ওজন নয়, আলোচনায় তাঁর ক্রিকেট

রাকিম রশন শেন কর্নওয়াল।

এখনও অবধি খুব বলার মতো কিছু করে ফেলতে পারেননি। তবে ইদানিং আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে আছেন তিনি। বাংলাতে প্রবাদ আছে-প্রথমে দর্শনধারী, এরপর গুণবিচারী। কর্নওয়াল আলোচনায় এসেছেন দর্শনে। তবে কিছু সময় পর অবশ্য সবাই জেনেছে, গুণটাও নেহায়েৎ কম নেই এই অফ স্পিনারের।

ওজন ও উচ্চতার জন্য প্রথম পরিচিতি পেয়েছিলেন। কিন্তু রাকিম বুঝিয়ে দিয়েছেন, তিনি কেবল শরীর দেখাতে আসেননি। ফলে শরীর নিয়ে বাড়াবাড়ি নয়, ক্রিকেটার রাকিমকে নিয়েই আলোচনা হোক।

১ ফেব্রুয়ারী, ১৯৯৩; এন্টিগাতে জন্ম নেন রাকিম কর্নওয়াল। ওয়েস্ট ইন্ডিজের দ্বীপগুলো ছড়ানো ছেটানো। প্রত্যেকটা আলাদাভাবে স্বায়ত্তশাসিত। এন্টিগা তার মধ্যেই একটি। কর্নওয়ালের গল্পটাও ঐ অন্যসসব ক্রিকেটারের মতই-খুব ছোটবেলা থেকে শখ ক্রিকেটার হবেন।

 

সব ক্রিকেটারের এই শখের পেছনে শখের কারিগর থাকেন। কারো দেখা গেল বাবা বড় ক্রিকেটার, তিনি ছেলেকে ক্রিকেটার বানাবেন। কারো দেখা গেল পুরো পরিবারটাই ক্রিকেটে মজে গেছে। রাকিম কর্নওয়ালের এই শখের কারিগর হলেন কর্নওয়ালের মামা; উইলডেন কর্নওয়াল। যিনি নিজেও ৫৩ ফার্স্ট ক্লাস ম্যাচ খেলেছেন!

মামার এই পদাঙ্ক অনুসরণ করে খুব ছোটবেলা থেকেই কর্নওয়াল ক্রিকেট খেলতে শুরু করেন। এমনিতে এন্টিগা ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের মধ্যে তৃতীয় বৃহত্তম। তার ওপর এই এন্টিগা থেকেই উঠে এসেছেন স্যার ভিভ রিচার্ডস, কার্টলি অ্যামব্রোসের মত তারকারা। এন্টিগার ওপর তাই উইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের একটা সদয় চোখ সবসময়ই থাকে। কর্নওয়ালের ক্রিকেটে উঠে আসা তাই খুব কঠিন কিছু ছিল না।

ওয়েস্ট ইন্ডিজে একটা কথা খুব প্রচলিত আছে। সেখানকার নারকেল গাছ ধরে ঝাঁকি দিলেও নাকি টুপ করে পেস বোলার ঝরে পড়ে। রাহকিম কর্নওয়াল তাই যখন ‘বোলিং’ এর দিকে ঝুঁকে গেলেন, খুব স্বাভাবিকভাবেই তাঁর পেসার হওয়ার একটা সম্ভাবনা ছিল। অমন দীর্ঘ শরীর নিয়ে পেসারই তো হওয়ার কথা। সেই সম্ভাবনা উড়িয়ে দেন রাকিম নিজেই। তিনি পেসের চাইতে স্পিনটাই বেশি ভালবাসতেন!

ক্রিকেট খেলতে শুরু করা রাকিমের বড় মঞ্চে সুযোগ পেতে অবশ্য খুব বেশি সময় লাগেনি। মাত্র বিশ বছর বয়সেই তাঁর সামনে খুলে যায় ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেটের দুয়ার। ঘরোয়া খেলায় তো ডাক পাওয়া হল। কর্নওয়াল কিন্তু এতটুকুতে সন্তুষ্ট নন। তিনি খেলতে চান মেরুন জার্সি পরে কিংবা দ্বীপের লোগো বুকে সাদা জার্সিতে। কর্নওয়ালের অবশ্য তক্ষুণি আন্তর্জাতিক মঞ্চে ডাক আসেনি। তবে আন্তর্জাতিক কোন একটা দলের বিপক্ষে খেলার স্বাদ তিনি পেয়ে যান ২০১৬  সালেই। ভারতের উইন্ডিজ সফরে তিনি ডাক পেয়েছিলেন ‘ওয়েস্ট ইন্ডিজ বোর্ড প্রেসিডেন্ট একাদশ’ দলে!

 

 

না হোক আন্তর্জাতিক্ মঞ্চ, ভারতের সাথে সেই শুরুর মঞ্চটা কিন্তু দুর্দান্তই গেছিল কর্নওয়ালের। ব্যাট হাতে তো দলের সর্বোচ্চ ৪১ রান করেছিলেনই, বল হাতেও ৫ উইকেট নিয়ে ভারতের ব্যাটিং লাইনআপকে ধ্বসিয়ে দিয়েছিলেন। এরপরই বেশ নিয়মিতই উইন্ডিজের ‘এ’ দলটাতে সুযোগ পেতে থাকলেন তিনি। তবে কর্নওয়াল যে আন্তর্জাতিক মঞ্চের জন্যে যোগ্য এমন একটা বার্তা প্রথম ওঠে ২০১৭ সালে। উইন্ডিজের ঘরোয়া ৫০ ওভারের টুর্নামেন্ট ‘সুপারফিফটি’ র ঐ আসরে তিনি যখন ৫০ গড়ে  রান করেন; স্ট্রাইক রেটও রাখেন ১২০ এর আশেপাশে।

ব্যাটিং তো গেল, বোলিংয়েও তিনি নিয়ে নেন ১০ উইকেট; ইকোনমি রেট ৩.৬৩!

ব্যাটিং স্ট্রাইক রেট ১২০, বোলিংয়ের ইকোনমি ৩.৬৩; আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে একেবারে আরাধ্য ক্রিকেটার। তবে উইন্ডিজের নির্বাচক প্যানেলের প্রধান কোর্টনি ব্রাউনি তখনই কর্নওয়ালকে দলে নিতে একেবারেই সম্মত ছিলেন না। তিনি বরং কর্নওয়ালকে ‘স্পেশাল ট্যালেন্ট’ উল্লেখ করে বলেন কর্নওয়ালের এখনও স্পেশাল ট্রেনিং লাগবে আর সাথে লাগবে এক ডায়েট! সে মোতাবেক কর্নওয়ালকে কিন্তু এক ডায়েটিশিয়ানও দেওয়া হয়েছিল।

রাকিমের ওয়েস্ট ইন্ডিজ দলে ডাক পাওয়ার আরেকটা সমস্যা ছিলো, তার ওজন।

হ্যা, তার ওজন ১৪০ কেজি ওজন নিয়ে অনেক কথা হয়েছে। সাড়ে ছয় ফিট একজন এই বিশাল ওজনের মানুষ এমনিতে আপনার আগ্রহের কারণ হতে পারেন। কিন্তু আজকের আধুনিক ক্রিকেটে এরকম ক্রিকেটারের ফিটনেস নিয়ে একটা সন্দেহ তোলা হবেই। রাকিবের ক্ষেত্রেও সেটা হয়েছিলো। ফলে রাকিমকে দফায় দফায় প্রমাণ দিতে হয়েছে যে, এই বিশাল শরীর নিয়েও তিনি দিব্যি ফিট।

ঘরোয়া ক্রিকেটে কিন্তু কর্নওয়ালের দুর্দান্ত পারফরম্যান্স তখনও চলছে। সেই দুর্দান্ত হওয়ার মাত্রা এতই বেশি যে তিনি টেস্ট অভিষেকের আগে যে কয়টি ফার্স্ট ক্লাস মৌসুম খেলেছেন, কোনটাতেই ৪০-এর কম উইকেট পাননি। কিন্তু দুর্দান্ত পারফর্ম করলে কি হবে, আন্তর্জাতিক মঞ্চে সহসাই ডাক আসছিল না কর্নওয়ালের। সেই ডাক পেলে অবশেষে, আরেক অনিষ্টে। এবারও দৃশ্যপটে ভারত, সেই উইন্ডিজ সফরেই। রোস্টন চেজ হঠাৎ তখন ইনজুরিতে পড়ে গেলে স্পিনার হিসেবে ডেকে নেওয়া হয় কর্নওয়ালকে। তারপর থেকে তিনি এখন অব্দি টেস্ট খেলেছেন মোটে তিনটি, এই তিন টেস্টে উইকেট নিয়েছেন ১৩ টি। প্রতি উইকেট নিতে বল করতে হয়েছে ৭১ টি। সাদা পোশাকের হিসেবে যা বেশ ভাল বলা যায়।

রাকিম কর্নওয়ালের বোলিংয়ের একটি বিশেষ ধারা আছে। এমনিতেই তাঁর উচ্চতা সাড়ে ছয় ফিট; বোলিং অ্যাকশনেও হাত করে ফেলেন উঁচু। স্পিনটাতে তাই তিনি বল ফেলেন একটু উঁচু থেকেই; অঙ্কের হিসাবে মাটি থেকে যা দুই মিটারের বেশি। এই অধিক উচ্চতা থেকে বল ছোঁড়ার জন্যে বল অনেক বেশি সময় বাতাসে থাকে, আর বলের স্পিড ব্যাটসম্যানের অনুমানের সাথে ফারাক হয়ে যায়। নিজের বোলিংয়ের বেশ কিছু ভ্যারিয়েশনও আছে কর্নওয়ালের, সবচেয়ে ভাল অবশ্য অফ ব্রেকটাই করেন তিনি।

এতক্ষণ যার গল্প বললাম, সেই কর্নওয়াল এসেছেন বাংলাদেশে। খেলবেন টেস্ট সিরিজে। ইতিমধ্যে প্রস্তুতি ম্যাচে ৫ উইকেট নিয়ে নিজের আগমনের জানান দিয়ে ফেলেছেন। এমনিতে আমরা টেস্টে টার্নিং উইকেট বানাই। এবারও যদি সেরকম কিছু করি, রাকিম ছোটখাটো একটা হুংকার কিন্তু তুলতেই পারেন!

লেখক পরিচিতি

আদ্যোপান্ত স্টোরিটেলার!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link