এতদিনে তো আপনি জেনেই গেছেন যে, শচীন রমেশ টেন্ডুলকারের টেস্টে চতুর্থ ইনিংসের গড় হাস্যকর। বহুদেশীয় টুর্নামেন্টের ফাইনালে দেশকে ম্যাচ জেতানোর রেকর্ডও শোচনীয়। তাঁর ট্রিপল সেঞ্চুরি নেই, শতাব্দী সেরা টেস্ট ইনিংস নেই, একা-কুম্ভের ম্যাচ বাঁচানো/জেতানো ২৭৭ বা ২৮১ও নেই। এতদিনে তথ্য বিশ্লেষণের ফলে আপনার সামনে প্রকাশিত হয়েছে যে শচীন টেস্টে সানি-ভিভ-লারা নন, ওয়ানডেতে ভিভ-কোহলি-গিলক্রিস্ট নন আর মাত্র ৫৩ গড় নিয়ে ডন ব্র্যাডম্যানের উত্তরসূরি তো কখনোই নন।
এর পাশাপাশি, এতদিনে আপনার এ-ও জানতে বাকি নেই যে শচীনকে স্কোরবোর্ডে খুঁজতে যাওয়া নাকি মূর্খতা । আমরা যারা ৮০-র দশকে জন্মেছি, যারা ৯০-এ ক্রিকেট দেখতে ও খেলতে শুরু করেছি, যাদের ভাঁড়ারে ৭১-এর সানি, ৭৮-এর কপিল এমন কী ৮৫-র আজহারও নেই – যাদের ব্র্যান্ডেড টিন-এজ, স্লিক পিজ্জা-হাট বা উইকেন্ড হ্যাং-আউট নেই, তাদের থাকার মধ্যে ছিল এক শচীন টেন্ডুলকার। ইনিয়ে-বিনিয়ে করা ভাবালু বহু পোস্টে কতবার কতরকম ভাবেই তো বলা হয়ে গেছে, কেন শচীন টেণ্ডুলকরকে শুধু ক্রিকেটের মাঠ দিয়ে মাপা যাবে না।
নিজের জীবনের হাফ-সেঞ্চুরি পূর্ণ করা, খর্বকায়, সদা-হাস্যমুখ ভারতরত্ন শচীন টেন্ডুলকার সম্বন্ধে আমি, যার ক্রিকেটের দৌড় পাড়ার মাঠ পর্যন্ত আর লেখার দৌড় ফেসবুক পর্যন্ত – সে আর কীই বা লিখতে পারি, যা কেউ জানেন না, যা আগে লেখা হয়নি?
কিস্যু না, কিস্যুমাত্র না। তাই, আমার ক্রিকেট-যাপনের ৭০% জুড়ে থাকা মানুষটার বিশ্বকাপ জেতা নিয়ে আমি কিছু লিখিনি। লিখিনি তাঁর বহুলচর্চিত রিটায়ারমেন্ট নিয়েও। ছেলেকে কোলে করে টিভির সামনে বসে হাপুসনয়নে কেঁদে একশা করলেও, কোথাও লিখিনি, শচীন টেন্ডুলকার আমার কাছে, আমার মতো অগুনতি নিতান্ত সাধারণ পাড়াগেঁয়ে ছোকরার কাছে কী এবং কতটা। জানতাম, আমার চেয়ে যোগ্যতর লোকজন কোথাও তা লিপিবদ্ধ করে রাখছেন ঠিকই।
তাহলে আজ কেন? ফুটেজ একটা কারণ তো বটেই, সে তো অনস্বীকার্য। এই লেখার সঙ্গে একটা ছবি জুড়ে দিতে পারলেই অন্তত গোটা-পঞ্চাশেক লাইক বাঁধা; আমার যা গড় রিচ, তাতে ওটাই জ্যাকপটের সমান। তবে, সেটাই একমাত্র কারণ নয়। এ ছাড়াও একটা কারণ আছে।
শুনেছি শচীন এখন অবসরপ্রাপ্ত। আগের চেয়ে একটু হলেও বেশি সময় পান নিশ্চয়ই। মনে হল, বাতাসে ভাসিয়ে রাখি কথাগুলো। যদি চোখে পড়ে যায়, যদি কেউ পড়ে শোনায় (হ্যাঁ, চূড়ান্ত উইশফুল থিংকিং)— অন্তত এটুকু বুঝবেন যে কেউ একজন তাঁকে…
শচীন এ যাবৎ জীবনে সেই সব কিছু পেয়েছেন যা একটা মানুষ স্বপ্ন দেখতে পারে। সাফল্য, খ্যাতি, যশ, অর্থ, সম্মান – সব, সঅঅঅঅঅঅব! কিন্তু কেমন যেন মনে হয়, যদি কেউ একান্তে শচীনকে জিজ্ঞাসা করেন, এর মধ্যে কোন পাওয়াতে আপনি সবচেয়ে বেশি খুশি হয়েছেন (হ্যাঁ, বলে দিতে হবে যে উত্তরটা কোনোদিনও মিডিয়ায় বেরোবে না, না হলে বোরিং, ফেব্রিকেটেড উত্তর পাবেন), হয়তো উনি বলবেন, বারো থেকে চল্লিশ… এই আড়াই যুগ ধরে ব্যাটিং করে যেতে পেরে।
আমার জ্ঞানত, আমার বোধবুদ্ধিতে আমি অন্য কোনো ক্রিকেটার দেখিনি যে নিজের কাজটা করতে এতটা, এই পরিমাণে ভালোবাসে! শচীন শুধু ব্যাটিং করতে, করে যেতেই ভালোবাসতেন না, সেই ভালোবাসা যত দিন গেছে একটা অবসেশনের পর্যায়ে চলে গেছে। ব্যাটিং করতে না পারলে অখুশি, ব্যাটিংয়ের সুযোগ না পেলেই ক্ষোভ, কোনো সময়েই পর্যাপ্ত ব্যাটিং করা হল বলে মনে করে সন্তুষ্ট না হওয়া— এ লক্ষণ ওর কেরিয়ার জুড়ে ফুটে বেরিয়েছে। মুলতানের কুখ্যাত ১৯৪* ডিক্লারেশন নিয়ে এত নিউজপ্রিন্ট খরচ হয়; শচীনের উষ্মা-প্রকাশ নিয়ে স.মালোচনাও তো নেহাত কম হয়নি (হওয়া উচিতও)— তবে ব্যক্তিগতভাবে আমার মনে হয়, ওটা ১৯৪* না হয়ে ২১৪* হলেও শচীন একই রকম অখুশি হতেন। কারণ, ব্যাটিং ছেড়ে আসতে তাঁর কোনোদিনই ভাল লাগেনি।
ঠিকঠাক কৈশোরে পৌঁছনোর আগেই হাতে ব্যাট উঠেছিল; আর তার কিছুদিনের মধ্যেই বালক-প্রতিভাটি বুঝে গিয়েছিল এই ব্যাট হাতে থাকলে সে জীবনের বহু প্রতিকূলতাকে থমকে দিতে, এড়িয়ে যেতে, বিলম্বিত করতে পারে। সে তো অন্য কিছু শেখেনি। অ্যাকাডেমিকসের পালিশ পড়েনি তার ব্যক্তিত্বে, রোম্যান্সের জটিলতা বা আবেগ সামলাতে যে পরিণতি প্রয়োজন সেও তার মধ্যে অনুপস্থিত। সে সাহসী নয়, সপ্রতিভ নয়, বাগ্মী নয়, রূপবান নয়, কিচ্ছু নয়। তাই এইসব অস্ত্র কাজে লাগিয়ে জীবনের বিভিন্ন সময়ে যে বিভিন্ন ছোট-বড় লড়াই জেতা যায়, সাধারণ মানুষ জিতে থাকে, সে সব তার আয়ত্তের বাইরে।
সে বুঝে গেছিল সে শুধু ব্যাট করতে পারে। আর যতক্ষণ সে ব্যাট করে ততক্ষণ বয়:সন্ধির হতাশা, যৌবনের রিরংসা, জীবনের কুটিল-প্যাঁচালো-ধারালো-ছদ্মবেশী সব হেয়ারপিন কার্ভ, সব ঘাসে ঢাকা গর্তও থমকে থাকে। শুধু বাইরের শত্রু না, মনের ভিতরের যে শত্রুগুলি, খ্যাতির মোহ, ক্ষমতার আকাঙ্ক্ষা, পরশ্রীকাতরতা— যতক্ষণ ব্যাট তার হাতে আছে, ততক্ষণই সে এদের মোকাবিলা করতে, এদের ঠেকিয়ে রাখতে, এদের দূরে সরিয়ে রাখতে সক্ষম। সেটাই তার একমাত্র রাস্তা, সেটাই তার একমাত্র প্রতিরোধ।
তাই সে সারাজীবন, কখনো, কোথাও এক মুহূর্তের জন্যও ব্যাট করা থামাতে চায়নি। নিজের ব্যাটিংয়ের চেয়ে প্রিয় তার কাছে আর কিছুই নেই, কিছুই ছিল না কোনোদিনও। এই একমুখী উন্মাদপ্রায় ব্যাটিং-অভিলাষের ফলে তাঁকে সময়-সময় আত্মকেন্দ্রিক, স্বার্থপরও মনে হয়েছে, মনে হচ্ছে। সৌরভ যখন বলেছেন তাঁদের ‘বাসু-স্যারের’ কোচিংএ শচীনের নেট ছেড়ে বেরোতে না চাওয়ার কথা, যখন আজহার-প্রভাকর শুনিয়েছেন এমন কী ইন্ডিয়া টিমেও নেটে ব্যাটিং থেকে প্রায় টেনে বের করে আনার কথা, যখন সরাসরি অবসরোত্তর তাঁর মুখেও শোনা গেছে ইউটিউবে তাঁর নিজের ব্যাটিংয়ের ভিডিও দেখতে ভাল লাগার কথা, তখন মনে হয়েছে এই পর্যায়ের নার্সিসিস্টিক, নিজের ব্যাটিংকে এমন ঘোরগ্রস্তের মতো ভালোবাসা কাউকে আর কোনোদিনও দেখব না আমরা।
সমসাময়িক অন্য কোনো জিনিয়াসের ‘ইনটেনশন’ নিয়ে এই পর্যায়ের কাটাছেঁড়া হয়েছে বলে মনে পড়ে না। লোকে প্রশ্ন তুলতে শুরু করেছে তাঁর সেঞ্চুরির আগে স্লো হয়ে যাওয়া নিয়ে। তাঁর ২০০৩ পরবর্তী ঝুঁকিহীন রান-কুড়োনোর মানসিকতা নিয়ে, বারংবার ওডিআইতে ওপেনিং ছাড়া আর কোথাও না যেতে চাওয়ার অনমনীয় জেদ নিয়ে, টিমে জায়গা আঁকড়ে পড়ে থেকে একশো সেঞ্চুরি করার লোভ নিয়ে উঠতে থাকা ইতিউতি দুর্বল স্বরগুলো জোরালো হতে শুরু করেছে সময়ের সঙ্গে-সঙ্গে – সে সব কি তাঁর নজর এড়িয়ে যায়? হতেই পারে না।
নজরেও পড়ে, আক্রান্ত অনুভবও করেন, ক্ষতবিক্ষতও হন। কিন্তু অসহায়ের মতো নিশ্চয়ই চির-অভ্যাসবশত ব্যাটটা তুলে নিতে গিয়ে দেখেন তাঁর একমাত্র অস্ত্র, তাঁর অর্জুনের গাণ্ডীব, তাঁর কর্ণের অক্ষয় কবচ-কুণ্ডল আর তাঁর অধিকারে নেই। দেহপট সনে নট … হায়!
আজ, তাঁর জন্মদিনে তাই মনে হল, সেই ষোল বছরের কোঁকড়ানো চুল কিশোরকে একটু ভরসা দিই। বলি, আমি বুঝি, এত অর্থ, খ্যাতি, যশ, সম্মান, নিন্দা, বিশ্লেষণ, তুলনা— সে সবই বাই-প্রোডাক্ট মাত্র! নদীর বহতার দু’পাশে আপনাআপনিই জড়ো হয়ে গেছে; তুমি তো শুধু প্রাণভরে ব্যাট করতে চেয়েছিলে।
কী ভাগ্যিস চেয়েছিলে! টেনিসে রজার ফেডেরার ছাড়া, নিজে পারফর্ম করাকালীন এমন বিশুদ্ধ নান্দনিক সৌন্দর্যের স্বাদ আর কোনও ক্রীড়াবিদ দিতে পেরেছেন বলে তো মনে হয় না।
বলে রাখি – আমরা, যারা ক্রিকেট বলতে ‘শচীন এবং বাকিরা’ বুঝি, তারা সত্যিই তোমাকে তোমার রেকর্ড গড়ার সাফল্য বা না-গড়তে পারার ব্যর্থতা দিয়ে মাপতে চেষ্টাও করিনি কোনোদিনও। আমরা শুধু তোমার দেওয়া সৌন্দর্যটুকু প্রাণভরে শুষে নিতে চেয়েছি। তোমার ঘড়ির কাঁটার মতো সোজা ব্যাকলিফট, পায়ের আঙুলে ভর দিয়ে এগোনো ফ্রন্টফুট, কনুইয়ের জ্যামিতিক ভাঁজ, পরিমিত নিখুঁত ফুটওয়ার্ক আর নিয়তির মতো অবিচল মাথার কম্বিনেশনে শ্বাসবন্ধ করে থেকেছি আজীবন।
মনে হল, আজই ভাল সময়; কে জানে, তাঁর ১০১-তম সেঞ্চুরির সময় আমি থাকব কিনা।