সৌদি আরবের সাথে দ্বিতীয় গোলটা হজম করার পর পর্দায় ভেসে উঠেছিলো তাঁর হতবিহবল মুখটা। যেন নিজেকে বিশ্বাস করতে পারছিলেন না।
তাহলে কী গত তিনটা বছর তার মিথ্যে ছিলো? ৩৬টা ম্যাচে না হারাটা তার স্বপ্ন ছিল? দুটো ট্রফি জেতাটা তাহলে অলীক কিছু ছিলো? তাহলে বিশ্ব মঞ্চে প্রথম ম্যাচেই এসে ধ্বসে পড়লো তার তিল তিল করে সাজানো পরিকল্পনা!
না, কোনো পরিকল্পনা মিথ্যে হয়নি। সৌদি আরবের বিপক্ষে ওই ‘রিয়েলিটি চেক’-এর পর থেকে নতুন করে আবার শুরু করেছেন তিনি। প্রতিটা ম্যাচে নতুন নতুন কৌশল নিয়ে সামনে এসেছেন। এরপর প্রত্যেকটা ম্যাচ জিতে সেই প্রথম ম্যাচেই পায়ের তলে মাটি হারানো লোকটা আজ ফাইনালে।
হ্যাঁ, লোকটার নাম লিওনেল স্ক্যালোনি।
মাঠে তো অবশ্যই আর্জেন্টিনার হয়ে জাদু দেখাচ্ছেন আলভারেজ, এনজো ভার্নান্দেজ, ম্যাক অ্যালিস্টার, আকুনারা। এবং অবশ্যই জাদুর দণ্ড সেই লিওনেল আন্দ্রেস মেসির হাতে। কিন্তু এই সবকিছুর পেছনে রয়েছেন আসলে আরেকজন লিওনেল-ওই লিওনেল স্ক্যালোনি।
মেসি আজ ১৬ বছর ধরে আর্জেন্টিনার হয়ে খেলছেন। কিন্তু এমন বিধ্বংসী রূপে এর আগে কখনোই জাতীয় দলে তাকে দেখা যায়নি। আর্জেন্টিনাও ২০০২ সালের পর এমন ভয়াবহ দল আর কখনো হয়ে ওঠেনি। আর এই দুই হয়ে ওঠার পেছনের মানুষ অবশ্যই স্ক্যালোনি।
সত্যি বলছি, আর্জেন্টিনার দায়িত্ব নেওয়ার আগে আমি তার নাম জানতাম না; আপনারা কী জানতেন?
নাম জানানোর মত হাই প্রোফাইল কোচ ছিলেন না তিনি। বিয়েলসা থেকে শুরু করে ম্যারাডোনা, সাবেইয়া বা সাম্পাওলি; সবার একটা সেলিং পয়েন্ট ছিল। কিন্তু স্ক্যালোনির কী ছিলো? তিনি কেনো আর্জেন্টিনার মত হেভি ওয়েট দলের দায়িত্ব পেলেন? তিনি কী করে বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়টির সেরা বের করে আনার মিশন পেলেন?
স্রেফ বয়সভিত্তিক দলে স্ক্যালোনির কিছু কাজ দেখে আর্জেন্টাইন ফেডারেশন তার ওপর এই ভরসাটা রেখেছে। আর এটাই আসলে তুরুপের তাস হয়ে গেলো।
স্ক্যালোনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন একটা হারের ভেতর দিয়ে। এরপর টানা তিন বছর আর হারেননি। এর মধ্যে কোপা আমেরিকা ও ফিনালেসিমা জিতেছেন। তবে স্ক্যালোনির সেরা কৃতিত্ব হলো মেসির থেকে সেরাটা বের করে আনা।
ফুটবলের পরিসংখ্যান খুজে পাওয়া কঠিন বলে ঠিক সংখ্যাটা বলতে পারছি না; তবে এটা নিশ্চিত যে, মেসি তার পুরো ক্যারিয়ারে আর্জেন্টিনার হয়ে যা পারফরম করেছেন, তার চেয়ে ভালো করেছেন এই তিন বছরে। আর এর পেছনে অবম্যই স্ক্যালোনির একটা বড় কৃতিত্ব।
এর আগে আর্জেন্টিনার যত কোচ ছিলেন, তারা আসলে মেসির কাঁধে সওয়ার হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তারা মেসিকে কেন্দ্র করে খেলেছেন। আর স্ক্যালোনি করলেন তার উল্টো। তিনি মেসিকে খোলা মাঠে ছেড়ে দিলেন। আর বাকী দলকে বললেন, এই লোকটা যাই করুক, তোমাদের তার জন্য খেলতে হবে।
ব্যাস, ম্যাজিক হয়ে গেল।
পুরো দলও তাদের হিরোর জন্য ঝাপিয়ে পড়ল। আর মেসিও শেষ বেলায় এমন অনুরক্ত একটা বাহিনী পেয়ে নিজেকে উজাড় করে দিলেন।
স্ক্যালোনি দায়িত্ব নেওয়ার আগে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি হোমওয়ার্ক করেছেন মেসিকে নিয়ে। আর তার ফল হিসেবে তিনি দেখেছেন, পেপ গার্দিওলা যেভাবে মেসিকে ফ্রি রেখেছিলেন, সেটাই মেসির সেরাটা পাওয়ার একমাত্র উপায়। আর সেই কাজটাই এখন স্ক্যালোনি করেছেন।
এর সাথে মেসির ওয়ার্কলোড ম্যানেজ, তাকে বল সাপ্লাই দেওয়া এবং তার পাসকে কাজে লাগানোর জন্য দলকে তৈরি করার ব্যাপার তো ছিল।
তবে মেসির সেরাটা বের করাই স্ক্যালোনির একমাত্র কৃতিত্ব নয়। স্ক্যালোনিকে বিশ্বকাপে দেখে আমার মনে হয়েছে ভয়াবহ ক্যালকুলেটিভ এক্সপেরিমেন্ট করার মত একজন কোচ। এই বিশ্বকাপে তিনি কোনো দুটো ম্যাচে একই ফরমেশনে খেলা শুরু করেননি। প্রতিটি ম্যাচে আলাদা ফরমেশন এবং ম্যাচের মধ্যে এক বা একাধিকবার পরিস্থিতি অনুযায়ী ফরমেশন বদল। কখনো ৪-৪-২, কখনো ৫-৩-২, কখনো ৪-৩-৩!
যারা সারা বছর ইউরোপের খেলা দেখেন, তাদের কাছে এটাকে বড় ব্যাপার মনে হবে না। কারণ, ইউরোপের দলগুলো ফরমেশন নিয়ে এই পরীক্ষা চালাতেই থাকে। কিন্তু মনে রাখতে হবে, তারা দলকে সারা বছর একসাথে অনুশীলন করায় এবং ভিন্ন ভিন্ন ফরমেশনের জন্য প্রস্তুত করে। কিন্তু আন্তর্জাতিক ফুটবলে সে সুযোগ নেই। এখানে দলটাকে একসাথে পাওয়াই যায় সর্বোচ্চ মাস দুয়েকের জন্য। তার মধ্যে এক মাসের একটা টুর্নামেন্টে দফায় দফায় ফরমেশন বদলালে লেজে গোবরে হতে পারে।
সেই ঝুকি নিয়েই দলকে প্রস্তুত করেছেন স্ক্যালোনি এবং তার ফল পেয়েছেন। প্রতি ম্যাচে প্রতিপক্ষের শক্তি অনুযায়ী ফরমশেন বদলেছেন। ক্রোয়েশিয়ার বিপক্ষে ম্যাচটা এর সেরা উদাহরণ। ক্রোয়েশিয়া মূলত মিড ফিল্ডে বল দখলে রেখে ম্যাচ গোলশূন্য রেখে লড়ার কৌশলে চলেছে।
স্ক্যালোনি কী করলেন, তাদের বিপক্ষে ৪-৪-২ খেললেন শুরুতে। বল দখল পেলো ক্রোয়েশিয়া; কিন্তু মাঝমাঠ দখলে রেখে কাউন্টার এটাকে গেলো আর্জেন্টিনা। যেই তিন গোলের লিড হল, অমনি ৫-৩-২ হয়ে গেলো ফরমেশন।
এটাই খেলা।
স্ক্যালোনির আরেকটা বড় কৃতিত্ব হলো খেলোয়াড় বদলে ইগো না দেখানো। লাউতারো বা ট্যাগ্লাফিকো ফ্লপ ছিলেন বা লো সেলসো ছিলেন না। তিনি দিব্যি বদলী হিসেবে আলভারেজ, আকুনা, এনজোকে নামিয়ে সাফল্যটা তুলে নিলেন।
সোজা কথায় স্ক্যালোনিই জানতেন-হোয়াট টু ডু।
আর একটা ম্যাচ, প্রিয় স্ক্যালোনি। আপনার এই জাদুটা ধরে রাখুন। তাহলে সর্বকালের সেরা জাদুকরের পাশে ছোট হরফে হলেও আপনার নামটা লেখা হয়ে যাবে।