মানুষটা এমনিতেই খুব নরম সরম। সে জন্য একসময় ম্যাশ, রাজ্জাকরা যা করতো!
নরম বলে, মুখ বুজে থাকে বলে একটা সম্ভবত ব্যাপার হয়েছে; নির্বিচারে এই একটা ক্রিকেটারকে নিয়ে দেশে যা খুশি বলা যায় এবং তাকে নিয়ে যা খুশি করা যায়। কারণ, সে উল্টে ফোঁস করতে শেখেনি। শেখেনি বলেই সে বাংলাদেশের ক্রিকেটের অন্যতম নিবেদিতপ্রাণ মানুষ হয়েও সবচেয়ে বেশী অবহেলা ও অভব্যতার শিকার।
হ্যা, আমাদের ইমরুল কায়েস। আমাদের সাগর।
সাগর অস্বাভাবিক পরিমানে ঘামেন তাই দ্রুত তার মাংশ পেশী ক্র্যাম্প করে। ফলে লম্বা ইনিংস খেলতে খুব কষ্ট হয়। তারপরও খেলে। খুলনায় ২০১৫ সালে জীবন বাজি রেখে খেলেছিলেন তামিমের সাথে। বিপিএল ফাইনালে ক্র্যাম্প নিয়ে ব্যাটিং করে কুমিল্লাকে জিতিয়েছিলেন।
খুলনা টেস্টে জীবনে প্রথম ফার্স্ট ক্লাশ ক্রিকেটে কিপিং করেছেন। মনে হয় দেড়শ ওভারের মতো করেছিলেন। পানিশূন্যতায় অজ্ঞান হতে বসেছিলেন। রিয়াদ গ্লাভস নিয়ে প্রান বাচিয়েছিলেন।
কখনোই কিপিং অনুশীলন করা হয় না। সম্বল বলতে মোহামেডানের হয়ে কয়েকটা ম্যাচের পার্ট টাইম কিছু ম্যাচের কিপিং অভিজ্ঞতা। একদিন বলছিলেন, ‘কিপারদের যে সারাদিন এই ওঠা বসা করতে হয়, এটাও অনেক অনুশীলন থাকতে হয়। এগুলো হঠাৎ করে করা যায় না।’
তারপরও ওয়েলিংটনে মুশফিক যখন ইনজুরিতে কিপিং করতে পারলেন না, সেই ইমরুলই রাজী হলেন নিজের শরীরের সব সীমাবদ্ধতা মাথায় রেখেও কাজটা চালিয়ে নিতে। কাজ চালিয়ে নেওয়া বলতে!
রীতিমতো বিশ্বরেকর্ড করে ফেললেন। বিশ্বের প্রথম বদলী উইকেটরক্ষক হিসেবে ৫টা ক্যাচ নিলেন এক ইনিংসে।
তবে দীর্ঘদিন ধরে ইমরুলকে দেখার অভিজ্ঞতা থেকে এই হাজার কিলোমিটার দূর থেকেই বুঝতে পারছিলাম, তাঁর শরীর আর চলছে না। যে কোনো সময় ধ্বসে পড়বে। এই সময় ইমরুলকে ওপেনিংয়ে যেতে হলো। এর কোনো বিকল্প ভাবা যেতো কি না, সেটা আরেকটা প্রশ্ন।
তবে ইমরুল ঠিকই পরদিন আবার ব্যাটিংয়ে নেমেছিলেন। আর এটাই ইমরুল কায়েস। দল হিসেবে আপনি এর চেয়ে নিবেদিত সৈনিক আশা করতে পারেন না। তার একদিকে জীবন, আরেকদিকে ক্রিকেট থাকবে; তারপরও সে ব্যাট করতে নামতে চাইবে।
তা ছাড়া তো উপায় নেই ইমরুলের। সে খুব ভালো করে জানে, সে কেউ না। তাকে প্রতিটা দিন, প্রতিটা পল নতুন করে পরীক্ষা দিতে হবে। তাকে জীবন হাতে নিয়েই বারবার নিজেকে প্রমাণ করতে হবে।
ইমরুল কায়েসের সারাটা জীবনই এমন। সারাটা জীবনই তাকে পরীক্ষা দিয়ে যেতে হয়েছে।
অথচ ঘরোয়া ক্রিকেটের এক অসীম প্রতিভা হিসেবে জাতীয় দলে এসেছিলেন। সত্যি বলতে হয়, কখনোই নিজেকে দারুনভাবে প্রমান করতে পারেননি। তিনি কখনোই তারকা হয়ে ওঠার মতো পারফরম করতে পারেননি। এটা খুবই সত্যি যে, ইমরুল আন্ডার পারফরমার।
আবার এটাও সত্যি যে, ইমরুল যেটুকু পারফরম করেছেন, তারও স্বীকৃতি পাননি। এই ২০১৮ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে তিন ম্যাচে তিন শ রানের ওপরে করলেন। তারপর আর দুটো ম্যাচে রান করতে পারেননি। তাতেই ইমরুল যেনো আজীবনের মতো বাদ পড়ে গেছেন।
কারণ?
কারণ, দলে তার চেয়ে ‘প্রতিভার’ এবং ‘সুন্দর ব্যাটিংয়ের’ কয়েক জন খেলোয়াড় আছেন। এখন ইমরুল কায়েস কখনোই মার্ক ওয়াহ আ ডি সিলভার মতো দেখনদার ব্যাটসম্যান ছিলেন না। তিনি কখনোই টেন্ডুলকার, কোহলির মতো ধারাবাহিক নন। বাংলাদেশের কোন ব্যাটসম্যান এটুকু ধারাবাহিক?
তাহলে তারা সুযোগ পেলে ইমরুল পান না কেনো? একজন কথিত প্রতিভাবান ব্যাটসম্যান এক বছর রান না করেও টিকতে পারলে ইমরুল রান করেও কেনো বাদ পড়েন?
খুব জটিল সব প্রশ্ন। এখানে সাইকোলজিক্যাল কিছু ব্যাপারও আছে। সম্ভবত ইমরুলের মধ্যে মানুষের মনে জায়গা করে নেওয়ার ব্যাপারটাই নেই। নইলে তাকে নিয়েই কেনো এতো রসিকতা হবে? তিনিই কেনো উপহাসের পাত্র হবেন?
ইমরুলের চেয়ে ‘খারাপ খেলোয়াড়’ বাংলাদেশে আসেনি? তাহলে কেনো ইমরুলকে নিয়ে কোনো আবেগ নেই আমাদের?
আমরা মানি, ইমরুলের অনেক লিমিটেশন আছে।
কিন্তু তার লিমিটেশনের কথা নিয়ে মহাকাব্য হবে না। তাকে এই লিমিটেশন নিয়ে প্রতিটা সকালে নতুন করে জীবন পরীক্ষায় নামতে হবে। নামটার মতোই কিনারাহীন সাগর হয়ে আসবে তার সামনে প্রতিদিনের জীবন।