ক্রিকেট খেলা হলেও ছেলেখেলা নয়। টিকে থাকা বড্ড দায়। দারুণ সব প্রতিভার ঝলক দেখিয়েও যেন দূরত্ব বেড়ে যায়। আর টেস্ট ক্রিকেটে তো টিকে থাকা আরও বেশি কঠিন। নিজের পারফরমেন্স ছাড়াও এখানে বড় একটা ভূমিকা রাখে শারীরিক সক্ষমতা। আবার অনেক সময় দুর্ভাগ্য ছিটকে দেয়। নানা কারণে টেস্ট ক্রিকেটের ওই সাদা পোশাকটার সাথে দূরত্ব বেড়ে যায় আজীবনের।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোন না কোন সময়ে খেলা এমনই কিছু দূর্ভাগাদের নিয়ে রীতিমত একটা একাদশ সাজিয়ে ফেলা যায়। আজকের খেলা ৭১-এর আয়োজনে থাকছে কুড়ি কিংবা তারও কম টেস্ট ম্যাচ খেলা খেলোয়াড়দের নিয়ে গড়া একাদশ। চলুন তবে শুরু করা যাক।
- জন রিড (নিউজিল্যান্ড)
ইনিংস শুরু করার দায়িত্ব পালন করবেন জন রিড। না শুধু জন রিড বললে হয়ত আপনারা দ্বিধায় পড়ে যাবেন যে আসলে কার কথা বলছি। কেননা নিউজিল্যান্ড জাতীয় দলের হয়ে আরও একজন জন রিড খেলেছিলেন যার পুরো নাম ছিল জন রিচার্ড রিড। তাঁর ক্যারিয়ারটা ছিল বেশ সমৃদ্ধ। তবে এই জন রিডের পুরো নাম জন ফুলটন রিড। তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার মাত্র ১৯ ম্যাচ লম্বা।
তবে এই ১৯ ম্যাচেই জন রিড হাঁকিয়েছেন ছয়টি সেঞ্চুরি সহ দুইটি হাফ সেঞ্চুরি। ১৮০ তাঁর সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রান। এছাড়া এই ছোট্ট ক্যারিয়ারে তিনি রান করে গিয়েছেন প্রায় ৪৬.২৮ গড়ে। তাঁর নামের পাশে রানের সংখ্যা ১২৯৬। ক্যারিয়ারটা আরেকটু দীর্ঘায়িত হলে নিশ্চিতরুপেই সংখ্যাটা বেশ আরেকটু বেড়ে যেতে পারত।
- ফিল জ্যাকস (অস্ট্রেলিয়া)
জন রিডের সাথে সঙ্গ দিয়ে ইনিংস শুরুর চাপটা সামলে নেবেন ফিল জ্যাকস। অস্ট্রেলিয়ান এই ক্রিকেটার ২০০৫-০৮ এই সময়ে অস্ট্রেলিয়ার হয়ে মাত্র ১১টি টেস্টে অংশ নেওয়ার সুযোগ পেয়েছেন।
বাঁ-হাতি এই ব্যাটার যে একেবারেই খুব খারাপ করেছিলেন তা নয়। তবে অস্ট্রেলিয়ার সে দশকে ছিল বিশ্ব ক্রিকেটের পরাশক্তি। সে দলে টিকে থাকতে হলেও অতি অসাধারণ কিছু করা ছিল অত্যাবশ্যক।
সে যাই হোক তিনি চেষ্টাটা করে গিয়েছিলেন। নামের পাশে ৪৭.৪৭ গড় অন্তত তাঁর প্রচেষ্টার স্বপক্ষে কথা বলে। মাত্র ১১ ম্যাচের ক্যারিয়ারে তিনি তিনটি শতক ছাড়াও করেছেন ছয়টি অর্ধশতক। তবুও তা যেন যথেষ্ট ছিল না তাঁর জাতীয় দলের ক্যারিয়ার দীর্ঘায়িত করতে। ৯০২ রানেই থেমে যায় তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার। দেড়শ রানের একটা ইনিংস ছিল তাঁর এই ছোট্ট ক্যারিয়ার।
- অ্যাডাম ভোজেস (অস্ট্রেলিয়া)
টেস্টে তিন নম্বর পজিশনটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। এই পজিশনের খেলোয়াড়কে যেমন শুরুর দিকে পিচের বৈরীতা সামলাতে হয়, ঠিক তেমনি তাঁর উপর দায়িত্ব থাকে ব্যাটিং স্তম্ভ হয়ে ইনিংসটা গড়ে তোলার। এমন গুরুত্বপূর্ণ এক পজিশনে আজকের একাদশে থাকছেন অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটার অ্যাডাম ভোজেস।
২৬৯ রানে অপরাজিত থাকার কীর্তি রয়েছে ভোজেসের। তাঁর মাত্র বিশ ম্যাচের ক্যারিয়ারে তিনি ৩১ ইনিংসে ব্যাট করার সুযোগ পেয়েছিলেন। এ সময়ে পাঁচটি সেঞ্চুরি সহ চারটি হাফ সেঞ্চুরি করেছেন তিনি। গড়টাও দূর্দান্ত তাঁর। ৬১.৮৭ গড়ে তিনি রান করেছেন বছর খানেকের স্বল্প সময়ের ক্যারিয়ারে। মোট ১৪৮৫ রান করেছেন তিনি।
- ব্র্যাড হজ (অস্ট্রেলিয়া): অধিনায়ক
আজকের তালিকায় অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেটারদের আধিক্য বেশি। বেশ একটা প্রতিযোগিতা চলে অস্ট্রেলিয়া জাতীয় দলে সেটা বুঝতে আর খুব একটা বাকি থাকে না। তাইতো আরও একজন অজি হিসেবে এই তালিকায় থাকছেন ব্র্যাড হজ। ফ্রাঞ্চাইজি ক্রিকেটে বেশ পরিচিত এক মুখ হলেও জাতীয় দলে খুব একটা লম্বা সময় কাটাতে পারেননি ব্যাড হজ।
মাত্র ছয়টি টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছেন হজ। গড় এখানটায় তাই খানিক ফিঁকে হয়ে যায়। তবে ৫৫.৮৮ গড়ে ব্যাট করাটাও তো আর সাধারণ কোন কাজ নয়। ২০৩ রানে অপরাজিতও থেকে ছিলেন এই ছয় ম্যাচের টেস্ট ক্রিকেট ক্যারিয়ারে।
ওই একটি সেঞ্চুরি সহ দুইটি হাফ সেঞ্চুরি করেছিলেন হজ। ছয় ম্যাচের দুইটি ইনিংসে অপরাজিত থেকে মোট ৫০৩ রান করেছিলেন তিনি। শেফিল্ড শিল্ডের নেতৃত্বে অভিজ্ঞতা থাকার সুবাদে এই একাদশে অধিনায়ক থাকছেন তিনি।
- মার্টিন লাভ (অস্ট্রেলিয়া)
আবারও একজন অস্ট্রেলিয়ান খেলোয়াড়কে নিয়ে হাজির হচ্ছি। ডান হাতি টপ অর্ডার ব্যাটার মার্টিন লাভ অস্ট্রেলিয়ার ঐতিহ্যবাহী টেস্ট জার্সি গায়ে জড়িয়েছিলেন ঠিক প্রায় দুই দশক আগে। বছর খানেক তিনি টেস্ট দলে ছিলেন নিয়মিত। তবে এর পর আর নিজেকে তিনি অস্ট্রেলিয়া দলের সাজঘরে আবিষ্কার করতে পারেননি কখনোই।
মোটামুটি একটা মৌসুমে তিনি পাঁচটি টেস্ট ম্যাচ খেলেছিলেন। একটি শতক ও একটি অর্ধশতক রয়েছে তাঁর নামের পাশে। তাছাড়া এ সময়ে ৪৬.৬০ গড়ে রান তুলেছেন তিনি। পাঁচ ম্যাচের ক্যারিয়ারে ১০০ রানে একবার অপরাজিত ছিলেন লাভ। সেটাই তাঁর সর্বোচ্চ। মোট রান ২৩৩।
- বিনোদ কাম্বলি (ভারত)
অস্ট্রেলিয়ার আধিপত্যের মাঝে প্রথমবারের মত উপমহাদেশের কোন খেলোয়াড়ের জায়গা হচ্ছে আজকের এই একাদশে। মিডল অর্ডারের দায়িত্বভার গিয়ে পড়েছে বিনোদ কাম্বলির কাঁধে। বাঁ-হাতি এই ব্যাটার ভারত দলে স্বল্প সময়ের জন্য জায়গা করে নিয়েছিলেন। ১৯৯৩-৯৫ এই দুই বছরেই শুরু এবং শেষ তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার।
বিনোদ ভারতের হয়ে মোট ১৭টি টেস্ট ম্যাচ খেলেছেন। রান করেছেন ৫৪.২০ গড়ে। এক ইনিংসে ২২৭ তাঁর সর্বোচ্চ রান। তাছাড়া মোট রান ১০৮৪। এই রান করতে তিনি চারটি সেঞ্চুরির পাশপাশি তিনটি হাফ সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন তাঁর সংক্ষিপ্ত টেস্ট ক্রিকেট ক্যারিয়ারে।
- ডেভিড মারে (ওয়েস্ট ইন্ডিজ): উইকেটরক্ষক
একটা একাদশে উইকেটরক্ষক থাকবে না তা কি করে হয়? আর বিশ কিংবা তাঁর কম টেস্ট ম্যাচ খেলা উইকেটরক্ষকের সংখ্যা অত্যন্ত কম। সে দিক থেকে আজকের একাদশে সুযোগ পাচ্ছেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের খেলোয়াড় ডেভিড মারে। সত্তর দশকে তিনি ক্যারিবিয়ান দলের সদস্যপদ লাভ করেন। চার বছর লম্বা হয়েছিল তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ার।
ডেভিড মারে তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারে ১৯টি ম্যাচে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের হয়ে প্রতিনিধিত্ব করেছেন। এ সময়ে তিনি রান করেছেন ২১.৪৬ গড়ে। তিনটি অর্ধশতকের বদৌলতে তিনি ৬০১ রান জড়ো করেছিলেন তাঁর নামের পাশে। তাছাড়া উইকেটের পেছেনে তিনি ৬১ বার প্রতিপক্ষ খেলোয়াড়কে প্যাভিলনের পথ বলে দিয়ে সহয়তা করেছিলেন।
- ফ্যানি ডি ভিলিয়ার্স (দক্ষিণ আফ্রিকা)
দক্ষিণ আফ্রিকার প্রতিনিধি হিসেবে আজকের এই আয়োজনে প্রথমবারের মত যুক্ত হচ্ছেন ফ্যানি ডি ভিলিয়ার্স। তিনিও তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারে এই তালিকার বাকিদের মতই খুব বেশি দীর্ঘায়িত করতে পারেননি। প্রোটিয়াদের হয়ে কেবলমাত্র ১৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলার সুযোগ পেয়েছিলেন ফ্যানি ডি ভিলিয়ার্স। অলরাউন্ডার হিসেবে তিনি থাকছেন এই তালিকা।
যদিও টেস্ট ক্যারিয়ারের ১৮টি ম্যাচে কেবল সাত ইনিংসে ব্যাট করেছেন তিনি। দুইটি অর্ধশতকে রান করেছেন ৩৫৯ রান। সে সাথে তাঁর ডানহাতি মিডিয়াম পেস বোলিংও বেশ কার্য্যকর। তিনি ২৪.৮৭ গড়ে উইকেট নিয়েছেন ৮৫টি। ফাইফার নিয়েছেন পাঁচবার। তাছাড়া এক ম্যাচে দশ উইকেট নিয়েছেন দুইবার।
- ডেমিয়েন ফ্লেমিং (অস্ট্রেলিয়া)
ব্যাটার, উইকেটরক্ষক সব হল। এবার পালা একাদশে বোলারদের জায়গা করে দেওয়ার। চার বোলার সমৃদ্ধ এই একাদশের প্রথম বোলার ডেমিয়েন ফ্লেমিং। অস্ট্রেলিয়ার এই ডানহাতি পেস বোলার দলে আসা যাওয়ার মাঝে ছিলেন। পাঁচ বছরের ক্যারিয়ারে তাই ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়েছে মোটে বিশটি।
তবে এই বিশ ম্যাচেই তিনি নিজের ছাপ ফেলে রাখার চেষ্টাটা করে গিয়েছেন। উইকেট নিয়েছেন ৭৫টি। এক ইনিংসে পাঁচ কিংবা তাঁর বেশি উইকেট নিয়েছিলেন তিন বার। তাছাড়া এক ম্যাচে সর্বোচ্চ নয়টি উইকেট বাগিয়েছিলেন তিনি। ২৫.৮৯ এর একটা বোলিং গড় নিয়ে তিনি শেষ করেছিলেন নিজের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ক্যারিয়ার।
- শেন বন্ড (নিউজিল্যান্ড)
নিউজিল্যান্ডের অন্যতম সেরা পেসার হিসেবেই বিবেচিত হয়ে আসছেন শেন বন্ড। তবে আফসোস তাঁর টেস্ট ক্যারিয়ারের দৈর্ঘ্য অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। তিনি মাত্র ১৮টি ম্যাচ খেলেছেন ব্ল্যাকক্যাপসদের হয়ে। ডানহাতি এই পেসার ছিলেন প্রতিপক্ষের আতঙ্ক।
এই ১৮ টেস্টে তাঁর নামের পাশে রয়েছে ৮৭টি উইকেট। ২২.০৯ গড়ে তিনি এই উইকেট বাগিয়ে নিয়েছেন। পাঁচ বার পাঁচ কিংবা তাঁর বেশি উইকেট নেওয়ায়র পাশাপাশি এক টেস্টে দশ উইকেট নেওয়ার কৃতীত্ব গড়েছিলেন শেন বন্ড। তাই তিনি থাকছেন আজকের তালিকার বোলিং আক্রমণে।
- এনামুল হক জুনিয়র (বাংলাদেশ)
একজন স্পিন বোলারের অভাব রয়েছে এই একাদশে। সে অভাব পূরণ করতেই একাদশে যুক্ত হচ্ছেন বাংলাদেশের স্পিনার এনামুল হক জুনিয়র। বাঁ-হাতি এই অফ স্পিনার বেশ একটা আলোড়ন ফেলেই এসেছিলেন জাতীয় দলে। তবে খুব বেশিদিন নিজেকে স্থায়ী করতে পারেননি।
মাত্র ১৫ ম্যাচেই থেমে আছে তাঁর আন্তর্জাতিক টেস্ট ক্যারিয়ার। এ সময়ে তিনি তাঁর স্পিন ঘূর্ণিতে ৪৪টি উইকেট বাগিয়েছেন। তিনদফা ফাইফার নেওয়ার পাশপাশি তিনি একবার একটি টেস্টে দশ উইকেট নিয়েছিলেন। ৪০.৬১ বোলিং গড়টা একটু দৃষ্টিকটু লাগতেই পারে। তবে একজন স্পিনার ছাড়া কোন একাদশই পূর্ণতা পায় না।