ভিভ-ডন হতে পারতেন, হয়েছেন জিমি অ্যাডামস

ক্রিকেটটা যেখানে এক উৎসবের মত। যেখানে ক্রিকেট নিয়ে মেতে থাকেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল। সেই জ্যামাইকার সেন্ট ম্যারিতে এক ডাক্তার দম্পতির ঘরে জন্ম নেন জিমি অ্যাডামস। বাবা-মা ডাক্তার হলেও অ্যাডামস বেড়ে উঠছিলেন জ্যামাইকার আর বাকি ছেলে-মেয়েদের মতই। খেলাটাই যার কাছে ছিল প্রাণ।

এই জিমি অ্যাডামসই পরবর্তীকালে খেলেছিলেন ভিভ রিচার্ডসের জায়গায়, ক্যারিয়ারের একটা সময় খোঁচা দিয়েছিলেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকেও। একেবারে বাঁ-হাতি, ক্লিনিক্যাল ব্যাটার। দুপায়ের কাজে ছিলেন নিজের সময়ের সেরাদের একজন, সোজা ব্যাটে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসেই রাজত্ব করেছিলেন।

তবে তাঁর ক্যারিয়ারটা এক দুর্ঘটনায় বাক নিয়েছিল। শুরুটা যেভাবে করেছিলেন, শেষটায় তা স্পর্শ করতে পারেননি। একটা সময় পরে কেমন থমকে গিয়েছিলেন। তাই তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারটাকে ক্রিকেট গুরুরা দু’ভাগে ভাগ করার পরামর্শ দেন।

প্রথম ভাগে অবিশ্বাস্য এক ব্যাটসম্যান। স্যার ভিভ রিচার্ডসের যোগ্য উত্তরসূরি, স্যার ডন ব্র্যাডম্যানকেও ছুঁয়ে ফেলার আকুতি। আর পরের ভাগে শুধুই একজন ব্যাটসম্যান, সাধারন একজন অধিনায়ক, ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে আর দশটা ক্রিকেটার যেমন খেলেন। অথচ এই জিমি অ্যাডামসই ক্রিকেট মাঠের এক দুর্ঘটনার আগে ছিলেন অপ্রতিরোদ্ধ এক ব্যাটসম্যান।

জিমি অ্যাডামসের খেলাধুলার শুরুটা হয়েছিল সেই স্কুল থেকেই। শুধু ক্রিকেট না, ফুটবলও খেলেছেন সমানতালে। তবে ৮ বছর বয়সে তাঁর বাবা একদিন নিয়ে গেলেন টেস্ট ম্যাচ দেখতে। কিংস্টনে সাদা পোশাকের ক্রিকেটে ভারত ও ওয়েস্ট ইন্ডিজের লড়াই। সেই যেন প্রথম ক্রিকেট খেলাটার প্রেমে পড়ে গেলেন। এরপর থেকে জিমির ধ্যান-জ্ঞান সবকিছুতেই শুধু ক্রিকেট।

অবশ্য ক্রিকেটকে বেঁছে নেয়ার পেছনে আরো একটি কারণও ছিল। সেই সময় জ্যামাইকান ক্রিকেটের কোচ ছিলেন কিংবদন্তি রোহান কাহ্নাই। সেই সময় প্রায়ই ক্যাম্প থেকে ফুটবল খেলতে স্কুলে চলে যেতেন। তবে কোচ কড়া হুশিয়ারি দিয়েছিলেন। তাঁর ক্যাম্পে এমন আসা যাওয়া চলবে না। খেললে খেলার মত খেলতে হবে। সেই থেকেই ফুটবলের বুট জোড়া তুলে রাখলেন আলমারিতে, কেডস পরে এরপর শুধুই ছুটে চলা বাইশ গজের দিকে।

১৯৯২ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে অভিষিক্ত হলেন। দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই ম্যাচে নামলেন সদ্য অবসরে যাওয়া স্যার ভিভ রিচার্ডসের জায়গায়। ফলে আশাটা অনেক বড় ছিল। তবে যত বড় আশা ছিল জিমি শুরু করেছিলেন আরো বড় করে। কেউ স্বপ্নেও বোধহয় এমন শুরু কল্পনা করার সাহস করে না।

দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে সেই টেস্টে প্রথম ইনিংসে বল হাতে নিলেন ৪ উইকেট। দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাট হাতে অপরাজিত ৭৯ রানের ইনিংস। তাঁর ব্যাটে-বলে সেই পারফর্মেন্সেই পরে ৫২ রানের জয় পায় ক্যারিবীয়রা। এরপর আর কখনো পিছন ফিরে তাকাননি। ক্যারিয়ারের প্রথম ১২ টেস্টে রান করেছেন প্রায় ৮৭ গড়ে। হ্যাঁ, ঠিকই পড়েছেন, সংখ্যাটা ৮৭!

প্রথম ১২ টেস্টে ৮৭ ব্যাটিং গড় নিয়ে করেছিলেন ১১৩২ রান। প্রথম ১২ টেস্টে এই কীর্তি ক্রিকেট দুনিয়ার আর শুধু করতে পেরেছিলেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যানই। তবে এরপরই জিমি বিশাল এক ধাক্কা খেয়েছিলেন। ১৯৯৫ সালে গিয়েছিলেন ইংল্যান্ড সফরে। সেখানে এক ম্যাচে আসা বাউন্সার এসে লাগে ঠিক জিমি অ্যাডামসের চোখের নিচে।

চিকবোনে আঘাত করা সেই বল যেন শরীরটাকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলছিল। ধারণা করা হয় সেই এক আঘাতেই নিজের আত্মবিশ্বাসটা হারিয়ে ফেলেছিলেন জিমি অ্যাডামস। আর কখনো নিজের চেনা রূপে ফিরতে পারেননি। ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ভাগে রান করেছিলেন মাত্র ২৫.৫৮ গড়ে।

এরপর ১৯৯৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকা সফরে এক রহস্যময় ইনজুরিতে পড়েছিলেন। বিমানে যাওয়ার সময় ব্রেড কাটতে গিয়ে নাকি ছুরি দিয়ে নিজের হাতই কেটে ফেলেছিলেন। পরে ওই সিরিজে আর মাঠেই নামা হয়নি।

তবুও ক্যারিয়ারের শেষ দিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ তাঁকে অধিনায়কত্বের দায়িত্ব তুলে দিয়েছিল। ব্রায়ান লারার কাছ থেকে তুলে নিয়েছিলেন অধিনায়কত্ব। তবে অধিনায়কত্ব পর্বটা একেবারেই ভাল ছিল না। অজিদের কাছে ৫-০ ব্যবধানে সিরিজ হেরেছিলেন। এরপর অধিনায়কত্ব ও দলে জায়গা দুটোই হারিয়েছিলেন।

২০০১ সালে তাঁর আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শেষ হওয়ার আগে ক্যারিবীয়দের হয়ে মোট ৫৪ টি টেস্ট খেলেছিলেন। সেখানে ৪১.২৬ গড়ে সর্বোচ্চ ২০৮ রানের ইনিংসসহ করেছিলেন ৩০১২ রান। আর বল হাতে একবার পাঁচ উইকেটসহ নিয়েছিলেন ২৭ উইকেট। এছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের হয়ে ১২৭ টি ওয়ানডে ম্যাচও খেলেছেন। ওয়ানডে ক্যারিয়ারটা বলার মত না হলেও সেখানেও ২২০০’র ওপর রান করেছেন, উইকেট নিয়েছেন ৪৩ টি। উইকেরক্ষকও ছিলেন একটা সময়।

২০০১ সালে প্রায় এক দশকের আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার থেমে যাওয়ার পরও নানাভাবে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটের সাথে জড়িয়ে ছিলেন। কখনো ম্যানেজার, কখনো আবার প্রশাসনে। এখনো বিভিন্ন ক্লাবের কোচিং করান। তবে আফসোস একটাই।

জিমি অ্যাডামস কখনো ছুঁয়েছেন ডন ব্র্যাডম্যানকে, কখনো ভিভ রিচার্ডস আবার কখনো ব্রায়ান লারাকেও। তবে শেষ পর্যন্ত জিমি অ্যাডামস হয়ে ফোঁটা হল না তাঁর। না হলে হয়তো ক্রিকেট বইয়ের পাতায় যোগ হত আরো এক কিংবদন্তির নাম।

লেখক পরিচিতি

আমার ডায়েরির প্রতিটা পৃষ্ঠাই আমার বাইশ গজ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link