নির্ভীক বিচারক কিংবা খলনায়ক

আম্পায়ার হিসেবে যেকোনো দলের জন্যই আতঙ্ক ছিলেন তিনি। বিতর্ক, আলোচনা, সমালোচনা; কোনো কিছুর ধার না ধেরে নিজের ন্যায় বোধ নিয়েই চলেছেন। একটু একটু করে হয়ে উঠেছেন আতঙ্ক। কারো কাছে ন্যায়ের প্রতীক, কারো কাছে খলনায়ক সেই ড্যারেল হেয়ার।

২২ গজে কিছু কিছু বোলারদের জন্য আতংকের কারণ হয় কিছু ব্যাটসম্যান। একই ভাবে কিছু কিছু বোলাররা ব্যাটসম্যানদের জন্য আতঙ্কের কারণ হয়ে শুনেছেন।

কিন্তু আম্পায়ারও কী আতঙ্ক হয়ে উঠতে পারেন?

হ্যাঁ, ছিলেন একজন। আম্পায়ার হিসেবে যেকোনো দলের জন্যই আতঙ্ক ছিলেন তিনি। বিতর্ক, আলোচনা, সমালোচনা; কোনো কিছুর ধার না ধেরে নিজের ন্যায় বোধ নিয়েই চলেছেন। একটু একটু করে হয়ে উঠেছেন আতঙ্ক। কারো কাছে ন্যায়ের প্রতীক, কারো কাছে খলনায়ক সেই ড্যারেল হেয়ার।

আম্পায়ারের একটি ভুল সিদ্ধান্তে বদলে যেতে পারে যেকোনো ম্যাচের চিত্র। তাই বেশ বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হয় আম্পায়ারদের। কিন্তু এদিক থেকে ব্যতিক্রম ছিলেন ড্যারেল হেয়ার। ভুল কি ঠিক; সেটা তিনি নিজেই বিচার করতেন। কারো পরামর্শ কিংবা উপদেশ তিনি ধার ধারতেন না!

‘বিতর্ক’ – শব্দটার সাথে নিজেকে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িয়ে রেখেছেন ড্যারেল হেয়ার। স্রেফ আঙ্গুল উঁচিয়েই পুরো ক্যারিয়ারে নিজেকে রেখেছেন আলোচনা-সমালোচনায়। কেউ কেউ আবার তাকে নির্ভীক আখ্যাও দিয়েছেন!

কিংবদন্তি স্পিনার মুত্তিয়া মুরালিধরনের ক্যারিয়ার তো প্রায়ই শেষই করে ফেলেছিলেন! হেয়ারের জন্যই মুরালির নামের পাশে হয়তো ‘গ্রেট’ শব্দটা থাকতো না।

সাল ১৯৯৬। বক্সিং ডে টেস্টে মেলবোর্নে মুখোমুখি অস্ট্রেলিয়া ও শ্রীলঙ্কা। প্রথম দিনেই তিন ওভারে মুরালির বলে সাত-সাতবার নো বল দেন ড্যারেল হেয়ার! না, ওভারস্টেপের কারণে নয়! হেয়ারের মতে, মুরালি চাকিং করছিলেন। যার কারণে মুরালির বল ছোড়া মাত্রই নো বল ঘোষনা করছিলেন হেয়ার। ক্রিকেটের নিয়ম অনুযায়ী বোলিং অ্যাকশন নিয়ে কোনো সমস্যা থাকলে সেটি ম্যাচ শেষে ম্যাচ রেফারির কাছে লিখিত অভিযোগ জানাতে হবে। কিন্তু, হেয়ার খুব একটা নিয়মের তোয়াক্কা করতেন না!

এমনকি তিনি বেশ কয়েকবার নিজের পজিশনও পরিবর্তন করছিলেন যাতে মুরালির অ্যাকশন অবৈধ কিনা সেটি ধরতে পারেন! লঙ্কান অধিনায়ক অর্জুনা রানাতুঙ্গা তো ক্ষোভে দলবল নিয়ে মাঠ ছেড়েই উঠে যাচ্ছিলেন।

হেয়ার নিজের সিদ্ধান্তের বাইরে কারো কথাতেই কর্ণপাত করতেন না। এমনকি এই কান্ডের পর তো হেয়ার মৃত্যুর হুমকিও পেয়েছিলেন বলে পরবর্তীতে তিনি জানান!

এই ঘটনাকেও ছাপিয়ে গিয়েছিলো ২০০৬ এর ওভাল টেস্টের ‘বল টেম্পারিং’ কান্ড। ওভাল টেস্টে তখন ব্যাট করছিলো ইংলিশরা। পাকিস্তানের পক্ষ থেকে আম্পায়ার হেয়ারকে জানালো হলো বলের আকৃতি ঠিক নেই। দীর্ঘসময় খেলায় বলের আকৃতি কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে। মাঠের বাইরে থেকে চতুর্থ আম্পায়ার বল ভর্তি স্যুটকেস নিয়ে মাঠেও এলেন। হটাৎ হেয়ার বললেন এটা ইচ্ছাকৃতভাবে আকৃতি পরিবর্তন করা হয়েছে! অর্থাৎ ‘বল টেম্পারিং! ‘ আর বল টেম্পারিংয়ের কারণে ইংল্যান্ডকে পেনাল্টি রান হিসেবে অতিরিক্ত ৫ রান দেওয়া হলো!

সেদিন চা-বিরতির পর আর মাঠেই নামেনি পাকিস্তান দল। পাকিস্তান অধিনায়ক ইনজামাম উল হক ক্ষোভে জানিয়েছিলেন এমন অভিযোগের পর তাঁরা কেউই মাঠে যাবে না। আর তার ৩০ মিনিট পরই সিদ্ধান্ত জানানো হয় ইংল্যান্ড এই টেস্টে জয়ী! অবশ্য লম্বা সময় পর এই টেস্টকে অফিসিয়ালি ড্র হিসেবে ঘোষণা করে আইসিসি।

অ্যাডিলেডে ভারত ও অস্ট্রেলিয়ার মধ্যকার টেস্ট দিয়েই আম্পায়ারিং শুরু হেয়ারের। প্রথম ম্যাচেই জন্ম দেন বিতর্কের। পুরো টেস্টে ভারতীয় ব্যাটসম্যানরা আটবার লেগ বিফোরের শিকার হন! যার সবগুলোই সিদ্ধান্ত দেন হেয়ার। এর মাঝে বেশ কিছু উইকেটই ছিলো প্রশ্নবিদ্ধ। ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলেন ভারতীয় ক্রিকেটাররাও।

ঠিক তার উলটো চিত্র ছিলো ভারতের বোলিংয়ের সময়! দুইটি সহজ আবেদন নাকচ করে দেন তিনি! টিভি রিপ্লেতেও খালি চোখে আন্দাজ করা যাচ্ছিলো দুটি’ই আউট হতো। ভারতীয় ম্যানেজার রনবির সিং মালহোত্রা বেশ চটেও যান। পরবর্তীতে তিনি বলেছিলেন, ‘ আম্পায়ারিং নিয়ে কি বলবো? সবই তো দেখেছেন টিভি রিপ্লেতে। ‘

ওই টেস্টেই জাভাগাল শ্রীনাথের বলে এজ হয়ে উইকেটের পেছনে ক্যাচ আউট হন অজি ব্যাটসম্যান মার্ক টেলর। ভারতীয় ফিল্ডাররা যখন উল্লাস করছেন, হেয়ার মাথা নেড়ে সিদ্ধান্ত জানালেন নট আউট! একই দিনে অজি ব্যাটার অ্যালান বোর্ডারের একটি সহজ আউটও তিনি নাকচ করে দেন।

অভিষেক সিরিজেই বিতর্ক আর সমালোচনার জন্ম দিয়ে আলোচনায় ছিলেন তিনি। তাঁর বিতর্কিত সিদ্ধান্ত নিয়ে লিখতে বসলে এর শেষটা কখন হবে সেটা আন্দাজ করার মতো না!

একবার জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে এক ম্যাচে বোলাররা লেগ বিফোরের আবেদন করলেই তিনি আঙুল উঁচিয়ে সায় দিচ্ছিলেন আউটের! ওই ম্যাচে বেশ কিছু বাজে সিদ্ধান্ত দিয়েছিলেন হেয়ার। সেই ম্যাচে ধারাভাষ্য দিচ্ছিলো ‘দৃষ্টিহীন’ ধারাভাষ্যকার ডিন ডু প্লেসিস।

খেলার পর বিমান বন্দরে দেখা হলে হেয়ারকে ডিন বললেন তুমি যদি চাও আমি তোমাকে কিছু দিতে চাই? হেয়ার বেশ খুশি হয়েই সায় দিলেন! সম্মতি পেতেই ডিন নিজের কৃত্তিম চোখ খুলে হেয়ারের হাতে ধরিয়ে দিলেন। আর বললেন, ‘তুমি ঠিকমতো চোখে দেখতে পাও বলে মনে হয় না! তাই, এই কৃত্তিম চোখ তোমারই দরকার।’

তবে হেয়ার সবসময় নিজের কাজকে যথার্থ বলে দাবি করেছেন।

মুরালির নো বল কাণ্ডের পর তিনি বলেছিলেন, ‘মুরালি আসলেই চাকিং করছিলেন। তাই অন্যায় মেনে নিতে পারিনি আমি।’ তাঁর কাছে মুরালির বোলিং অ্যাকশন অবৈধ। এ ব্যাপারে অন্যান্য আম্পায়ারদের মতও একই ছিলো। কিন্তু কেউই সাহস পাচ্ছিলো না কিছু বলতে। আমি চুপ থাকতে পারিনি। আমি সঠিক সিদ্ধান্তই দিয়েছি।’

এরপর অবশ্য মুরালি বোলিং অ্যাকশনের বৈধতা প্রমাণ করতে পরীক্ষাগারে গিয়েছিলেন এবং সেখানে পরীক্ষার পর আইসিসি থেকে তাঁকে বোলিং চালিয়ে যেতেও বলা হয়। কিন্তু, তবুও হেয়ার বলেছিলেন তাঁর বোলিং অ্যাকশন সবসময়ই আমার কাছে অবৈধ থাকবে।

এমনকি অস্ট্রেলিয়ার ঘরোয়া ক্রিকেটেও তিনি সহজেই এলবিডব্লুউ আউট দিয়ে দিতেন বলেও অনেক অভিযোগ শোনা যায়। এলবিডব্লিউ ছাড়াও ক্যাচ আউট নিয়েও তিনি বহু বিতর্কিত সিদ্ধান্ত দিয়েছে। ব্যাটে লাগেনি এমন বলেও তিনি আউট দিয়েছেন! আবার ব্যাটে এজ হয়েছে, শব্দও হয়েছে; কিন্তু হেয়ার শুনতে পাননি তাই নট আউট!

হেয়ার বরাবরই নিজের সিদ্ধান্তে অটল থেকেছেন। সেটা হোক ভুল কিংবা ঠিক। নিজের ভুল কখনোই তিনি স্বীকার করেননি কিংবা মেনে নেননি। বরং নিজের সিদ্ধান্তকেই সর্বদা সঠিক বলে গর্ব করেছেন। বিতর্কিত আম্পায়ারিং ছাপিয়ে গেছে হেয়ারের ক্ষুদ্র ক্রিকেট ক্যারিয়ারও।

অস্ট্রেলিয়ার মাডগিতে জন্ম নেওয়া ড্যারেল শুরুতে কাজ করতেন চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী হিসেবে নিউ সাউথ ওয়েলস রেলওয়েতে। সেখান থেকে পেসার হিসেবে নর্থ সিডনির হয়ে খেলেছেন তিনি। তবে, ৩৩ বছর বয়সেই শরীরে কাছে হার মেনে ক্রিকেটকে বিদায় জানান। এরপর ক্রিকেটের সাথে জুড়ে থাকতে যুক্ত হন আম্পায়ারিংয়ে।

১৯৮৫ সালে আম্পায়ারিংয়ের উপর শিক্ষা গ্রহণ করেন তিনি। ১৯৮৮ সালে আম্পায়ার হিসেবে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক। এরপর ১৯৯২ সালে আম্পায়ারিংয়ে উপর উচ্চশিক্ষা নিয়ে ওই বছরই আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যাত্রা শুরু করেন। মাঝে একবার আইসিসির এলিট প্যানেল থেকে তাঁকে বাদও দেওয়া হয়! পরবর্তীতে আবারো তিনি যুক্ত হন এলিট প্যানেলে!

তবে, এত কিছুর পরও বলা হত উপমহাদেশীয় দেশগুলো ছিল তাঁর দুই চোখের বিষ। খোদ ইমরান খান এক কলামে লিখেছিলেন, ‘হেয়ার হলো সেইসব চরিত্রগুলোর একটি, যারা আম্পায়ারের কোট শরীরে চাপালেই মিনি হিটলার হয়ে যান।’

অর্জুনা রানাতুঙ্গা সরাসরি বলেছিলেন, ‘উপমহাদেশীয় দলগুলোর প্রতি হেয়ারের মধ্যে এক রকম বিদ্বেষ কাজ করে।’  ফলে, সিদ্ধান্তে আসাই যায় যে আম্পায়ারিংয়ে একই সাথে এতটা আলোচিত ও সমালোচিত চরিত্র এর আগে বা পরে আর কেউ আসেননি।

Get real time updates directly on you device, subscribe now.

আরও পড়ুন
মন্তব্যসমূহ
Loading...