ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর মানবীকরণ
ম্যা চহারের পর রোনালদো অশ্রুসিক্ত। কিন্তু জয়ী দলের বেশ কিছু খেলোয়াড় তাঁর দিকে ছুটে আসছেন। এটাই তো একটা বিজয়। শত শত কীর্তির স্রোতে এই পরাজয়ের অশ্রু তো একটা বিজয়েরও অশ্রু। রোনালদোর গ্রেটনেস তাই অস্বীকার করা যায়। সগৌরবে তাঁকে দিনের পর দিন মাথায় তুলে রাখা যায়।
‘রকি বালবোয়া’ নামে সত্তর দশকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একটি চলচ্চিত্র মুক্তি পেয়েছিল। সে সিনেমার পুরো কাহিনীই ছিল বক্সিংকে কেন্দ্র করে। এ সিনেমার কেন্দ্রীয় চরিত্রে ছিলেন সিলভারস্টার স্ট্যালন, যিনি বুড়ো বয়সে বক্সিং রিংয়ে এসে বক্সিং অঙ্গনকেই কাঁপিয়ে দিয়েছিলেন। প্রায় ৫০ বছর বাদে, সেই রকি বালবাও নামটা আবার ঘুরে ফিরে আসছে। পর্তুগালকে হারিয়ে বিশ্বকাপের সেমিতে উঠে যে রুপকথার জন্ম দিয়েছে মরক্কো সেই মরক্কোর কোচই নিজেদের ‘রকি বালবোয়া’ আখ্যা দিয়েছে।
মরক্কো কোচ ওয়ালিদ রেগরাগুই পর্তুগালের বিপক্ষে ম্যাচে শেষে বলেছেন, ‘আমরা এই বিশ্বকাপের রকি বালবোয়া। আমরা গ্রুপ পর্ব উতরানোর লক্ষ্য নিয়ে নিজেদের উজাড় করে দিতে চেয়েছিলাম। এখন আমরা সেমিতে। আমাদের যাত্রা এখানেই থামছে না। আমরা আরো অনেক দূর যেতে চাই। আমাদের হারানো এখন যে কোনো দলের জন্যই কঠিন হবে। তাই ট্রফিজয়ের স্বপ্ন কেন দেখব না?’
তিনি আরো বলেন, ‘এই বিশ্বকাপে আমরা এমন একটি দল যাদের পুরো বিশ্ব ভালোবাসতে চাইবে। কারণ আমরা দেখিয়ে দিচ্ছি টাকা পয়সা না থাকলেও আমরা সফল হতে পারি।’
প্রথমবারের মতো মরক্কোর সেমিফাইনালে ওঠার দৃশ্যে গোটা বিশ্ব এ ম্যাচে আরেকটি আবেগপূর্ণ ঘটনারও সাক্ষী হয়েছে। সেটি হচ্ছে বিশ্বকাপ থেকে ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদোর অশ্রুসিক্ত বিদায়। পর্তুগালের এই দলটাকে নিয়ে রোনালদো এবার ভিন্ন কিছু করে দেখাবেন এমন কিছু সম্ভাবনা নিয়ে কাতারে এসেছিলেন তিনি। কিন্তু শেষ আটের বাঁধায় টপকাতে পারেনি রোনালদোর দল। তাই রোনালদোর শেষ বিশ্বকাপের শেষ মুহূর্তটা হয়েছে বিষণ্নতা পূর্ণ।
মরক্কোর ইতিহাস গড়ার দিনে এমন দৃশ্য চোখ এড়ায়নি মরক্কোর কোচ রেগরাগুইয়ের। তিনি বলেন, ‘আমরা যখন গোল করলাম তখনই টের পেয়েছিলাম, রোনালদো পরের অর্ধে মাঠে নামবে। আর সেই সময়টা আমাদের জন্য বেশ চিন্তারও ছিল।’
রোনালদোর শেষ বিশ্বকাপে অবশ্য মেইনম্যান হয়ে ওঠারও সুযোগ হয়নি। কোচ ফার্নান্দো সান্তোস এবারের বিশ্বকাপে রোনালদোকে একটি ম্যাচেও পুরো নব্বই মিনিট খেলাননি। আর নক আউট স্টেজ থেকে তিনি শুরুর লাইনআপেই রাখেননি রোনালদোকে। এটি নিয়ে কোনো অনুতপ্ততা আছে কিনা এমন প্রশ্নে সান্তোস বলেন, ‘রোনালদো গ্রেট ফুটবলার। তবে তাঁকে শুরুর লাইনআপে না নেওয়া নিয়ে আমি অনুতপ্ত নই। তবে হ্যা। ম্যাচ হারের পরে ড্রেসিং রুমে সবাই ভেঙে পড়েছিল।’
মরক্কোর কোচ রেগুরাগুই অবশ্য শুরুর লাইনআপে রোনালদোর না থাকা নিয়ে মন্তব্য করেননি। তিনি বলেন, ‘আপনি প্রতিপক্ষ কোচকে আপনার ট্যাক্টিস দিয়ে প্রতিহত করতে পারবেন। কিন্তু রোনালদোকে নিয়ে আপনি কী করতে পারেন? আমি ঐ সময়টায় বেশ চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম। তবে দিনশেষে আমরা কোনো গোল হজম করিনি। আর জয় নিয়ে মাঠ ছাড়তে পেরেছি।’
স্পেনের বিপক্ষে জয় দিয়ে প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের কোয়ার্টার ফাইনালে উঠেছিল মরক্কো। এবার পর্তুগালকে হারিয়ে মরক্কো প্রথমবারের উঠে এলো সেমিত। তবে কোচ স্পেনের ম্যাচের চেয়ে পর্তুগালের ম্যাচকেই রাখছেন এগিয়ে। তিনি বলেন, ‘পর্তুগালের সাথে ম্যাচটা বেশ কঠিন ছিল। একটা পর্যায়ে আমরা শ্বাস নিতে পারছিলাম না। কারণ ওদের রোনালদো আছে, যে কিনা যেকোনো সময় স্কোর করতে সক্ষম। তাই আমারদের প্রধান চিন্তার বিষয় ছিল ওটাই।’
বিশ্বকাপে পর্তুগালের জার্সিতে ২২ ম্যাচে ৮ টি গোল করেছেন ক্রিশ্চিয়ানো রোনালদো। আর এ বিদায়ের ফলে বিশ্বকাপের গোলসংখ্যায় পর্তুগিজ কিংবদন্তি ইউসেবিওর পিছনেই থাকলেন রোনালদো। তবে আরেকটি বিব্রতকর রেকর্ড রোনালদোকে আরো বেশ কিছুদিন পোড়াবে। সেটি হলো, বিশ্বকাপের নকআউট ম্যাচে কখনোই গোল পাননি তিনি।
দিনশেষে রোনালদো তো একজন মানুষ। কিংবদন্তির পথযাত্রায় কতশত রেকর্ড তিনি ভেঙেছেন। এমন এমন সব কীর্তিতে তিনি নাম লিখিয়েছেন যেখানে একজন ফুটবলারের পৌঁছানোর লক্ষ্যটা একটা দুঃস্বপ্নই থেকে যায়। তাই এত সব কীর্তির ভীড়ে এমন না পাওয়ার গল্পগুলোর কলেবরটা একটু ছোটই। দিনশেষে শত পাওয়া আর কিছু না পাওয়ার মাঝেই তো একজন কিংবদন্তির পথযাত্রার অন্তিম দৃশ্যায়ন হয়। রোনালদোর ক্ষেত্রেও হয়েছে তাই।
ম্যা চহারের পর রোনালদো অশ্রুসিক্ত। কিন্তু জয়ী দলের বেশ কিছু খেলোয়াড় তাঁর দিকে ছুটে আসছেন। এটাই তো একটা বিজয়। শত শত কীর্তির স্রোতে এই পরাজয়ের অশ্রু তো একটা বিজয়েরও অশ্রু। রোনালদোর গ্রেটনেস তাই অস্বীকার করা যায়। সগৌরবে তাঁকে দিনের পর দিন মাথায় তুলে রাখা যায়।