল মেরে সৃষ্টিকর্তার ওপর গোসা করে ঠোঁট ফোলাই, ভাগ‍্যের দোহাই দিই – ঝুলন গোস্বামী তাদের গালে একটা জোরালো থাপ্পড়। সাফল্য এমনি ধরা দেয় না। তাঁকে পাওয়ার জন্য নিজেকে নিংড়ে দিতে হয়। জীবনের বাকি সব ভালোলাগা, শখ-আহ্লাদ কে ছুঁড়ে ফেলে দিতে হয়।

ঝুলন দেখিয়েছেন। এবারে যখন ক্রমাগত হতাশা, ক্রমাগত ব‍্যর্থতা আপনাকে পেড়ে ফেলবে জীবনে তখন বাইরের কারোকে দেখে নিজেকে তাতাবার দরকার নেই। আমাদের ঘরের খুব কাছের চাকদহ’র মেয়েটাকেই দেখুন। অন্তত একবার আইপিএলের থেকে চোখ তুলে ওই পাঁচ ফুট এগারোকে কুর্নিশ করুন! অন্তত একবার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link