ভারত মহাসাগরের কোল ঘেঁষে নয়নাভিরাম গল মাঠ, যার পাশের মধ্যযুগীয় দুর্গের খাঁজকাটা দেওয়ালে শিষ দিয়ে চলে এক অদ্ভুত প্রশান্তির বাতাস। কী সেই প্রশান্তি? শুধু কী নৈসর্গিক দৃশ্যবলী নাকি ধিশালের দাদার একটা শৈল্পিক লেট্ কাট বা মোলায়েম কব্জির মোচড়ে তুলি হয়ে বেরোনো হাতের ব্যাটটা দিয়ে একটা স্নিগ্ধতায় ভরা কভার ড্রাইভে ও তো চোখের প্রশান্তি আসে! ভাবছেন কে এই ধিশালের দাদা, যাঁর ব্যাটের মুগ্ধতায় এতো পরিমান আহ্লাদিত?
বেশ, এবার তবে আসা যাক আরবসাগরের কোল ঘেঁষা মুম্বাই এর কংক্রিটে ঢাকা ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে দোসরা এপ্রিল, ২০১১ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালের দিনে। বিশ্বকাপ এমনিতেই ধিশালের দাদার কাছে বরাবরই বৈচিত্রপূর্ণ, কখনো রামধনু ছড়ানো আবার কখনো বা পুরোটাই বেরঙিন।
বিলেতে প্রথম বিশ্বকাপে ৫ ইনিংসে মাত্র ১০২ রান, আফ্রিকার মাটিতে পরের বিশ্বকাপে ৭ ইনিংসে রানটা অতি লজ্জাজনক, মাত্র ২১, ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জের কাপযজ্ঞে নিজেকে ফিরে পেলেন যদিও স্বমহিমায়, করলেন ৫৪৮ রান, ফাইনালে উঠে যদিও গিলক্রিস্টের কাছে হারতে হলো, এরপর নিজের উপমহাদেশের ‘১১ র যজ্ঞে ভালোয় মন্দয় চলছিল।
ওয়াংখেড়ের কাপ ফাইনালে প্রিয় বন্ধু সাঙ্গার পাশে তাঁর ব্যাটের দিকেও চেয়ে তখন গোটা সিংহল বাসী। ফাইনালে ব্যাট হাতে নামার মুহূর্তে তাই বোধহয় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ চোয়াল, ভাই ধিশালকে দেওয়া কথা রাখতেই হবে। ধিশালের জন্য তাঁকে জিততেই হবে এ ফাইনাল।
হরভজনকে সেই সোনার ফ্রেমে বাঁধানো কভার ড্রাইভে শুরু হলো কথা রাখার চিঠি। শ্রীসন্থ, মুনাফ প্যাটেল, যুবরাজদের হাত থেকে বেরোনো বল গুলো মাঝে মাঝেই ছিটকে যেতে লাগলো বাউন্ডারির বাইরে, প্রিয় বন্ধু সাঙ্গা বা সমারাবীরাকে সঙ্গী করে খুচরো রান ও আসতে থাকলো। আর ধিশালের জন্য লেখা চিঠিতে জুড়তে লাগলো মায়াবী স্কোয়ার কাট আর লেট্ কাটের সব গল্পগুলো।
৪৯ বলে এলো অর্ধ শতরান, গ্যালারিতে বসে থাকা সহধর্মিনীর দিকে যখন ব্যাটটা তুললেন, সহধর্মিনী হাত নেড়ে যেন জানালেন ঐ বাইশগজে তোমায় আরও থাকতে হবে, দেশের জন্য, আর ভাইকে দেওয়া প্রতিশ্রুতি রাখতে। স্ত্রীর কথা রাখবার পালাও শুরু। অপর প্রান্তে সমারাবীরা, কাপুগেডেরা ফিরেছেন, জাহিররা ক্রমশ মারাত্মক হয়ে উঠছেন আর দখল নেওয়ার চেষ্টা করছেন ওয়াংখেড়ের।
এই সময়ই নুয়ান কুলাসেকারাকে পাশে পেলেন তিনি। ধ্রুপদী ব্যাটিংয়ের মায়াঞ্জন ছড়ানো স্কোয়ার কাট ব্যাকওয়ার্ড পয়েন্টের পাশ দিয়ে সুললিত পদ্যর মতো বাউন্ডারির বাইরে আশ্রয়ও নিতে থাকলো। মাহেলা দেখলেন রানটা আড়াইশো পার করতেই হবে, এবার যেন গল্পে নতুন মোড়। মায়াবী ব্যাটিংয়ের স্রোত থেকে বেরিয়ে আরও গর্জে উঠতে থাকলো তাঁর ব্যাট।
জহির খান, মুনাফ প্যাটেল, শ্রীশান্তদের ফালা ফালা করে উইকেটের দুধারে স্ট্রোকের ছটায় ওয়াংখেড়ের গ্যালারি তখন বাকরুদ্ধ করে তুলেছেন তিনি। ৮৪ বলে পূর্ণ হলো কাঙ্খিত শতরান। ওয়াংখেড়ের রাজা তখন একজনই – ধিশালের দাদা মাহেলা জয়বর্ধনে। করতালিতে মুখর গোটা গ্যালারি। কমেন্ট্রি বক্সে নাসের হুসেনের কণ্ঠে ঝরে পড়ছে মুগ্ধতা – ‘Mahela Jayawardena, A high class inings from a high class player.’
সেঞ্চুরিটা করে শূন্যে একটা ছোট্ট লাফ মাহেলার, তারপর আকাশের দিকে তাকিয়ে খোঁজার চেস্টা। জানতেন শত খুঁজলেও পাবেন না ছোট ভাই ধিশালকে, সেতো না ফেরার দেশে চলে গেছে সেই কবেই, কর্কট রোগের শিকার হয়ে।
একসময় সবাই বলতো স্কুল ক্রিকেটে ধিশাল আর মাহেলা কেউ কারো থেকে কম যায়না, দু’জনের চোখে তখন কত স্বপ্ন, একসাথে শ্রীলঙ্কার ঐ নীল হলুদ জার্সিটা চাপিয়ে প্রেমদাসা থেকে লর্ডস মাতাবে, কিন্তু ভগবানের বোধহয় সহ্য হলো না সেসব, নিয়ে গেল ধিশালকে। শোকে পাথর মাহেলা ভাবলেন আর খেলবেনই না, শুভানুধ্যায়ীরা বুঝিয়ে সুঝিয়ে মাহেলাকে ফেরত পাঠালেন বাইশ গজে, সবাই বললেন ধিশালের জন্যই খেলতে হবে।
সে ফাইনালেও মাহেলা চেয়েছিলেন ধিশালের জন্যই বিশ্বকাপটা জেতাতেই হবে, কতদিনের দুই ভাইয়ের সে স্বপ্ন, মাহেলা অন্তত পূরণ করবেন। কিন্তু ভাগ্য দেবতা এবারেও অলক্ষ্যে হেসেছিলেন বোধহয়। ২রা এপ্রিলের সন্ধ্যে অবধি ওয়াংখেড়ের রাজা হয়েও রাতে সে রাজ্যপাট নিয়ে চলে গেলেন গম্ভীর, ধোনিরা। বিশ্বজয় করল ধোনির ভারত, কিন্তু ধিশালকে দেওয়া কথা পুরোপুরি রাখা হলো না মাহেলার। ধিশাল তো কিছুই পাননি, মাহেলার জন্যও তাই বোধহয় ‘সব পেলে নষ্ট জীবন’।