ছোটবেলার হিরোরা এক এক করে বিদায় নিচ্ছেন, অসময়েই। আমাদের ছোটবেলায় হিরো বলতে প্লেয়ারদেরকেই বুঝতাম। অমিতাভ, মিঠুনের নাম করলে ঠেঙিয়ে বাড়ি থেকে বের করে দিতো বাবা।
আমাদের স্বপ্নের নায়করা ছিল – ম্যারাডোনা, প্লাতিনি, জিকো, সুনীল গাভাস্কার, কপিল দেব, ভিভিয়ান রিচার্ডস, ডিন জোন্স, ডেভিড গাওয়ার, মাইকেল হোল্ডিং এবং চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী দল হলেও অবশ্যই ইমরান খান আর ওয়াসিম আকরাম । মাইক টাইসন বা বেন জনসনও। আর এদিকে অবশ্যই শিশির ঘোষ, প্রশান্ত ব্যানার্জী, সুব্রত ভট্টাচার্যরা।
তখনো বালক বা কিশোর হইনি। আমাদের ছিল স্লাইডিং ডোর লাগানো বিরাট সাদা কালো টিভি। বাইরের বিরাট বৈঠকখানা ঘরটা বিশেষ করে খেলার দিনগুলোতে চেনা অচেনা লোকে ভরে থাকতো।
দেখলাম বাবা, কাকুরা মন দিয়ে টেনিস দেখছে। মেয়েরা খেলছে। এর আগে মার্টিনা নাভ্রাতিলোভার খেলা দেখেছি। সেই বয়সে চশমা পরা ঐ কাঠ কাঠ নারীকে আমার তেমন পছন্দ হয়নি। সবাই যদিও ভীষণ তারিফ করতো!
এদিন দেখলাম একটা মেয়ে সাদা টি-শার্ট, ছোট স্কার্ট, পায়ে সাদা স্নিকার, মোজাটা অ্যাঙ্কল লেংথে পরা, কানে দুল। সব থেকে আকর্ষণীয় যেটা, মাথায় একটা সরু ব্যান্ড, কপালে যেন তার সোনালী চুলগুলো উড়ে এসে না পড়ে। উল্টো দিক থেকে সার্ভ করলে এই প্রান্তে তার অপেক্ষা করার ধরণটাও দারুণ লাগলো।
ডান হাতে ব্যাটটা ধরে শরীরটা ঈষৎ ঝুঁকিয়ে হালকা ডান-দিকে বাঁ-দিকে দুলছে যেন শিকারের প্রতীক্ষালয় কোন বাঘিনী আর টি-শার্টের ওপর থেকে ছোট্ট সোনার চেনটা বেরিয়ে আছে আর সেই সঙ্গে মাঝে মাঝে বাঁহাতে ফুঁ দিচ্ছে সে। সার্ভ করার সময় বাঁহাত দিয়ে বলটা ড্রপ করানোর সময় লক্ষ্য করলাম বাঁহাতে পরে থাকা ঘড়িটা। সেই প্রথম কোন খেলোয়াড়কে দেখলাম ঘড়ি পরে খেলতে। দারুণ ভালো লেগে গেলো পুরো ব্যাপারটাই। বসে পড়লাম খেলা দেখতে। একদম জমে গেলাম। সেই থেকেই আগ্রহ বাড়লো টেনিসের খুঁটিনাটিতে।
স্টেফি গ্রাফ। পুরো নাম স্টিফানি মারিয়া গ্রাফ। জন্ম ১৯৬৯ সালে পশ্চিম জার্মানিতে। বাবা পিটার গ্রাফের উৎসাহে এবং ট্রেনিংয়ে মাত্র তিন বছর বয়সে হাতে তুলে নেন টেনিস ব়্যাকেট। পাঁচ বছর বয়সেই প্রথম টুর্নামেন্টে নাম দেওয়া এবং চ্যাম্পিয়ন হওয়া।
পাঁচ ফুট ন-ইঞ্চির স্টেফি এককভাবে চারটি গ্র্যান্ডস্লাম জয় করেন মোট বাইশবার, যা সর্বকালীন রেকর্ড। তাঁর সব থেকে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী আরেক পাঁচ ফুট ন-ইঞ্চির মহিলা, আর্জেন্টিনার গ্যাব্রিয়েলা সাবাতিনি। টেনিস জগতে আরেক গ্ল্যামার কুইন সাবাতিনির বারবার গ্র্যান্ডস্লাম হাতছাড়া হয়েছে শুধুমাত্র স্টেফির জন্যই। টেনিস জগতের সব থেকে আলোচ্য মহিলা খেলোয়াড় সম্ভবত স্টেফিই, সারাপোভার কথা মাথায় রেখেই বলছি।
সাবাতিনিকে নিয়ে বিশেষ দুশ্চিন্তায় কখনোই পড়তে হয়নি স্টেফিকে। ১৯৯০ সালে তাঁর আরেক প্রতিদ্বন্দ্বীর আবির্ভাব ঘটলো। ১৯৯০ সালে মাত্র ষোলো বছর বয়সে তিনি ফ্রেঞ্চ ওপেন জিতে নিলেন। এতো কম বয়সে এর আগে কেউ ফ্রেঞ্চ ওপেন জেতেনি। যুগোস্লাভিয়ার টেনিস রাণী মনিকা সেলেস এসে চমকে দিলো গোটা পৃথিবীকে।
পরবর্তী তিন বছরে আটটা গ্র্যান্ডস্লাম তাঁর ঝোলায়। হৈ হৈ করে এগোচ্ছিল তাঁর জয়যাত্রা। কিন্তু তার ছিঁড়লো ১৯৯৩ এর ৩০শে এপ্রিল। ম্যাগডেলেনা মালিভার সঙ্গে মনিকার খেলা চলাকালীন টেনিস কোর্টে পাঁচ ফুট দশ ইঞ্চির মনিকা এক আততায়ীর হাতে আক্রান্ত হন। একটি ন-ইঞ্চি লম্বা ছুরি গেঁথে দেওয়া হয় তাঁর পিঠে। এই ঘটনার দুবছর পরে মনিকা কোর্টে ফিরলেও আর সেই ফর্ম ফিরে পাননি। মূলত মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। এরপর আমেরিকার নাগরিকত্ব নেন। ১৯৯৬ সালে একটা গ্র্যান্ডস্লাম জেতেন।
এদিকে স্টেফির মুকুটে বাড়তে থাকে পালকের সংখ্যা।
স্টেফি জার্মান ফর্মুলা ওয়ান কার চ্যাম্পিয়ন বার্টলসের সঙ্গে বছর সাতেক টানা ডেটিং করলেও বিয়ে করেন আরেক টেনিস তারকা আন্দ্রে আগাসিকে। আগাসি তাঁর স্ত্রী হলিউডের নায়িকা ‘ব্লু লগুন’ খ্যাত ব্রুক শিল্ডসের সঙ্গে দু’বছরের দাম্পত্যের ইতি টেনে স্টেফির সঙ্গে ঘর বাঁধেন লস অ্যাঞ্জেলেসে।
সেই বাড়িতে এখন একসঙ্গেই বাস করেন আগাসির মা, স্টেফির মা আর ভাই এবং আগাসি-স্টেফির দুই সন্তান-সহ দুই তারকা। আমেরিকার মতন দেশে এভাবে এক সঙ্গে বসবাস করা সত্যিই এক বিরল ঘটনা।
লেখাটার মধ্যে হয়তো তেমন কিছুই পাওয়া গেলো না, কিন্তু আমাদের ছোটবেলার স্মৃতি কিছুটা উসকে দেওয়া গেলো। যাঁরা ঐ সময়ে এই খেলোয়াড়দের ছবি জমাতেন বা ম্যাগাজিন থেকে পোস্টার কেটে দেওয়ালে আটকাতেন আশা করি লেখাটা তাঁদের মন্দ লাগবে না।