আঙুলে জাদু, চিৎকারে বিদ্রোহ

অজি স্লেজিংয়ের মুখে কড়া জবাব ছিল তাঁর হিংস্রতায়, আর বিদেশের মাঠে ভারতের পতাকাটা ওড়ানোর ইচ্ছে ছিল দম্ভে। ভাজ্জি বল হাতে তিন আঙুলে পাক দিচ্ছেন, বল পড়ে ঢুকে যাচ্ছে ব্যাট-প্যাডের ফাঁকে, আর ভাজ্জি চিৎকার করছেন, ‘হাউজ্জ্যাট!’ এই বিশ্বাস, এই চিৎকারের নাম দ্য টার্বুনেটর।

একটা ফোন কলেই বদলে গিয়েছিল জীবনের ভাগ্য। ফোনের ওপারে ছিলেন এক ‘দাদা’—সৌরভ গাঙ্গুলি। আর ও পাশ থেকে হাত বাড়িয়ে বলেছিলেন, ‘হাই ভাজ্জি। বোর্ডার-গাভাস্কার ট্রফিতে তুমি আমার দলে থাকছো।’

হয়তো সৌরভ তখনও জানতেন না, এই টেলিফোনটা একদিন রূপকথা হয়ে যাবে। তবে এতটুকু জানতেন, হারিয়ে যেতে বসা একজন স্পিনারের আঙুলে ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য একটা বিপ্লব লুকিয়ে আছে। সেই বিপ্লবের নাম ছিল হরভজন সিং।

তখন ২০০১ সাল। ভারতীয় ক্রিকেট রক্ষণাত্মক সময় পেরিয়ে ঠিক মাঝপথে দাঁড়িয়ে, সাহস আর সংশয়ের মাঝখানে দোল খাচ্ছে। আর ঠিক তখনই, কাঁধে পাগলামি আর আঙুলে জাদু নিয়ে ভারতের জার্সি পরলেন হরভজন সিং।

সিরিজটা স্টিভ ওয়াহর অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে। কলকাতায় ইতিহাস, চেন্নাইয়ে জাদু। আর মাঝখানে ইডেন গার্ডেন্সের সেই মুহূর্ত—যেখানে এলবিডব্লু হয়ে ফেরেন স্টিভ ওয়াহ, আর ভাজ্জির চিৎকারে ভারতীয় ক্রিকেট বুঝে যায়, নতুন এক অধ্যায় শুরু হয়ে গেছে।

৩ ম্যাচে ৩২ উইকেট। টারবাইন ঘোরানো গতি নয়, বা রিভার্স সুইংয়ের হাওয়া নয়, শুধু আঙুলের ঘূর্ণি আর অফ স্পিনের বিদ্রোহ দিয়ে ভাজ্জি বানিয়ে ফেললেন অজিদের এক মায়াময় বিভ্রম। ব্যাটাররা তখন ব্যাট নয়, দু’হাতেই বিশ্বাস হারাচ্ছেন।

না, গল্পটা কেবল একটা সিরিজে আটকে নেই। এটা সেই ছেলের গল্প, যে মাত্র ১৭ বছর বয়সে বোর্ড সভাপতি একাদশে জায়গা পায়, বাবার স্বপ্নকে বাস্তব করতে। পাঞ্জাবের মাঠে নিজেকে প্রমাণ করেও জাতীয় দলে প্রথম সুযোগে ব্যর্থ হয়, ছিটকে পড়ে সিলেকশন কমিটির খাতা থেকে। কিন্তু, ‘ভাজ্জিরা হার মানে না’।

সৌরভের ভরসা থেকে শুরু করে কুম্বলের ছায়ায় বেড়ে ওঠা, বিশ্বকাপের মঞ্চে ভারতীয় রঙের হয়ে দুসরা বলে বিপক্ষকে বিভ্রান্ত করা — সবই ছিল একটার পর একটা ক্যারেক্টার ট্রান্সফরমেশন। ভাজ্জি হয়ে ওঠেন দ্য টার্বুনেটর।

২০০৩ সালে আঙুলে চোট পেলেন। অপারেশন করতে হল। এই চোটের পর ফিরবেন তো? সংশয় উঠল। সৌরভ দোলাচলে, দলে রাখা যাবে কিনা। তখন আবার সেই একই ছেলেটার চিৎকার, আমি খেলব। আঙুলে স্ট্র্যাপ বেঁধে খেলে গেলেন। যতক্ষণ শরীর চলেছে, ততক্ষণ দেশটার নামে ঝুঁকে গেছেন।

থেমে যাননি কখনও। গ্রেগ চ্যাপেল নামক অন্ধকার অধ্যায় পেরিয়ে ধোনির রাজত্বেও লেগে থেকেছেন। সাদা বলের ফরম্যাটে হয়তো চোট থাবা বসিয়েছে। কিন্তু, ভারতের স্পিনিং হেরিটেজে তাঁর নামটা লাল বলের অবিসংবাদিত বিস্ময়।

তিনি ছিলেন কুম্বলের পাশে দাঁড়ানো এক পাঞ্জাবি আগুন। যেখানে কুম্বলের গুগলি হত নিঃশব্দ বিষ, সেখানে ভাজ্জির দুসরা ছিল বজ্রের মতো বিস্ফোরক। ২৫ বার টেস্টে ৫ উইকেট, ৪১৭ টেস্ট উইকেট — মুত্তিয়া মুরালিধরনের পর অফ স্পিনের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র।

অজি স্লেজিংয়ের মুখে কড়া জবাব ছিল তাঁর হিংস্রতায়, আর বিদেশের মাঠে ভারতের পতাকাটা ওড়ানোর ইচ্ছে ছিল দম্ভে। ভাজ্জি বল হাতে তিন আঙুলে পাক দিচ্ছেন, বল পড়ে ঢুকে যাচ্ছে ব্যাট-প্যাডের ফাঁকে, আর ভাজ্জি চিৎকার করছেন, ‘হাউজ্জ্যাট!’ এই বিশ্বাস, এই চিৎকারের নাম দ্য টার্বুনেটর।

লেখক পরিচিতি

সম্পাদক

Share via
Copy link