প্রথম ছয় খেলায় ইতোমধ্যে নয় পয়েন্ট খুইয়ে মৌসুমটা ধীর গতিতে শুরু করেছে ইয়ুর্গেন ক্লপের লিভারপুল। তবে এই অবস্থার দ্রুত পরিবর্তন না হলে লিগ শিরোপা তো দূরে থাক টপ ফোরে থাকাই কঠিন হয়ে যাবে অল রেডদের জন্য।
লিভারপুলের এই মন্থর গতিতে মৌসুম শুরু করাটা নতুন কিছু নয়। তবে দলে একাধিক নতুন খেলোয়াড়ের আগমন এবং সাদিও মানের মত একজন অভিজ্ঞ ও নির্ভরশীল খেলোয়াড়কে হারিয়ে লিভারপুলের টিম রসায়ন যেন ঠিক জমে উঠছে না।বিবর্তন মধ্যে দিয়ে চলা এই লিভারপুল দলটি এখনো পুরোপুরি দাড়িয়ে উঠতে পারেনি। তবে অনেকেই আবার মনে করছেন বিবর্তন নয় বরং ক্লান্তি ভর করেছে এই দলটিকে তাই পারফরমেন্সে ঘটছে তারতম্য।
মার্সিসাইড ডার্বিতে লিভারপুলের এই দুই রুপেরই দেখা পাওয়া গেছে। কখনো তারা ক্ষুরধার আক্রমণ করে প্রতিপক্ষের ডি-বক্সর সামনে নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করছে তো কিছুক্ষণ পর এভারটনের কাউন্টার অ্যাটাক আটকাতেই হিমশিম খাচ্ছে। অল রেডরা যেন এখনো সঠিক ছন্দটা ঠিক ধরতে পারেনি। এখন তারা দলের সঠিক সংমিশ্রণটা পায়নি। আর এর সবচেয়ে বড় উদাহরণ হল দলের দুই ফুল ব্যাক অ্যান্ডি রবার্টসন এবং ট্রেন্ট আলেকজান্ডার আর্নল্ড যারা মৌসুম শুরুর ছয় ম্যাচ পরও নিজেদেরকে হারিয়ে খুঁজছেন।
দলের দুই ফুল ব্যাক আক্রমণ করছে আর লিভারপুল একের পর এক গোল পাচ্ছে এ খুবই পরিচিত এক চিত্র কিন্তু এই মৌসুমে নিয়মিত এই দৃশ্যটির দেখা পাওয়া যাচ্ছে না। দলের এই দুই ফুলব্যাক এমন আক্রমনে উঠে আসাটা অলরেডদের খেলার কৈশলের অংশ, তাই তারা ভাল না খেললে দলে তার বিরুপ প্রভাব দেখা যায় বিশেষ করে দলের আক্রমণভাগে এর তীব্র প্রভাব পড়ে।
এভারটনের বিপক্ষে খেলায় দলের লেফট ব্যাক অ্যান্ডি রবার্টসনকে মূল একাদশের বাইরে রাখা হয়, তাঁর জায়গায় কস্তাস সিমিকাস খেলেন। দলের রাইট ব্যাক ট্রেন্ট আলেকজান্ডার আর্নল্ডকেও খেলার ৫৮ মিনিটেই মাঠ থেকে তুলে নেন ক্লপ, এর আগের সপ্তাহে নিউক্যাসেলের সাথে খেলায়ও তাকে ম্যাচের ৭১ মিনিটেই বদলি করা হয়েছিল।
ক্লপের এমন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পিছনে মূল কারণ হল তাদেরকে ইনজুরিমুক্ত রাখা। ইঞ্জুরির কারনে দলের মিডফিল্ডের একের পর এক খেলোয়াড় হারান। তাই দলের এই দুই গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে হারাতে চান না। ‘পারফর্মেন্সের কারণে আমি এই পরিবর্তন করিনি, তবে আমি জানি ট্রেন্ট এর থেকেও ভাল খেলার সামর্থ্য রাখে। ট্রেন্ট এবং রবার্টসন মৌসুমের প্রায় সব ম্যাচই খেলে থাকে। তবে আমাদের এই দুই জায়গায় খেলার মত বদলি খেলোয়াড় আছে, তাই আমরা তাদেরকে বিশ্রাম দিতে এবং খেলায় আরো নতুন প্রাণ সঞ্চার করতে এই পরিবর্তন গুলো করেছি’ বলেন ক্লপ।
ইয়ুর্গেন ক্লপ এই ব্যাপারটা এড়িয়ে গেলেও এই লিভারপুল দলে কি যেন একটা নেই। তাদের খেলা দেখলে মনে হয় দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে সংযোগটা ঠিকঠাক হচ্ছে না। অথচ বছরের পর বছর দলের খেলোয়াড়দের মধ্যে থাকা বোঝাপরার দুর্দান্ত প্রদর্শনই ক্লপের লিভারপুলের বড় এক শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হত।
লুইস দিয়াজ, ফ্যাবিও কারভালহো এবং ডারউইন নুনেজের সাথে মিডফিল্ডে হার্ভি এলিয়টের অন্তর্ভুক্তি যেন দলের ভারসাম্য নষ্ট করে দিয়েছে। রবার্টসন আগে আমের সাথে যেভাবে লিঙ্ক আপ প্লে গুলো করতেন জিয়াজের সাথে তেমনটি এখন হয়ে উঠেনি। কখনো তারা সাব ঠিকঠাক করছেন তো কখনো একে অপরের খেই হারিয়ে ফেলছেন।
এর অন্যতম কারণ হল দিয়াজ, মানের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক উঙ্গার। দিয়াজ সাধারণত বল নেওয়ার জন্য নিচে নামতে পচ্ছন্দ করে এবং একাই বল পায়ে ড্রিবলিং করে প্রতিপক্ষকে আক্রমণ করার জন্য যেতে চায়। রবার্টসন এবং দিয়াজ নিজেদের মধ্যকার বোঝাপড়াটা যত দ্রুত পরিস্কার করবেন তত দ্রুত অল রেডরা এর সুফল দেখতে পারবেন।
দলের আরেক দক্ষিণ আমেরিকান ফুটবলার উরুগুয়ের ডারউইন নুনেজর কাছে লুকিয়ে আছে ট্রেন্টের পারফর্মেন্সের চাবিকাঠি। ২৩ বছর বয়সী নুনেজ এভারটনের সাথে খেলায় কোন গোল না পেলেও প্রতিপক্ষের ডি বক্সে তিনি কি নিদারুণ আতঙ্ক সৃষ্টি করতে পারেন তার প্রদর্শনী করেছেন। ট্রেন্ট এই উরুগুইয়ান স্টাইকারের জন্য ঠিকঠাক বল চালান করতে পারলে তা লিভারপুলের গোল খরা অনেকটাই দূর করে দিবে।
ইতোমধ্যে এই ইংলিশ রাইট ব্যাকের খেলায় ব্যাপক পরিবর্তন এসেছে, ফিলিপ লাম, কিমিখ এবং ক্যানসেলোর মত তিনি ইনভার্টেড ফুল ব্যাক হিসেবে খেলছেন। সাইড লাইন আকড়ে দাড়িয়ে থাকার বদলে তিনি মধ্য মাধে এসে বল সাপ্লাই দিচ্ছেন, একজন প্লেমেকারের রোল পালন করছেন। এছারাও ট্রেন্টকে বার বার নতুন সেন্টার ব্যাকের সাথে খেলতে হচ্ছে যা তার ধারাবাহিকভাবে পারফর্ম করার উপর প্রভাব ফেলছে।
হেন্ডারসন এবং জেমস মিলনারের মত ওয়ার্ক হর্স ঘরানার মিডফিল্ডাররা মাঝমাঠ সামলাবেন এবং ট্রেন্ট, সালাহরা প্রতিপক্ষের ডি বক্সে ত্রাস ছড়াবেন, মোটামুটি এই ছিল লিভারপুলের খেলার নকশা। তবে ইচ্ছা করেই হোক বা অনিচ্ছায় হোক লিভারপুলের এই খেলার ধরনে পরিবর্তন আসছে, আর এর মূল কারণ হল মিডফিল্ডারের ধরনে হঠাৎ পরিবর্তন।
থিয়াগো, এলিয়ট, কারভালহো, জোন্সের মত টেকনিকাল ফুটবলার যারা বল পায়ে রাখতে চায় এবং আক্রমণের অংশ হতে চায় এই ধরনের মিডফিল্ডার দলে আসার পর ক্লপের লিভারপুলের খেলার ধরনে কাঠামোগত পরিবর্তন আনতে হয়। আর ভবিষ্যতেও যে লিভারপুল এই ধরনের টেকনিকাল ফুটবলারের দিকেই বেশি ঝুকবে তার বড় উধাহরন হল জুভেন্তাসের আর্থার মেলোরকে ক্লপের দলে ভেড়ানো।
ট্রেন্ট এবং রবার্টসন লিভারপুলের সাফল্য নিশ্চিত করতে হলে এই দুই জনকেই লাগবে তাদের বদলি হিসেবে যারা আছে তাদের কেও আক্রমণ বা রক্ষণে তাদের সমকক্ষ নন।
এই সপ্তাহে ডিয়েগো আর্মান্ডো ম্যারাডোনা স্টেডিয়ামে নাপলির সাথে ম্যাচ দিয়ে ২০২২-২৩ মৌসুমের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের যাত্রা শুরু করবে লিভারপুল।
আয়াক্স, নাপলি এবং রেঞ্জার্সদের নিয়ে গরা গ্রুপ থেকে লিভারপুল একটু ভুল করলেই রাউন্ড অফ সিক্সটিন মিস হয়ে যেতে পারে। তবে গত ৫টি চ্যাম্পিয়নস লীগের ৩টি তে ফাইনালে খেলা অল রেড সমর্থকরা এই আশাই করবে যে প্রিমিয়ার লিগের শনির দশা কাটিয়ে তাদের প্রিয় ক্লাব ইউরোপে একটা শুভ সুচনা করুক, এবং তা করতে সক্ষম হলে প্রিমিয়ার লিগেও যেন তার ছোঁয়া লাগে।