বার্লিন, জুন ২০১৫। রাতের আকাশে উড়ছে আতশবাজি, মাঠে চারদিকে সোনালি কনফেটি। বার্সেলোনা চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে। হইচই, চিৎকার, গানের ভিড়ে এক কোণের ছোট্ট ফ্রেমে আটকে আছে এক অপার্থিব দৃশ্য।
একটা ছোট্ট মেয়ে দুই হাতে মাটি খুঁড়ে বার্সেলোনার পতাকা গেঁথে দিচ্ছে সবুজ ঘাসে। তার ছোট্ট আঙুলের শক্তি কম, পতাকাটা কিছুটা দুলছে, কিন্তু সে হাসছে, চিৎকার করছে, লাফাচ্ছে। বাবার দল চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে! বাবার মুখভর্তি হাসি, মেয়ের চোখভর্তি তারা। আলো, গান, ক্যামেরার ফ্ল্যাশ, অস্তিত্ব নেই কিছুরই। তখন শুধু তারা দুজন আর সেই পতাকা।
জানা, লুইস এনরিকের ছোট্ট মেয়ে জানা। একটা ছোট্ট ঝড়, একটা ছোট্ট রোদ্দুর, বাবার জীবনের সবচেয়ে উজ্জ্বল আলো।
কিন্তু গল্পটা থেমে যায় ২০১৯ সালের আগস্টে। নয় বছরের জানা হারিয়ে যায় পৃথিবী থেকে। এক অদৃশ্য শত্রু, হাড়ের ক্যান্সার, নিয়ে যায় বাবার সবচেয়ে প্রিয় স্বপ্নটাকে। হাসপাতালের বিছানার পাশে বসে থাকা বাবা,একসময় যে চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে ঠাণ্ডা মাথায় স্ট্র্যাটেজি সাজাতো, এখন দিশেহারা, ছিন্নভিন্ন।
বন্ধ ঘরের ভেতর, ছোট্ট জানার খালি বিছানা, খালি স্কুলব্যাগ, খালি চুলের ক্লিপ, আর বাবার চোখে শুকিয়ে যাওয়া কান্নার রেখা।বাবার কাছে পড়ে থাকে শুধু শূন্যতা। যে শূন্যতা কোনো ট্রফি, কোনো স্টেডিয়ামের উল্লাসে ভরতে পারে না। কোচিং ছেড়ে দেন তিনি। নিজেকে গুটিয়ে নেন, ঘরবন্দি হন, কিন্তু জানা থাকে। জানা থাকে প্রতিটি নিঃশ্বাসে, প্রতিটি রাতের স্বপ্নে।
বছর কেটে যায়। ক্ষত শুকায় না, জীবন থেমেও থাকে না। লুইস এনরিকে প্যারিসে যান, পিএসজির কোচ হয়ে ফেরেন মঞ্চে। কিন্তু এবার ফুটবল শুধু ফুটবল নয়; এটা এক অসমাপ্ত গল্পের দ্বিতীয় অধ্যায়।
‘আমি জানাকে নিয়ে মাঠে নামি’, বলবেন তিনি। ‘ওর শক্তি আমার সাথে আছে, প্রতিদিন।’ প্রেস কনফারেন্সে যখন জানতে চাওয়া হয়, কীভাবে এতটা ভেঙে পড়ার পর ফিরে এলেন, তার চোখে এক বিন্দু জল চিকচিক করে ওঠে, কিন্তু ঠোঁটে হাসি। ‘আমি খুব ভাগ্যবান। নয় বছরের জন্য জানা আমার সাথে ছিল।’
শেষমেষ সেই রাত আসে। ২০২৫ সালের চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনাল। পিএসজি বনাম ইন্টার মিলান। বড় পর্দায় বারবার দেখানো হচ্ছে এনরিকে’র মুখ, কঠোর, স্থির, কিন্তু ভেতরে কোথাও এক অদৃশ্য আলো জ্বলছে, এক ছোট্ট তারা, যে আকাশ থেকে তাঁকে দেখছে। প্রতিটি নির্দেশ, প্রতিটি হাততালি, প্রতিটি ছোট্ট উদযাপন যেন কারও জন্যই, জানা’র জন্যই।
শেষ বাঁশি বাজে। পিএসজি চ্যাম্পিয়ন।খেলোয়াড়রা কোচকে জড়িয়ে ধরে, উল্লাসে ফেটে পড়ে। চারদিকে গান, কান্না, জয়ধ্বনি। এনরিকে ছুটে যান গ্যালারির দিকে। কে যেন হাতে তুলে দেয় একটা কালো টি-শার্ট। পরম মমতায় আগলে ধরে টি-শার্টটা গায়ে জড়িয়ে নেন এনরিকে। বুকের কাছে খোদাই করা জানা’র সেই ছবিখানা।
সব আলো নিভে গেলে এনরিকে একা দাঁড়িয়ে থাকেন পিচের ঠিক মাঝখানটায়। বছর দশেক আগের মতই। আকাশের দিকে তাকিয়ে, খুব ধীরে হাত তোলে, যেন কোনো অদেখা শিশুর দিকে হাত নাড়া দিচ্ছেন, যেন বলছেন, ‘দেখলে, জানা? পাপা পেরেছে।’
এটা কোনো ফুটবলের গল্প নয়। এটা হারিয়ে ফেলা আর হৃদয়ে বয়ে বেড়ানো এক স্বপ্নের গল্প। একটা ছোট্ট হাতের, এক শূন্য বিছানার, এক থেমে যাওয়া হাসির গল্প।
লুইস এনরিকে জানেন, কোনো ট্রফি, কোনো জয়, কোনো মঞ্চ সেই শূন্যতা ভরতে পারবে না। কিন্তু তিনি এগিয়ে যান, কারণ তাঁর আকাশে একটা তারা আছে, যে তাকে পথ দেখায়, রোজ রাতে বাবার কাঁধে মাথা রাখে, নি:শব্দে বলে, ‘চলো, পাপা, আরেকটা জয়, আরেকটা গল্প। বার্লিন, মিউনিখ ছুয়ে আমরা বিজয়ের পতাকা গেথে দেব ইউরোপের প্রতিটা প্রান্তে।’