সাবধান, সামনে লিলি!

ডেনিস লিলি একেবারে আগাগোড়া ফাস্ট বোলার ছিলেন। ফিজিক্যাল স্টার্ডিনেসের সাথে মেন্টাল প্রাউয়েস ছিল। পিচ থেকে সুবিধা আদায় করতে পারতেন সব সময়। সিম-সুইং-বাউন্সার, লিলির ছিল সব। লিলির বিরুদ্ধে ব্যাটিং করাটা সব সময় চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ কিছু না কিছুর উদ্দেশ্য তাঁর আছেই। ব্যাটসম্যানকে রিলাক্সের সময়টা দিতেন না কখনোই। একজন ফাস্ট বোলারের কাছে আর কী চাওয়ার থাকতে পারে?

বিবিসি শার্লকের একটা এপিসোডের নাম হচ্ছে ‘a scandal in Belgravia’, ওই এপিসোডের শেষের দিকে একটা দৃশ্য আছে। আমার অনেক প্রিয় সেই দৃশ্যটি। শার্লক চরিত্রে অভিনয় করা বেনেডিক্ট কামারব্যাচ বলেছিলেন, ‘sentiment is a chemical defect found in losing side. I have always considered love is a dangerous disadvantage, thank you for the final proof.’

এই কথাগুলো শার্লক বলেছিলেন আইরিন অ্যাডলারকে। শার্লকের জীবনের লাভ ইন্টারেস্ট। কী কারণে বলেছিলেন তা বলব না। এই কারণে কেউ আমাকে মুফতি ইব্রাহিম ভাববেন না, জানি কিন্তু বলছি না। কাউকে স্পয়লার দেয়ার ইচ্ছা-শক্তি কোনোটাই আমার নেই। এই দৃশ্যের কথা বলেছিলাম কারণ দৃশ্যটা-সংলাপগুলো-মুহূর্তটা আমার অনেক পছন্দের।

সে রকম আরেকটি মুভি মুহূর্তের কথা বলতে হয়। আল পাচিনোর সেন্ট অফ আ ওমেন মুভির একটা মনোলগ। একইভাবে সেই দৃশ্য নিয়ে কিছু বলব না। অভিনেতা পাচিনোকে সবাই চেনেন। জীবনে অনেক মাস্টারক্লাস পারফরম্যান্স থাকার পরেও অস্কার ধরা দিচ্ছিল না তাঁর। শেষ পর্যন্ত এই সেন্ট অফ আ ওমেনের চরিত্র ফ্র্যাংক স্লেইডের হাতেই আসল পরম অধরা অস্কার। এটি আর শার্লক দুটিরই লিংক কমেন্টে দিব।এরপরে আপনারাই মিলিয়ে নিবেন কেন বলা।

গ্রাহাম ম্যাকেঞ্জির অবসরের পরে হঠাৎ করেই নখদর্পহীন হয়ে পড়ে অস্ট্রেলিয়ার পেস অ্যাটাক। তখন আবির্ভাব হয় ডেনিস লিলির। অনেক পেস ছিল তাঁর বোলিংয়ে। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়া স্টেট দলে খেলার সময় এটাই ছিল তাঁর পরিচয়।

‘বি’ দলের হয়ে খেলার পরে আচমকা ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ছয় নম্বর টেস্ট দলে জায়গা করে নিলেন। অভিষেকে পাঁচ উইকেট নিয়ে দিলেন আগমনী বার্তা। আসল ইন্ট্রোটা হয়েছিল বিশ্ব একাদশের বিপক্ষে। ৮ উইকেট পেয়েছিলেন। যে ব্যাটিং লাইন আপে এমন ধ্বস নামিয়েছিলেন সেখানে সোবার্স, লয়েড, গাভাস্কাররা ছিলেন।

পেসার ডেনিস লিলির রেকর্ড আছে অনেক। সেসব কিছু নিয়ে কিছুই লিখছি না। লিলিকে লেখার ইচ্ছা ছিল অনেক আগে থেকে। যেমনটা ইচ্ছা ছিল ভিভকে নিয়ে। আমার ক্রিকেটের স্মরণীয় মুহূর্তগুলোর মধ্যে শুরুর দিকেই থাকবে শোয়েব আখতারের যেকোন স্পেল। লি-ডোনাল্ড-টেইট-বন্ডদের নামও আসবে।

বুঝতেই পেরেছেন আক্রমনাত্নক পেসারদের আমি ভালবাসি। লিলি-থম্পসন-অ্যান্ডি রবার্টসদের খেলা দেখিনি কখনো। বিশেষ করে লম্বা চুল-মাথায় ব্যান্ড-গোফওয়ালা লিলিকে। লিলির একটা বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল। সহজে হারতে রাজী ছিল না। নেভার সে ডাই অ্যাটিচিউড।

একবার এক ম্যাচে টানা কয়েকটা ওয়াইড বল করলেন। বোলিং মার্কে যাবার সময় নিজেকেই বলতে লাগলেন, ‘come on Dennis, what is this?’

৭৪-৭৫ এর অ্যাশেজের সময় ইংলিশ ব্যাটসম্যান কিথ ফ্লেচার মাঠে নামছেন। লিলি তাঁকে শুভ কামনা জানালেন আর সাথে এটাও মনে করিয়ে দিলেন তাঁর এই গুড লাকের বেশ দরকার। পরে বোলিং করতে এসেই বাউন্সারে ফ্লেচারকে পাগলপ্রায় করে দিলেন।

লিলির বয়স তখন ৫০। পাকিস্তানের বিরুদ্ধে অস্ট্রেলিয়ার বোর্ড চেয়ারম্যান একাদশের হয়ে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলতে নামলেন। বোলিং পার্টনার হিসেবে পেলেন অ্যাডাম লিলিকে। হ্যাঁ,লিলির ছেলে। বাপ-বেটার বোলিং তোপে পাকিস্তান ম্যাচ হেরেছিল সেদিন। ৮-৪-৮-৩ এটা ছিল ডেনিস লিলির ফিগার আর ছেলের ছিল ৬-০-২৯-৩।

একটা ব্যাপারে লিলি অতুলনীয়।প্রত্যেকটা উপলক্ষ নিজের করে নিতে পারতেন। এই নিয়ে ডেভিড গাওয়ার বলেছিল, ‘what made Lilee so special was the element of theatre he brought to the occasion.’

বিশাল ক্রাউডের সামনে বোলিং করতে লিলি ভালবাসতেন। দর্শকরা তাঁর নাম চ্যান্ট করছে, এসব লিলি বেশ উপভোগ করতেন। ১৯৭৬ সালে ঘরোয়া টুর্নামেন্ট চলছে। কুইন্সল্যান্ডের হয়ে ব্যাট করছেন ভিভ রিচার্ডস। ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার হয়ে বল করছেন লিলি।

পরপর দুটো বাউন্সার এড়িয়ে গেলেন ভিভ। উষ্ণ আবহাওয়া না কি উত্তেজনার গরমে সোয়েটার খুলে আম্পায়ারকে দিলেন লিলি। পরের দুই বল ডিফেন্ড করলেন ভিভ। এর পরের বলে বোল্ড হলেন কিছু বুঝে ওঠার আগেই। লিলির একজন আর্টিস্ট বা অভিনেতার মতন ক্যারিজমা আর শোম্যানশিপ ছিল বেশ।

আশা করি, এবার বুঝতে পারলেন কেন শুরুতে শার্লক হোমস আর ফ্র্যাংক স্লেইডের কথা বলেছিলাম। হ্যাঁ,আমার কাছে লিলির পারফরম্যান্স বেনেডিক্ট কামারব্যাচ আর আল পাচিনোর মত অসাধারণ আর দর্শনীয়। মাঝে মধ্যে বিতর্কে জড়িয়ে পড়তেন। মিয়াঁদাদের সাথের ঘটনাটাই সবাই বলে থাকে।

কিন্তু, এরপরে আরেকবার মোকাবেলায় লিলির বাউন্সার পুল করতে গিয়ে মিস করেন মিয়াঁদাদ। মাথায় আঘাত পান।সবার আগে লিলি গিয়েই দু:খ প্রকাশ করেছিলেন। আফটার অল খেলাটা ভদ্রলোকের।

ডেনিস লিলি একেবারে আগাগোড়া ফাস্ট বোলার ছিলেন। ফিজিক্যাল স্টার্ডিনেসের সাথে মেন্টাল প্রাউয়েস ছিল। পিচ থেকে সুবিধা আদায় করতে পারতেন সব সময়। সিম-সুইং-বাউন্সার, লিলির ছিল সব। লিলির বিরুদ্ধে ব্যাটিং করাটা সবসময় চ্যালেঞ্জিং ছিল। কারণ কিছু না কিছুর উদ্দেশ্য তাঁর আছেই। ব্যাটসম্যানকে রিলাক্সের সময়টা দিতেন না কখনোই। একজন ফাস্ট বোলারের কাছে আর কী চাওয়ার থাকতে পারে?

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...