একটানা চলতে থাকলে মেশিন-ও মাঝেমধ্যে হোঁচট খায়। চলতে গিয়ে থমকে দাঁড়ায়। পুরো মৌসুম জুড়ে অবিশ্বাস্য ফর্ম ধারাবাহিকভাবে বহন করতে থাকা করিম বেনজেমা’-কেও থমকে দাঁড়াতে হয়। দাঁড়িয়েছিলেনও বটে।
লা লিগার অ্যাওয়ে ম্যাচে দুর্বল ওসাসুনার বিপক্ষে করিম বেনজেমার পারফরম্যান্স দেখে কেউ ভাবতে পারবে না এই ভদ্রলোক কিনা পিএসজি, চেলসি’র মত ফুটবল শক্তিকে কাঁপিয়ে দিয়েছিল। ওসাসুনার বিপক্ষে বেনজেমা গোল তো পাননি, বরং ১০ মিনিটের ব্যবধানে দুই দুইটি পেনাল্টি মিস করে ভক্তদের কপালে চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিয়েছিলেন।
কিন্তু বড়মাপের খেলোয়াড়দের এই এক বৈশিষ্ট্য। কিভাবে যেন ঠিক ঠিক চিনে নেয় প্রমানের মঞ্চ। বেনজেমার অবশ্য এই বয়সে এসে প্রমানের কিছু নেই। রয়েছে নিজেকে দলের প্রয়োজনের সময় উজাড় করে দেওয়ার সুযোগ। আর ওসাসুনার বিপক্ষে হঠাৎ হোঁচট খাওয়া করিম বেনজেমা সেই সুযোগ লুফে নিয়েছেন ম্যানচেস্টার সিটি’র বিপক্ষে কঠিন ম্যাচে।
চ্যাম্পিয়ন্স লিগের বিগ ম্যাচে এসে নিজের সেরাটা দিতে একটুও ভুল করেননি রিয়াল কাপ্তান। কোয়ার্টার ফাইনালে চেলসি কিংবা রাউন্ড অব সিক্সটিনে পিএসজি’র বিপক্ষে যেখানে থেমেছিলেন তিনি, ঠিক সেখান থেকেই শুরু করেছিলেন সিটিজেন দের বিপক্ষে।
ম্যাচের তখন প্রায় ৩০ মিনিট। পেপ গার্দিওলার শিষ্যদের সামনে হাপিত্যেশ করছিল রিয়ালের ডিফেন্স। তবে স্রোতের বিপরীতে বল পেয়ে সিটি’র অর্ধে কিছুটা এগিয়ে এসে বক্সের দিকে ক্রস করেন ফারলান মেন্দি। না, মদ্রিচ কিংবা ডি ব্রুইনাদের মত শৈল্পিক কোন ডিফেন্স চেরা ক্রস দিতে পারেননি তিনি।
কিন্তু যিনি গোলের নেশায় আসক্ত তার জন্য এমন নিরীহ দর্শন হাফচান্স যথেষ্ট। কি জানি, কোন জাদুবলে গোলমুখের দিকে না তাকিয়েই প্রায় ১৫-১৬ গজ দূর থেকে নেয়া শটে গোল করে বসেন কিং করিম।
আগের ম্যাচে পেনাল্টি মিসের মহড়া দেওয়া বেনজেমার সামনে বিধাতা আবারো নিয়ে আসেন স্পট-কিক মারার সুযোগ। ৮২ মিনিটের সময় দল তখন পিছিয়ে ৪-২ গোলে। বেনজেমা এবার কোন ভুল করেননি, দৌড়ে এসে পানেনকা শটেই বোকা বানান এডারসনকে।
বলকে নয়, যেন ব্যাক টু ব্যাক পেনাল্টি মিস করার চাপকে বুটের ঠিক মাথার অংশের ছোট একটা টোকায় পাঠিয়ে দিয়েছেন গোল লাইনের ওপাশে।
টিভির সেটের কিংবা গ্যালারিতে বসে থাকা ভক্তদের যেখানে দুশ্চিন্তায় হৃদকম্পন এলোমেলো হয়ে গিয়েছিল, সেখানে বেনজেমার এমন ঠাণ্ডা মাথার কাজ প্রমান করে দেয় তিনি আলাদা, তিনি অনন্য। তিনি করিম বেনজেমা – এ ম্যান উইথ দ্য নার্ভ অব স্টিল!
এবারের জোড়া গোলে আরো একবার রেকর্ডের পাতা ওলটপালট করে দিলেন রিয়াল মাদ্রিদ অধিনায়ক। এবারের মৌসুমে সবধরনের খেলা মিলিয়ে করেছেন ৪১টি গোল। ক্যারিয়ারে প্রথমবারের ৪০ এর বেশি গোল করার মাইলফলক ছুঁতে পেরেছেন তিনি।
চলতি মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগে ১৪ গোল করে সর্ব্বোচ্চ গোলস্কোরার-ও এখন বেনজেমা। পিছনে ফেলেছেন ১৩ গোল করা রবার্ট লেওয়ানডস্কিকে। তাছাড়া ১৪ গোল করে বেনজেমা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে এক আসরে সর্বোচ্চ গোলদাতাদের তালিকায় মেসির পাশে যৌথভাবে উঠে এসেছেন পাঁচ নম্বরে। সর্বোচ্চ ১৭ গোল করা ক্রিশ্চিয়ানো আছেন সবার উপরে।
আরেকটি জায়গাতে অবশ্য লিওনেল মেসিকে টপকে গিয়েছেন করিম বেনজেমা। চ্যাম্পিয়ন্স লিগের ইতিহাসে সেমিফাইনালের গোলসংখ্যায় মেসিকে পিছনে ফেলেছেন তিনি। চ্যাম্পিয়ন্স লীগ সেমিফাইনালে সাতটি গোল করে এই তালিকাতে দুই নম্বরে রয়েছেন বেঞ্জু। যথারীতি এখানেও উপরের নামটা ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর বটে।
উয়েফা চ্যাম্পিয়ন্স লিগের নক আউট ম্যাচগুলোতেও গোল করার রেকর্ড করেছেন করিম বেনজেমা। যেকোনো একটি আসরে এই মর্যাদার টুর্নামেন্টের নক আউট ম্যাচে সর্ব্বোচ্চ দশটি গোল করেছিলেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। আর এবারের মৌসুমে ইতোমধ্যে নক আউট ম্যাচে ৮টি গোল করা ফ্রান্সম্যান যৌথভাবে রয়েছেন এই তালিকার দুই নম্বরে।
মজার ব্যাপার, এ মৌসুমে এখন পর্যন্ত রাউন্ড অব সিক্সটিন, কোয়ার্টার ফাইনাল এবং সেমিফাইনালের প্রথম লেগ মিলিয়ে ম্যানসিটি গোল করেছে ১০টি; বায়ার্ন মিউনিখ করেছে ৯টি গোল, চেলসি এবং লিভারপুলের নামের পাশে গোল রয়েছে ৮টি করে।
অন্যদিকে বেনজেমা একাই এই ম্যাচগুলোতে করেছেন ৯ গোল; করেছেন দুই দুইটি হ্যাটট্রিকও। কিভাবে প্রকাশ করবেন এমন কীর্তিকে? এমন পারফরম্যান্সকে মূল্যায়ন করতে রীতিমতো অতিমানবীয় বলা ছাড়া আর কোন শব্দ বোধহয় যথেষ্ট নয়।
এখনো অবশ্য নিজের গোলসংখ্যা বাড়িয়ে নেওয়ার সুযোগ রয়েছে করিম বেনজেমা’র সামনে৷ ইউরোপের সবচেয়ে বড় এই টুর্নামেন্টের এমন অনেক রেকর্ডেই ভাগ বসাবেন তিনি। অবশ্য গোলসংখ্যা আর না বাড়লেও খুব একটা যায় আসে বলে মনে হয় না। এখন পর্যন্ত যা করেছেন তাতেই করিম বেনজেমা’কে অন্য গ্রহের কেউ মনে হচ্ছে। তবে সেমিফাইনালের দ্বিতীয় লেগে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে ঘুরে দাঁড়াতে অধিনায়ককে বড্ড প্রয়োজন লস ব্ল্যাঙ্কোসদের।