হারানো ফরম্যাটের ফুরানো কানুন

আর্ন্তজাতিক ক্রিকেটে আইসিসি অনুমোদিত তিনটি ফরম্যাট থাকলেও এগুলোর বাইরেও ফ্র‍্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে টি-টেন, দ্য হান্ড্রেড নামে বিভিন্ন ফরম্যাট চালু আছে। তবে এগুলো ছাড়াও আগে আরো বেশ কয়েকটি ফরম্যাট ঘরোয়া ক্রিকেটে চালু ছিলো; যা কিনা বেশ সুনামও অর্জন করেছিলো। হংকং ইন্টারন্যাশনাল সিক্সেস, বিচ ক্রিকেট, সুপার ম্যাক্স ও ডাবল উইকেট ক্রিকেটের মতো টুর্নামেন্টগুলোতে ছিলো অদ্ভুত সব নিয়ম।

আজকে আমরা এই চারটি টুর্নামেন্ট নিয়েই আলোচনা করবো। এই টুর্নামেন্ট গুলো এখন দেখা না গেলেও এর অদ্ভুত সব নিয়ম আপনাকে অবাক করতে বাধ্য করবে!

  • হংকং ইন্টারন্যাশনাল সিক্সেস

সিক্সেস হংকং ক্রিকেটের বেশ জনপ্রিয় একটি টুর্নামেন্ট হিসেবে সুনাম অর্জন করেছিলো। ১৯৯২ সালে প্রথম বেশ কয়েকটি ক্রিকেট দেশগুলো নিয়ে এটি আয়োজিত হয়। এই ফরম্যাটে প্রতি দলের ছয়জন করে ক্রিকেটার খেলতেন। প্রতি ইনিংসের জন্য বরাদ্দ থাকতো পাঁচ ওভার!

ওভার শেষ হলে কিংবা ষষ্ঠ ব্যাটসম্যান আউট হলেই তবে ইনিংস শেষ হবে। দল অলআউট হলেও শেষে অপরাজিত থাকা ব্যাটসম্যান একাই ব্যাট করতে পারবে। তবে নন স্ট্রাইক প্রান্তে আউট হওয়া ব্যাটসম্যান স্রেফ নিয়ম রক্ষার্থে দাঁড়িয়ে থাকবে।

প্রত্যেক ব্যাটসম্যানই যারা ব্যক্তিগত ৩১ রান করবে তাদেরকে বাধ্যতামূলক অবসরে যেতে হবে। তবে সব ব্যাটসম্যান যদি আউট হয়ে যায় তাহলে (অবসরে যাওয়া) সে পুনরায় ব্যাট করতে পারবে। এই টুর্নামেন্টে অনেক তারকা ক্রিকেটারই খেলেছেন।

শচীন টেন্ডুলকার, ওয়াসিম আকরাম, ব্রায়ান লারা, শেন ওয়াটসন সহ আরো অনেক তারকা ক্রিকেটাররা এই টুর্নামেন্টে খেলেছেন। বাংলাদেশের আমিনুল ইসলাম বুলবুল, আকরাম খানরাও এই টুর্নামেন্ট খেলেছেন। মোহাম্মদ আজহারউদ্দিনের নেতৃত্বে ভারতের হয়ে ১৯৯৫ সালে এই টুর্নামেন্টে খেলেন শচীন। যেখানে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ইন্ডিজের বিপক্ষে প্লেট ফাইনালে পরাজিত হয় ভারত। ১৯৯২ সালে শুরু হওয়া এই টুর্নামেন্ট ২০১২ সাল পর্যন্ত বেশ কয়েক আসর অনুষ্ঠিত হয়। তবে ২০১২ এর পর সবশেষ ২০১৭ সালে এই টুর্নামেন্ট আয়োজন করা হয়; যেখানে চ্যাম্পিয়ন হয় দক্ষিণ আফ্রিকা।

  • ক্রিকেট সুপার ম্যাক্স

নব্বইয়ের দশকে সাবেক নিউজিল্যান্ড অধিনায়ক মার্টিন ক্রো ক্রিকেট সুপার ম্যাক্স নামে নতুন এক ফরম্যাট উদ্ভাবন করেন নিউজিল্যান্ডের ঘরোয়া ক্রিকেটে। এই ফরম্যাটে টি-টোয়েন্টির মতোই কেউ চার ওভারের বেশি বল করতে পারবে না। মাঠে একটি নরমাল জোন থাকবে আরেকটি থাকবে ম্যাক্স জোন নামে। এই ম্যাক্স জোনে যদি কোনো রান হয় বা এই জায়গা দিয়ে কোনো বাউন্ডারি হয় তাহলে সেটা ডাবল কাউন্ট করা হয়ে থাকে। উদাহরণস্বরূপ – চার মারলে আট রান, এবং ছয় মারলে ১২ রান কাউন্ট হবে।

ম্যাচে প্রত্যেক দলের দু’টি করে মোট চারটি ইনিংস থাকবে! এটাকে অনেকটা সংক্ষিপ্ত ফরম্যাটের টেস্ট বলা চলে।

১৯৯৭ সালে ইংল্যান্ড, ২০০০ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং ২০০২ সালে ভারতের বিপক্ষে নিউজিল্যান্ড দল নিউজিল্যান্ড ম্যাক্স ব্ল্যাকস নামে সিরিজ খেলে। ওই তিজ সিরিজে পাঁচ সুপার ম্যাক্স ম্যাচে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২-১ এ জয়ের পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষেও সহজ জয় পায় স্বাগতিকরা। পরবর্তীতে ভারতের বিপক্ষে ২১ রানের জয় পায় কিউইরা। তবে ভারতের হয়ে শচীন টেন্ডুলকার ২৭ বলে ৭২ রানের দুর্দান্ত ইনিংস খেলেন! যার মধ্যে ১২ চার ও ১ টি ছয়ের মার ছিলো। এর মধ্যে দু’টি চার অবশ্য ম্যাক্স জোনে পড়ায় রান ডাবল হয়ে যায়। এরপর আর এই ফরম্যাটটি দেখা যায়নি ক্রিকেটে।

  • বিচ ক্রিকেট

২০০৭-২০০৯ পর্যন্ত অজিদের অধীনে বিচ ক্রিকেট নামক টুর্নামেন্ট পর পর তিন আসর আয়োজন করা হয়। অস্ট্রেলিয়া ছাড়াও এখানে অংশ নেয় দক্ষিণ আফ্রিকা, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড ও ওয়েস্ট ইন্ডিজ। অ্যালান বোর্ডার, গ্রাহাম গুচ, স্যার কোর্টনি ওয়ালশ, মার্টিন ক্রো এবং শন পোলক তাদের নিজ নিজ দলের হয়ে নেতৃত্ব দেন। এই টুর্নামেন্টে স্যার কার্টলি অ্যামব্রোস, ডেনিস লিলি, স্যার রিচার্ড হ্যাডলি, গ্রায়েম হিক, স্যার ভিভ রিচার্ডস, অ্যালান ডোনাল্ড, মার্ক ওয়াহ, ল্যান্স ক্লুজনার, স্টিফেন ফ্লেমিং এবং ডিন জোনসের মতো বড় বড় তারকারা খেলেছেন।

টুর্নামেন্টের তিন আসরেই ভেন্যু হিসেবে ব্যবহৃত হয় অ্যাডিলেডের গ্লেনেলজ বিচ, সিডনির মারউব্রা বিচ, পার্থের স্কারবোরো বিচ এবং গোল্ড কস্ট বিচ।

নিয়মানুযায়ী প্রত্যেক দলে ৬ জন খেলোয়াড় থাকবে এবং ইনিংস প্রতি আট ওভার করে খেলা হবে। ৬ জন খেলোয়াড় প্রত্যেকেই এক ওভার করে বল করবে। তবে শেষ দুই ওভার কে বল করবে সেটা অধিনায়ক সিদ্ধান্ত নেবে। একই ভাবে, ৬ জন খেলোয়াড় তিন ভাগে ভাগ হয়ে প্রত্যেক জোড়া দুই ওভার করে ব্যাট করবে। তবে কোন জোড়া শেষে ব্যাট করবে সেটা ব্যাটিং দলের অধিনায়ক ঠিক করবে। এর মাঝে কোনো ব্যাটসম্যান যদি আউট হয় তাহলে নন স্ট্রাইকার স্ট্রাইকে আসবে এবং দলের পাঁচ রান কাটা যাবে।

তবে প্রত্যেক জোড়ার দুই ওভার শেষ না হওয়া পর্যন্ত আউট হওয়া ব্যাটসম্যান ব্যট করতে পারবে। ২০০৮ সালে এই টুর্নামেন্টে ৮১ রান করে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক ছিলেন তিনি। প্রথম রাউন্ডে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে রবিন সিংয়ের সাথে জুটিতে ৫৭ রান করেন গড়েন হিক। এরপর বাকি ২৪ রান অন্যদের সাথে করেন। চতুর্থ রাউন্ডে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ৬ বলে ৬ ছক্কা হাকান গ্রায়েম হিক।

২০০৭ – চ্যাম্পিয়ন: ইংল্যান্ড; রানার আপ: অস্ট্রেলিয়া; তৃতীয় স্থান: ওয়েস্ট ইন্ডিজ

২০০৮ – চ্যাম্পিয়ন: নিউজিল্যান্ড; রানার আপ: ইংল্যান্ড; তৃতীয় স্থান: অস্ট্রেলিয়া

২০০৯ – চ্যাম্পিয়ন: দক্ষিণ আফ্রিকা; রানার আপ: নিউজিল্যান্ড; তৃতীয় স্থান: অস্ট্রেলিয়া।

  • ডাবল উইকেট ক্রিকেট

ডাবল উইকেট ক্রিকেটের প্রচলন হয় আঠারো শতকের শুরুর দিকে। তবে ১৯৯০ সনে এটি বেশ জনপ্রিয়তা লাভ করে; কারণ বড় বড় ক্রিকেট দেশের তারকা খেলোয়াড়েরা এতে অংশ নেয়। এই টুর্নামেন্ট তখন মুম্বাইয়ে অনুষ্ঠিত হয়েছিলো। এক জোড়া খেলোয়াড় নিয়েই মূলত একটি দল! ভারতের সেখানে দুই জোড়া খেলোয়াড় ছিলো! বাকি ৬টি টেস্ট প্লেয়িং দলের একটি করে জোড়া ছিলো টুর্নামেন্টে।

লিগ স্টেজে চার ওভারের খেলা হলেও, সেমিফাইনালে ৬ ও ফাইনালে ৮ ওভারে খেলা হয়। দুই খেলোয়াড় দশবার আউট না হওয়া পর্যন্ত খেলতে পারবে। আর প্রতি আউটের জন্য পাঁচ রান করে কাটা যাবে। ভারতের হয়ে তখন জোড়া ছিলো কপিল দেব-শচীন টেন্ডুলকার এবং রবী শাস্ত্রী-মোহাম্মদ আজহারউদ্দিন। ভাগ্যক্রমে দুই দলই ফাইনালে পৌঁছে যায়!

এরপর ১৭ বছর বয়সী টেন্ডুলকার ফাইনালের নায়ক বনে যান। ৩৩ বলে ৬ ছক্কা ও পাঁচ চারে ৭৫ রান করেন তিনি! যদিও তিনি চার বার আউট হয়েছিলেন। পাঁচ উইকেট হারিয়ে শচীন এবং কপিল সংগ্রহ করেন ৯৫ রান। উইকেট প্রতি পাঁচ রান বাদ দেওয়ার পর তাদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ৭০ রান। জবাবে ব্যাট করতে নেমে মাত্র ২৭ রান করে আজহারউদদিন এবং শাস্ত্রী! ৬২ রানে ৭ উইকেট হারানোর পর উইকেটে প্রতি রান কাটায় সেটি নেমে আসে ২৭ রানে!

নব্বই দশকের শেষদিকে এই ডাবল উইকেট চ্যাম্পিয়নশিপ বেশ সাড়া ফেলে দেয়। পাকিস্তান, ওয়েস্ট ইন্ডিজ এবং যুক্তরাষ্ট্রেও এটি আয়োজন করা হয়। ১৯৯৭-২০০৩ পর্যন্ত একাধিক চ্যাম্পিয়নশিপ আয়োজন করা হয়। যেখানে বিশ্বের অনেক তারকা ক্রিকেটার অংশ নেয়। তবে এই টুর্নামেন্টের সবচেয়ে সফল দল বা জোড়া পাকিস্তানিরা। কারণ পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ড (পিসিবি) তাঁদের সেরা ক্রিকেটারদের এই টুর্নামেন্টে খেলার অনুমতি দিয়েছিলো।

১৯৯৭, লাহোর – শহিদ আফ্রিদি ও আকিব জাভেদ

১৯৯৮, লাহোর – শহিদ আফ্রিদি ও আজহার মাহমুদ

২০০১, নিউ জার্সি – ওয়াসিম আকরাম ও শহিদ আফ্রিদি

২০০১, লাহোর – ইমরান নাজির ও শোয়েব মালিক

২০০৩, সেন্ট লুসিয়া – জ্যাকব ওরাম ও ড্যানিয়েল ভেট্টোরি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link