অজি বাস্তবতাও এক একটি রুপকথা

অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং শুরু হলো। মা তখনও আশা নিয়ে অপেক্ষায়। যদিও সেই আশার বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু, জগতে অলৌকিক কত কিছুই না ঘটে!

আড়াই মাস আগের গল্প। ব্লুমফন্টেইনে দক্ষিণ আফ্রিকা-অস্ট্রেলিয়া ম্যাচ। মার্নাস লাবুশেনের মা ছেলের খেলা দেখতে যাবেন। লাবুশেন আগেই মাকে জানিয়ে রাখলেন যে তিনি একাদশে নেই। ম্যাচের দিন তবু মা গ্যালারিতে হাজির। কারণ, মায়ের মন বলছে, ছেলে খেলবেই!

একাদশে না থাকলে কেউ কীভাবে খেলতে পারে! লাবুশেন মাকে বোঝালেন। মা তবু মাঠে রয়ে গেলেন। দক্ষিণ আফ্রিকা আগে ব্যাট করল। লাবুশেনের মা ওই সাড়ে তিন ঘণ্টা বসেই থাকলেন গ্যালারিতে। তার বিশ্বাস, কোনো না কোনোভাবে ছেলে হয়তো খেলবেন!

অস্ট্রেলিয়ার ব্যাটিং শুরু হলো। মা তখনও আশা নিয়ে অপেক্ষায়। যদিও সেই আশার বাস্তব কোনো ভিত্তি নেই। কিন্তু, জগতে অলৌকিক কত কিছুই না ঘটে!

অস্ট্রেলিয়ার ইনিংসের ষষ্ঠ ওভারে কাগিসো রাবাদার ১৪০ কিলোমিটার গতির বল ছোবল দিল ক্যামেরন গ্রিনের বাঁ কানের হেলমেটের ফ্ল্যাপে। গ্রিনের কানের পাশে ফুলে গেল, দু-এক ফোটা রক্তও বের হলো। তিনি মাঠের বাইরে চলে গেলেন। ‘কনকাশন সাব’ নিতে হবে। কাকে নেওয়া হলো? মার্নাস লাবুশেন!

লাবুশেন সেদিন সাত নম্বরে ব্যাটিংয়ে নেমে ৮০ রানের অসাধারণ এক অপরাজিত ইনিংস খেলে পরাজয়ের দুয়ার থেকে জয় এনে দেন অস্ট্রেলিয়াকে। ম্যান অব দা ম্যাচ হওয়ার পর মায়ের এই গল্পটি শুনিয়েছিলেন তিনি।

এই গল্পটি মনে করিয়ে দেওয়ার কারণ, সেদিনের ওই ৮০ রানের ইনিংসটি না খেললে লাবুশেন বিশ্বকাপ খেলতে পারতেন না।

কালকে ফাইনালের পর লাবুশেনের চোখের পানি দেখেছেন? আনন্দাশ্রু ওটা। গত কয়েক মাসে এত কিছু হয়ে গেছে তার জীবন আর ক্যারিয়ারে। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর সেই আবেগের উথালপাথাল ঢেউ সামলাতে পারেননি।

তিনি যেভাবে বিশ্বকাপ খেললেন, অলৌকিক বললেও কম বলা হয়। গত আগস্টে তিনি ওয়ানডে দল থেকে বাদ পড়েন। বিশ্বকাপের ১৫ জনের স্কোয়াড তো দূরের কথা, ১৮ জনের বিস্তৃত স্কোয়াডেও তিনি ছিলেন না। এমনকি সেপ্টেম্বরে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরের ওয়ানডে দলেও ছিলেন না। তাকে পাঠানো হয়েছিল অস্ট্রেলিয়া ‘এ’ দলের হয়ে নিউ জিল্যান্ড ‘এ’ দলের বিপক্ষে খেলতে।

এরপর স্টিভ স্মিথের চোটের খবর জানা গেল। বদলি হিসেবে লাবুশেনকে পাঠানো হলো দক্ষিণ আফ্রিকায়। প্রথম ম্যাচের একাদশে তিনি নেই। কিন্তু তার পরও গ্রিনের চোটের সুযোগে কনকাশন সাব হিসেবে নেমে ম্যাচ জিতিয়ে দিলেন।

পরের ম্যাচে একাদশেই ঠাঁই পেলেন। এবার খেললেন ৯৯ বলে ১২৪ রানের ইনিংস। তাতে লাভ কিছু হওয়ার কথা নয়। ততদিনে বিশ্বকাপ দল ঘোষিত হয়ে গেছে।

কিন্তু ওই যে, লাবুশেনকে বিশ্বকাপে নিতে গোটা দুনিয়া উঠেপড়ে লেগে গেছে! অ্যাশটন অ্যাগার চোটে পড়লেন। আর বিশ্বকাপের ঠিক আগে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডেতে ৫৮ বলে ৭২ রানের ইনিংস খেললেন লাবুশেন। ব্যস, পরদিনই অ্যাগারের বদলে বিশ্বকাপ দলে নেওয়া হলো লাবুশেনকে।

মানে, একজন স্পিনারের বদলে ব্যাটসম্যান! যার খেলার কথা ছিল ‘এ’ দলে, সেই লাবুশেন বিশ্বকাপে চলে গেলেন এবং বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়ার ১১ ম্যাচের সবকটিতে খেললেন।

ফাইনালে তাকে না খেলানোর আলোচনা ছিল। ম্যাচের আগের দিন অধিনায়ক প্যাট কামিন্স ইঙ্গিতও দিয়েছিলেন, বোলিংয়ের বিকল্প বাড়াতে মার্কাস স্টয়নিসকে খেলানোর ভাবনা তাদের আছে। লাবুশেন নিজেও কিছুটা দুর্ভাবনায় ছিলেন। ফাইনালের আগের রাতে ১০ টা ১০ মিনিট পর্যন্ত একাদশ ঘোষণা করা হয়নি।

তাঁর মন দুরু দুরু করছিল। শেষ পর্যন্ত অস্ট্রেলিয়া তাকেই রাখল একাদশে এবং ফাইনালে তিনি প্রতিদান দিলেন দলের আস্থার। ১১০ বলে ৫৮ রানের ইনিংসও যে এই যুগের ওয়ানডেতে অচল নয়, বরং পারিপার্শ্বিকতা মিলে গেলে এমন ইনিংসও দলের জয়ের ভূমিকা রাখতে পারে, তা দেখা গেল।

এই আড়াই মাসের আশ্চর্য ভ্রমণ লাবুশেনের নিজের কাছেও অবিশ্বাস্য লাগছে। ফাইনাল শেষে কান্নার দমকে ধরে আসা গলায় তিনি বলেছেন, ‘আপনারা জানেন যে, আমি বিশ্বাসী একজন, ইশ্বরে অগাধ বিশ্বাস আমার। তারপরও যেভাবে সবকিছু হয়েছে আমার সঙ্গে, বিশ্বাস করতে পারছি না। সবকিছু অসাধারণ, আমি ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। কতবার যে মনে হয়েছে আমার সম্ভাবনা শেষ! তার পর আবার কীভাবে কীভাবে যেন সুযোগ এসেছে। দুই মাস আগে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে আমি এমনকি ওয়ানডে দলেই ছিলাম না। সেখান থেকে টানা ১৯টি ম্যাচ খেলা সত্যিই অলৌকিক ব্যাপার।’

ট্রাভিস হেডের বিশ্বকাপ খেলাও কম অলৌকিক নয়। লাবুশেনের ঘটনার এই দক্ষিণ আফ্রিকা সফরেই জেরল্ড কুটসিয়ার একটি ডেলিভারি আঘাত করে তার বাঁ হাতে। এরপর একটু ব্যাটিংয়ে চেষ্টা করেও পারেননি। মাঠ ছেড়ে যান। পরে স্ক্যানে ধরা পড়ে চিড়। অস্ট্রেলিয়ার টিম ম্যানেজমেন্ট ধরে নিয়েছিল, হেডের বিশ্বকাপ শেষ।

কিন্তু কোচ অ্যান্ড্রু ম্যাকডোনাল্ডের মন মানতে চায় না। নির্ঘুম রাত কাটে তার। প্রাথমিক পর্বের অর্ধেক ম্যাচে নিশ্চিতভাবেই পাওয়া যাবে না হেডকে। এরকম একজনকে দলে রাখা তো অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট সংস্কৃতির সঙ্গে ঠিক যায় না। কিন্তু ম্যাকডোনাল্ড অনুভব করেন, হেডকে তার লাগবেই।

পরদিন তিনি অধিনায়ক প্যাট কামিন্সের কাছে গিয়ে বলেন, ‘রাতে ঘুমাতে পারিনি, আমার মনে হয়, আমরা ট্রাভকে (হেড) বিশ্বকাপ দলে রেখে দিচ্ছি, ঝুঁকিটা নিতে চাই। হয়তো নেদারল্যান্ডস ম্যাচ নাগাদ সে প্রস্তুত হয় যাবে। আর আমরা যদি ফাইনাল খেলি ও বিশ্বকাপ জিততে চাই, তাহলে ফাইনালে ওকে লাগবে।’

অস্ট্রেলিয়া যখন বিশ্বকাপ খেলতে ভারতে যায়, হেড তখন দেশে রিহ্যাব করছেন। অস্ট্রেলিয়া যখন বিশ্বকাপে তৃতীয় ম্যাচ খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছে, হেড তখন চোটের পর প্রথমবার নেটে ব্যাট করছেন। গত ১৫ অক্টোবর। দিন তিনেক নেটে ব্যাটিং করে তিনি দলের সঙ্গে ভারতে যোগ দেন গত ১৯ অক্টোবর। খেয়াল করে দেখুন, ফাইনালের ঠিক এক মাস আগে।

ভারতের যাওয়ার পরও দুটি ম্যাচ বসে থাকতে হয় তাকে। নেদারল্যান্ডস ম্যাচেরও জন্যও ঠিক প্রস্তুত হয়ে উঠতে পারেননি। মানে প্রাথমিক পর্বের ৯ ম্যাচের ৫টিই শেষ। তবুও দল তার পাশে থেকেছে। মিচেল মার্শ ওপেন করে বিধ্বংসী সেঞ্চুরি করেছেন পাকিস্তানের বিপক্ষে। কিন্তু কোচ স্পষ্ট বলে দিয়েছেন, হেড ফিট হয়ে উঠলেই সরাসরি একাদশে ঢুকবে এবং ওপেনই করবে। ওই ক্রিকেটারের আত্মবিশ্বাস তাহলে কতটা বেড়ে যায়!

সেই আত্মবিশ্বাসের প্রতিফলনই পড়ল নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে। বিশ্বকাপে প্রথম খেলতে নেমে ৬৭ বলে ১০৭ রানের ইনিংস খেলে তিনি ম্যাচ সেরা। এরপর তিন ম্যাচে ব্যর্থ হলেও আসল সময়ে ঠিকই জ্বলে উঠলেন। সেমি-ফাইনালে দুর্দান্ত অলরাউন্ড পারফরম্যান্সে ম্যান অব দা ম্যাচ। ফাইনালে তিনি কী করেছেন, সবারই জানা।

ভেবে দেখুন, একজন ক্রিকেটারের ওপর কতটা ভরসা থাকলে দুই মাস আগেই কোচ বলতে পারেন যে, বিশ্বকাপের ফাইনাল জিততে ওকে আমার লাগবে! সেই ক্রিকেটারও কতটা দুর্দান্ত যে, কোচের ভরসার প্রতিদান এতটা দারুণভাবে দেন!

এই লাবুশেন, এই হেড – তাদের গল্প কেমন রূপকথার মতো লাগে না! আসলে সবই হলো অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটের গভীরতা। তাদের পরিকল্পনা, তাদের ভাবনার ধরন। অ্যাগারের বদলে তারা যখন লাবুশেনকে নেন, তার মানে তাদের পরিকল্পনায় বদল এসেছে।

বিশ্বকাপের আগে ভারতে সিরিজটি খেলে তারা বুঝতে পেরেছিলেন, বাড়তি একজন ব্যাটসম্যান লাগতে পারে। বাড়তি স্পিনারের কাজটি গ্লেন ম্যাক্সওয়েলই চালিয়ে নেবেন। পরে হেড ফিট হলে স্পিনে হাত লাগাবেন। হেডকে যখন এত বড় ঝুঁকি নিয়ে রেখে দেওয়া হয়, এর মানে, তার মধ্যে বিশেষ কিছু দেখে দল, একটা এক্স-ফ্যাক্টর বা বড় ম্যাচের পারফর্মার, এরকম আরও অনেক ক্রিকেটীয় যুক্তি থাকে।

হ্যাঁ, পরিকল্পনা সব দলই করে। তবে অস্ট্রেলিয়ানরা বাস্তবায়ন করতে পারেন। তাদের সেই সিস্টেম, সেই সংস্কৃতি, সেই সামর্থ্য, সেই বিশ্বাস, সেই মানসিকতা আছে। এই সবকিছু আছে বলে তাদের বাস্তবকেও আমাদের রূপকথা মনে হয়।

– ফেসবুক থেকে

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...