জাতিগত ভাবে তিনি গ্রিক। পূর্বপুরুষ ছিল গ্রিসের মানুষ। তাঁর চেহারা ও নামও সেই কথা বলে। আবার জন্ম হল মিশরে।
এই যার জন্ম ও বংশ পরিচয় – সেখানে কাউকে ভবিষ্যতের বড় ক্রিকেটার হিসেবে কল্পনা করা যায় না। কিংবা মিশরের সাথে ক্রিকেটের কোনো সম্পর্কও পাওয়া যায় না।
আসলে মিশরের সাথে ক্রিকেটেরই শুধু না, টেস্ট ক্রিকেটের সম্পর্ক তৈরি হয়েছে সেই ১৯৪৭ সালে। কারণ সেবছরই নীল নদের পূর্বপাশের শহর যাগাযিগে জন্ম হয় ক্রিকেটের বিশ্বনাগরিকের। মিশরে জন্ম নেওয়া প্রথম ও একমাত্র টেস্ট ক্রিকেটার তিনি।
কল্পনার অতীত সেই কাজটা করেছিলেন জন ট্রাইকোস, পুরো নাম অ্যাথানাসিওস জন ট্রাইকোস। তিনি ক্রিকেটার হতে পেরেছেন কারণ তাঁর বেড়ে ওঠা দক্ষিণ আফ্রিকায়।
জন টাইকোসকে ক্রিকেট মনে রাখবেই। কারণ, জিম্বাবুয়ের হয়ে তাঁদের অভিষেক টেস্ট ম্যাচে পাঁচ উইকেট নেন এই অফ স্পিনার। এই কীর্তিটা কেবল অভিষিক্ত বলে না, আরো একটা কারণে বিখ্যাত। কারণ, এই কীর্তি গড়ার দিন ট্রাইকোসের বয়স ৪৫ বছর ১৫৪ দিন।
সেদিন ৫০ ওভারে ১৬ টা মেইডেন নিয়েছিলেন। রান দেন মাত্র ৮৬ টি। পাঁচটা উইকেটের মধ্যে একটা ছিল শচীন টেন্ডুলকারের। তাও শচীন মাত্র তিন বল খেলে কট অ্যান্ড বোল্ড হয়ে সাজঘরে ফিরেন। তাঁর চেয়ে বুড়ো বয়সে টেস্টের এক ইনিংসে পাঁচ উইকেট কিংবা তাঁর বেশি পেয়েছেন কেবল মাত্র দু’জন।
মজার ব্যাপার হল, দলের আর সবার অভিষেক টেস্ট হলেও জন ট্রাইকোসের ছিল সেটি চতুর্থ টেস্ট। তাঁর টেস্ট অভিষেক হয় আরো ২২ বছর ২২২ দিন আগে, দক্ষিণ আফ্রিকার হয়ে। দুই টেস্টের মধ্যে এই বিরাট পার্থক্য এর আগে পরে আর কখনোই দেখা যায়নি। ১৯৬৯-৭০ মৌসুমে দক্ষিণ আফ্রিকা দলের হয়ে তিনটি টেস্ট খেলেন তিনি।
অভিষেক হয় মাত্র ২২ বছর বয়সে। বুক ভরা স্বপ্ন। খুব আহামরী পারফরম্যান্স না থাকলেও সম্ভাবনা ছিল। তবে, একটা ঝড় এসে সব ভেঙে দিয়ে গেল।
দক্ষিণ আফ্রিকা নিষেধাজ্ঞায় পড়ায় টেস্ট ক্যারিয়ার থেমে যায়। তিনি চলে আসেন জিম্বাবুয়েতে। সেসময় জিম্বাবুয়ের নাম ছিল রোডেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকার একটি প্রদেশ। জিম্বাবুয়ে যখন টেস্ট স্ট্যাটাস পায় সে সময় এতো বুড়ো বয়সেও দেশের সেরা স্পিনার ছিলেন তিনি।
নাহ জিম্বাবুয়েতে পুরোটা সময় তিনি ক্রিকেটকে দেননি। জিম্বাবুয়ের হয়ে টেস্ট ক্রিকেটে মাঠে নামার আগেই তিনি দীর্ঘ ১৫ বছর আইনজীবী হিসেবে কাজ করে ফেলেছেন। এর আগে চার বছর তিনি স্কুল শিক্ষক হিসেবে কাজ করেন। ১৯৯০ সালে কর্পোরেট আইনজীবী হিসেবে কাজ শুরু করেন। একটা তামাকজাত প্রতিষ্ঠানের লিগ্যাল কাউন্সেল ছিলেন।
১৯৯৮ সালে তিনি পরিবার নিয়ে চলে আসেন অস্ট্রেলিয়াতে। রাজনৈতিক ঘোলাটে পরিস্থিতিতে জিম্বাবুয়েতে টিকতে পারেননি তিনি। এরপর থেকে ওয়েস্টার্ন অস্ট্রেলিয়ার মাইনিঙ অ্যান্ড রিসোর্স কোম্পানিতে চাকরি করেছেন। পাশাপাশি পার্থের ক্লাব ক্রিকেটে নিজেকে কোরিংয়ের সাথে জড়িয়েছেন। গ্রিস, মিশর, দক্ষিণ আফ্রিকা ও জিম্বাবুয়ের পর তাঁর ক্রিকেটীয় যাত্রায় যোগ হল আরেকটি নাম।
সাত টেস্টে ১৮ উইকেট, ২৭ ওয়ানডেতে ১৯ টি উইকেট – এটুকু দিয়ে তাঁর প্রতি আবেগতাড়িত হওয়ার কিছু নেই। তবে, জন ট্রাইকোসের ক্রিকেটীয় যাত্রাটা পরিসংখ্যান ছাপিয়েও সত্যিই অবিশ্বাস্য।
জন ট্রাইকোস প্রথম যখন টেস্ট খেলেন, তখন ক্রিকেটে ওয়ানডের অস্তিত্বই ছিল না। কিন্তু, যখন ক্যারিয়ারের চতুর্থ টেস্ট খেলতে নামেন – ততদিনে ওয়ানডে ক্রিকেটের পাঁচটা বিশ্বকাপ হয়ে গেছে। ওয়ানডে ক্রিকেটও সাদা পোশাক থেকে রঙিন পোশাকের যুগে প্রবেশ করে ফেলেছে। ট্রাইকোস নিজেও সেই যাত্রার সাক্ষী। ১৯৮৩ থেকে ১৯৯২- তিনটি বিশ্বকাপ খেলেন তিনি।
ট্রাইকোসের এই গল্পে শচীনও আছেন। প্রথমত, আগেই তো জানানো হয়েছে যে ট্রাইকোস জিম্বাবুয়ের হয়ে টেস্টে প্রথম পান শচীনের উইকেট। ১৯৯২ বিশ্বকাপে দু’জনই ছিলেন। শচীন ছিলেন বিশ্বকাপের সবচেয়ে তরুণ ক্রিকেটার। আর ট্রাইকোস ছিলেন সবচেয়ে বৃদ্ধ। শুধু তাই নয়, নেদারল্যান্ডসের নোলান ক্লার্কের পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এই ট্রাইকোসই ওয়ানডে ক্রিকেটের সবচেয়ে বয়স্ক ক্রিকেটার।
এর আগে ১৯৮৭ সালে ভারতের মাটিতে বিশ্বকাপ খেলে জিম্বাবুয়ে। সেবার জিম্বাবুয়ে যখন ভারতের বিপক্ষে অধিনায়ক হিসেবে মাঠে নামেন তখন শচীন ছিলেন বল বয়!
শচীনের সাথে যার নাম জড়ানো, তাঁকে কি আর চাইলেই ভোলা যায়!