সান্তিয়াগো বার্নাব্যু, মাদ্রিদ। রিয়াল মাদ্রিদের প্রতিপক্ষ ছিল প্যারিস সেন্ট জার্মেই। অপরদিকে আরেক ম্যাচে রিয়াল মাদ্রিদের বিপক্ষ দল চেলসি। ভেন্যু এবার ভিন্ন; লন্ডনের স্টামফোর্ড ব্রিজ। ভিন্ন প্রতিপক্ষ, বদলেছে সময়,স্থান। কিন্তু বদলায়নি ম্যাচের স্কোরলাইন, বদলায় নি একজন; তিনি রিয়াল মাদ্রিদের অধিনায়ক যার বাহুতে বাঁধা রিয়ালের গর্বের আর্মব্যান্ড। পিএসজিকে যেভাবে একাই হারিয়ে দিয়েছিলেন তিনি, চেলসি’র বিপক্ষেও দেখালেন একই পারফরম্যান্স; যেন আগের ম্যাচের রিপ্লে প্রদর্শন করেছেন লন্ডনে। দুই ম্যাচেই রিয়াল জিতেছে ৩-১ গোলের ব্যবধানে।
রিয়াল মাদ্রিদের নাম্বার নাইন জার্সিধারী একজন নেতার কথা বলেছি। তিনি করিম বেনজেমা, গত এক যুগ থেকে নিঃস্বার্থ ভাবেই সেবা দিয়ে গিয়েছেন রিয়াল-কে। গত দুই তিন বছরে তো ক্লাবটির ভরসা’র কেন্দ্রে পরিনত হয়েছেন তিনি, বয়সের সাথে সাথে বৃদ্ধি পেয়েছে তার পায়ের ধার; ক্রমাগত যেন ধারালো হয়ে উঠেছেন তিনি।
২০২১-২২ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লীগের কথাই ধরুন। নক আউট পর্বের রাউন্ড অব সিক্সটিনের প্রথম লেগে হেরে রিয়াল তখন বাদ পড়ার শঙ্কায়। কিন্তু ঘরের মাঠে দ্বিতীয় লেগে মাঠে নামতেই বদলেছে দৃশ্যপট; দুর্ধর্ষ এক কামব্যাকের মধ্য দিয়ে জয় নিয়েই মাঠ ছেড়েছিল রিয়াল মাদ্রিদ। নেপথ্যের নায়ক ছিলেন একজনই, করিম বেনজেমা।
অবশ্য সেখানেই থেমে যাননি তিনি। বহুল আকাঙ্খিত এক ইচ্ছে পূরণ করেছেন ভক্তদের। কোয়ার্টার ফাইনালে চেলসি’র বিপক্ষে অতিমানবীয় এক পারফরম্যান্স দেখিয়ে অজয়ে দুর্গ স্ট্যামফোর্ড ব্রিজে জিতিয়েছেন লস ব্ল্যাঙ্কোসদের। তার নৈপুন্যেই জয়ের আড়ালে থাকা ‘প্রতিশোধ’ নিতে পেরেছে রিয়াল সমর্থকেরা।
শুধু পারফরম্যান্সেই নয়, দুই ম্যাচের মিল রয়েছে গোলের ধরনেও। পিএসজি গোলরক্ষক জিয়ালুইজিন ডোনারুম্মা’র কথা মনে আছে? একই চরিত্রে অভিনয় করতে হয়েছে চেলসি গোলরক্ষক এদুয়ার্দো মেন্ডিকেও। দুজনই দুই ম্যাচে বেনজেমা’র দুর্দান্ত প্রেসিং-য়ে খেই হারিয়ে করেছেন দৃষ্টিকটু ভুল। খেসারতে হজম করতে হয়েছে গোল।
পিএসজি’র বিপক্ষে করেছিলেন হ্যাটট্রিক; চেলসি’র বিপক্ষেও হয়নি কোন পার্থক্য। এবারও তুলে নিয়েছেন হ্যাটট্রিক। উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগে এর আগে পরপর দুই ম্যাচে হ্যাটট্রিক করেছেন মাত্র তিনজন; ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো, লিওনেল মেসি এবং লুইজ আদ্রিয়ানো। আর যদি চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নক আউট ম্যাচ বিবেচনা করেন তবে তালিকা’টি আরো ছোট; ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো’র পরে মাত্র দ্বিতীয় খেলোয়াড় হিসেবেই করিম বেনজেমা নক আউট পর্বে ব্যাক টু ব্যাক হ্যাটট্রিক করার কীর্তি অর্জন করেছেন।
দু’টি ম্যাচ উইনিং হ্যাটট্রিক এর পাশাপাশি এই মৌসুমে বেনজেমা চ্যাম্পিয়ন্স লীগে আট ম্যাচে করেছেন এগারো গোল। প্রথম ফ্রান্স ফুটবলার হিসেবে চ্যাম্পিয়ন্স লীগে গোলসংখ্যা দুই অঙ্কের ঘরে নিতে পেরেছেন বেনজেমা, তার এই কীর্তি মাঠে বসেই দেখেছেন আরেক ফ্রান্স কিংবদন্তি থিয়েরি অঁরি। পুরো ক্যারিয়ারে ৮১ বার চ্যাম্পিয়ন্স লীগে গোল করা এই তারকা’র চেয়ে বেশি গোল করেছে মাত্র তিনজন। তারা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো(১৪০), লিওনেল মেসি(১২৫) এবং রবার্ট লেওয়ানডস্কি (৮৫)।
সব প্রতিযোগিতা মিলে বেনজেমার গোলসংখ্যা এবার ৩৬। অ্যাসিস্ট সংখ্যা ১৩। শুধু সংখ্যায় নয়, বেনজেমা’র প্রভাব বুঝতে পুরো নব্বই মিনিট চোখ আটকে রাখতে হয় মাঠের দিকে। নিজের মূল দায়িত্ব গোল করার পাশাপাশি কখনো মিডফিল্ডে নেমে এসে আক্রমণ তৈরি করছেন, কখনো বা উইং ধরে এগিয়ে এসে ভেঙ্গে দিচ্ছেন প্রতিপক্ষের প্রতিরক্ষা ব্যূহ। ‘ক্যাপ্টেন লিডিং ফ্রম দ্য ফ্রন্ট’ – এর আদর্শ প্রতিফলন দেখা গিয়েছে করিম বেনজেমা’র পারফরম্যান্সে।
গত মৌসুমে অল্পের জন্য ছোঁয়া হয়নি ব্যালন ডি’অর। এবার সেই সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত স্বীকৃতি অর্জনের পথে বেশ ভাল ভাবেই এগিয়ে যাচ্ছেন করিম বেনজেমা। বর্তমান ফর্ম ধরে রাখতে পারলে মৌসুম শেষে সেরা খেলোয়াড়ের পুরুষ্কার তিনিই জিতবেন তাতে সন্দেহ নেই; অনেক ফুটবল বিশেষজ্ঞ তো মৌসুমের মাঝপথেই তাদের ভোট বেনজেমা-কে দিয়ে দিয়েছে। ব্যালন ডি’অর হাতে করিম বেনজেমা – দৃশ্যটি দেখা হয়তো সময়ের ব্যাপার শুধুই।
ফ্রান্সের ফুটবলার করিম বেনজেমা ফরাসি ক্লাব পিএসজি’র বিপক্ষে যেখানে থেমেছিলেন, ইংলিশ ক্লাব চেলসি’র বিপক্ষে সেখান থেকেই শুরু করেছেন। খেলেছেন, গোল করেছেন, দুই পায়ের জাদুতে মোহিত করেছেন দর্শকদের। তিনি করিম মোস্তাফা বেনজেমা, হয়তো সেই ওয়াইনের বোতলের মতই, যার স্বাদ সময়ের সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে।