ব্যাটিং নামক শিল্পের অনিন্দ্য এক শিল্পীর নাম মাহেলা জয়াবর্ধনে। দীর্ঘদিন পরে প্রেমিকাকে প্রথম দেখার সময় প্রেমিকের চোখে যে আনন্দের পরশ দেখা যায় মাহেলা জয়াবর্ধনের ব্যাটিং ক্রিকেট প্রেমিকের জন্য সেরকমই আনন্দদায়ী!
প্রেমিকার জন্য যেমন পৃথিবী ঘুরে একশ আটটা নীলপদ্ম খুঁজে বের করা যায়, মাহেলার ব্যাটিং দেখবার জন্যেও মাইলের পর মাইল হেঁটে যাওয়া যায়। ব্যাটটাকে তুলি বানিয়ে উইকেটের চারপাশে এমন সব শট খেলতেন যা মোহাবিষ্ট করে রাখত দর্শকদের।
১৯৭৭ সালের ২৭ মে কলম্বোয় জন্মগ্রহণ করেন মাহেলা জয়াবর্ধনে, পুরো নাম দেনাগামাগে প্রমথ মাহেলা ডি সিলভা জয়াবর্ধনে। শ্রীলংকার বিখ্যাত স্কুল ক্রিকেটের মাধ্যমে ছোটবেলাতেই পাদপ্রদীপের আলোয় চলে আসেন। স্বপ্ন ছিল ছোট ভাই ধীশালকে নিয়ে একসাথে জাতীয় দলে খেলবেন। কিন্তু বিধাতার কি নির্মম পরিহাস, ১৬ বছর বয়সে ধীশাল ব্রেইনটিউমারে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
ফলে ধাক্কা খায় মাহেলার ক্রিকেটজীবন। বিখ্যাত নালন্দা কলেজে পড়ার সময় থেকেই স্টাইলিশ ব্যাটসম্যান হিসেবে খ্যাতি পেয়ে যান। তার খুব কাছের বন্ধু কুমার সাঙ্গাকারা বলেন, ‘সেই স্কুলক্রিকেট থেকেই মাহেলাকে দেখে ভিতরে ভিতরে কিছুটা ঈর্ষান্বিত হতাম, ব্যাটে-বলে টাইমিং করার ব্যাপারটা মাহেলা এতটা অনায়াসে করতো যে সেটা দেখে অবাক না হয়ে পারা যেত না। আমরা যেসব শট খেলতে নেটে কঠোর পরিশ্রম করতাম সেগুলো মাহেলা সেই বয়সে অহরহ করে দেখাতো।’ ঈশ্বর প্রদত্ত এই প্রতিভার কারণে মাত্র ২০ বছর বয়সেই দলে অভিষেকের সম্ভাবনা জোরালো হয় মাহেলা জয়াবর্ধনের।
১৯৯৭ সালের আগস্টে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে কলম্বোর প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক হয় মাহেলার। রানবন্যার সেই ম্যাচে ভারতের করা ৫৩৭ রানের জবাবে শ্রীলঙ্কা সংগ্রহ করে ৬ উইকেটে ৯৫২ রান যা আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড। তবে রানবন্যার মাঝেও অভিষিক্ত মাহেলা ৬৬ রান এক নতুন তারকার আবির্ভাবের জানান দেয়।
পরের বছর জানুয়ারিতে ওয়ানডেতেও অভিষেক ঘটে যায় মাহেলার, টেস্টের মতো ওয়ানডে অভিষেকটাও হয় সেই প্রেমদাসা স্টেডিয়ামেই। প্রথম ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ২১২ রানের চেজে সাত নম্বরে ব্যাটিং এ নেমে অপরাজিত থাকেন ১ রানে! পরের ওয়ানডেতে জিম্বাবুয়ের করা ২৮১ রান তাড়া করে লঙ্কানদের চার উইকেটের জয়ে ৭৮ বলে ৭৪ রান করে বড় অবদান রাখেন জয়াবর্ধনে।
প্রথম সেঞ্চুরির দেখা পেতে খুব বেশি সময় লাগেনি, ১৯৯৮ সালের জুনে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে গল টেস্টের দ্বিতীয় দিনেই পেয়ে যান ক্যারিয়ারের প্রথম টেস্ট সেঞ্চুরি। গলের বোলিংনির্ভর পিচে তার করা ১৬৭ রানের সুবাদে শ্রীলঙ্কা জয় পায় ইনিংস ও ১৬ রানে। শ্রীলংকার ইনিংসের মোট রানের ৫২.৭% রান এবং দ্বিতীয় ইনিংসে নিউজিল্যান্ডের ১১৪ রানে অলআউট হয়ে যাওয়া প্রমাণ দেয় মাহেলার ইনিংসের মাহাত্ম্য।
ওয়ানডেতেও প্রথম সেঞ্চুরি তুলে নিতে দেরি হয়নি মাহেলার। ১৯৯৯ সালের ২৩ জানুয়ারি অ্যাডিলেডে ইংলিশদের মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা। এই সেই ঐতিহাসিক ম্যাচ, যে ম্যাচে মুরালিকে বারবার নো বলের দায়ে অভিযুক্ত করার প্রতিবাদে মাঠ ছেড়ে চলে গিয়েছিলো রানাতুঙ্গার শ্রীলঙ্কা। শেষপর্যন্ত ইংলিশরা সেদিন দাঁড় করায় ৩০২ রানের বিশাল এক সংগ্রহ। ২৪০রানকে যেখানে যথেষ্ট ধরা হয়, সেখানে ৩০২ রান তাড়া করে জেতা পাহাড় টপকানোর মতো। ৫৮ রানে তিন উইকেট পড়ে গেলে ক্রিজে আসেন মাহেলা।
তাঁর দুর্দান্ত ১১১ বলে ১২০ রানের ইনিংসের ফলে সহজেই ম্যাচটি জিতে যায় শ্রীলঙ্কা। টেস্টে প্রথম ডাবল সেঞ্চুরিও পেয়ে যান সেবছরেরই ফেব্রুয়ারিতে ভারতের বিপক্ষে, এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপের ম্যাচে। প্রথম ইনিংসে ভারতের করা ৫১৮ রানের জবাবে ১৮ রানে ১ উইকেট হারিয়ে শ্রীলঙ্কা শঙ্কায়, তখন তিনে নামা মাহেলার ৪৬৫ বলে ২৪২ রানের ইনিংসে ম্যাচে ফিরে আসে শ্রীলঙ্কা। ম্যাচ ড্র হলেও ম্যাচ সেরার পুরস্কার ঠিকই পান তিনি। মার্চে পাকিস্তানের বিপক্ষে ওয়ানডেতে বিশাখাপত্তমে খেলেন ম্যাচজয়ী ১০১ রানের ইনিংস। সবমিলিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে মাহেলা জয়াবর্ধনের শুরুটা ছিল আশাজাগানিয়া।
স্বপ্নের বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ পেয়ে যান সে বছরেই। নিজের প্রথম বিশ্বকাপ খেলতে গিয়ে প্রথম ম্যাচে সুযোগ না পেলেও দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচে ঠিকই সুযোগ পান ২২ বছর বয়সী মাহেলা জয়াবর্ধনে। প্রোটিয়াদের দেওয়া ২০০ রানের সহজ টার্গেট তাড়া করতে গিয়ে লঙ্কানরা অল আউট হয় মাত্র ১১০ রানেই! সেদিন সাত নম্বরে খেলতে নামা মাহেলা করেন ২২ রান, যা ছিল দলের হয়ে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ।
নিজের প্রথম বিশ্বকাপে তেমন একটা সুবিধা করতে পারেননি তিনি। কেনিয়ার বিপক্ষে ৪৫ রানই ছিল তার সেই আসরে সর্বোচ্চ সংগ্রহ। নিজের দল শ্রীলঙ্কার জন্যও আসরটি ছিল ব্যর্থতায় মোড়া, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হিসেবে খেলতে এসে গ্রুপপর্বেই বিদায় নিতে হয় লঙ্কানদের।
বিশ্বকাপে ব্যর্থতার পরপরই অধিনায়কের পদ থেকে সরে যান অর্জুনা রানাতুঙ্গা, দলীয় অধিনায়ক হিসেবে লঙ্কান বোর্ড নিয়োগ দেয় সনাথ জয়াসুরিয়াকে আর ডেপুটি হিসেবে নিয়োগ পান মাহেলা জয়াবর্ধনে। মাত্র ২২ বছর বয়সী মাহেলাকে সহ অধিনায়ক করে বোর্ড একটা স্পষ্ট ইঙ্গিত দিয়ে দেয় আর তা হলো ভবিষ্যতে শ্রীলঙ্কার নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্বটা মাহেলার উপরেই বর্তাবে।
তবে এত অল্প বয়সে সহ অধিনায়কত্বের চাপ এসে পড়ায় মাহেলার পারফরম্যান্স গ্রাফ কিছুটা নিচে নেমে যায়। নিয়মিত বিরতিতে বড় ইনিংসের দেখা পেলেও বড় ইনিংসগুলোর মাঝে ধারাবাহিক পারফর্ম না করায় ওয়ানডেতে মাহেলার গড় ৩০ এর আশেপাশেই ঘুরতে থাকে।
২০০০ সালের জুলাইতে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে শন পোলক, মাখায়া এনটিনি, জ্যাক ক্যালিস, ল্যান্স ক্লুজনার, পল অ্যাডামসদের সামলে খেলেন ১৬৭ রানের ইনিংস। ঐ সিরিজেরই চতুর্থ টেস্টের চতুর্থ ইনিংসে খেলেন ম্যাচবাঁচানো ১০১ রানের ইনিংস। ঐ বছরের আগস্টে ওয়ানডেতে ভারতের বিপক্ষে করেন ১২৮ রান। ২০০১সালের শুরুতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে করেন ১০১ রান।
ওই বছরেরই আগস্টে ভারতের বিপক্ষে পরপর দুই টেস্টে করেন যথাক্রমে করেন ১০৪ ও ১৩৯ রান। ওয়ানডেতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে খেলেন অপরাজিত ১০১ রানের ইনিংস। এপ্রিলে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করেন ১১৬ রান। বছরের শেষদিকে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঝড়ো ১০৬ রানের ইনিংস খেলে দলকে ম্যাচ জেতান। ২০০২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে লর্ডসে ১০৭ রানের ইনিংস ছাড়া বলার মতো বড় ইনিংস না খেললেও ধারাবাহিকভাবে ভাল খেলে যান
২০০৩ বিশ্বকাপে মাহেলার বয়স ছিল ২৬ বছর, দলের সহ অধিনায়কের কাছ থেকে লংকানদের প্রত্যাশার পারদটাও বেশ উঁচুতেই ছিল। কিন্তু হায়! পুরো বিশ্বকাপটা দু:স্বপ্নের চেয়েও ভয়াবহ কাটে মাহেলা জয়াবর্ধনের জন্য। ১, ৫, ৯, ১, ০, ০ ও ৫ – নাহ এগুলো কোনো মোবাইল নাম্বারের ডিজিট নয়, ২০০৩ বিশ্বকাপের সাত ইনিংসে এগুলোই ছিল মাহেলার রানসংখ্যা!
একবারের জন্যও দুই অঙ্কের রান দূরে থাক, ৫ রানের বেশিই করতে পারেননি তিনি! গড় ছিল মাত্র তিন। যদিও শ্রীলঙ্কা সেবার সেমিফাইনাল খেলেছিল, কিন্তু এমন জঘন্য পারফর্মেন্সের জন্য ওয়ানডে দল থেকেই বাদ পড়ে যান মাহেলা। অথচ বিশ্বকাপের কিছুদিন পরেই জয়াসুরিয়া অধিনায়কের পদ থেকে সরে যাওয়ায় অধিনায়কের দায়িত্বটা মাহেলারই পাওয়ার কথা ছিল, কিন্তু সেই দায়িত্ব পেয়ে যান মারভান আতাপাত্তু। সবমিলিয়ে এক ২০০৩ বিশ্বকাপ মাহেলাকে একধাক্কায় অনেক দূর পিছিয়ে দেয়।
তবে মাহেলার মত প্রতিভাকে খুব বেশিদিন দলের বাইরে রাখা যায় না, এক সিরিজ পরেই দলে আবার ফিরে আসেন মাহেলা। কিন্তু ২০০৩ বিশ্বকাপের দু:স্বপ্ন কিছুতেই কাটিয়ে উঠতে পারছিলেন না মাহেলা, ফলে দলে ফিরলেও রান ঠিক সেভাবে পাচ্ছিলেনই না! শেষপর্যন্ত মাহেলা নিজেকে ফিরে পান ইংলিশদের বিপক্ষে গল টেস্টে, সেই টেস্টে প্রথম ইনিংসে লঙ্কানরা ৯৪ রানের লিড নিলেও দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৮৫ রানে ৫ উইকেট খুইয়ে বেশ চাপে পড়ে যায় শ্রীলঙ্কা।
সেখান থেকে দলকে টেনে তুলেন মাহেলা, একপাশ আগলে রেখে মাহেলা ৮৬ রান করলে শ্রীলঙ্কা পেয়ে যায় ৩২২ রানের লিড তবে শেষপর্যন্ত মাত্র এক উইকেট না নেওয়ার আফসোসে ম্যাচটা ড্র করতে হয় লংকানদের। সেই সিরিজের শেষ টেস্টে ১৩৪ রান করে পুরোপুরি রানে ফিরে আসেন মাহেলা জয়াবর্ধনে। পরের বছর দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে গল টেস্টে মাহেলা পেয়ে যান তার টেস্ট ক্যারিয়ারের দ্বিতীয় ডাবল সেঞ্চুরি।
২০০৩ সালের পর থেকেই মাহেলা ব্যাট হাতে ধারাবাহিক পারফর্ম করতে থাকায় তাকে অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেওয়ার দাবিটা জোরালো হতে থাকে। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় অধিনায়ক হিসেবে আতাপাত্তুর ভালো পারফর্মেন্স, এমনকি ২০০৪ সালে আইসিসির বর্ষসেরা ওয়ানডে দলের অধিনায়কও ছিলেন মারভান আতাপাত্তু! তবে ভবিষ্যতের কথা ভেবে শেষপর্যন্ত সাহসী সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলে ক্রিকেট শ্রীলঙ্কা (এসএলসি)!
২০০৬ সালে বাংলাদেশ সফরের জন্য ঘোষিত দলে আতাপাত্তুকে বিশ্রাম দিয়ে মাহেলা জয়াবর্ধনেকে অধিনায়ক ও কুমারা সাঙ্গাকারাকে সহ অধিনায়ক হিসেবে নিয়োগ দেয় লঙ্কান বোর্ড। অধিনায়ক হিসেবে নিজের শুরুটা খুব বেশি ভালো হয়নি মাহেলার, বাংলাদেশ সফরে একটা ওয়ানডেতে হেরে যায় তার দল! অন্যদিকে ঘরের মাঠে পাকিস্তানের সাথেও টেস্ট ও ওয়ানডে সিরিজে হেরে যায় শ্রীলঙ্কা। কিন্তু মাহেলা ইংল্যান্ড সফরে বিশাল এক বাজিমাত করে ফেলেন! লর্ডসে প্রথম ইনিংসে শ্রীলঙ্কা ফলো-অনে পড়লেও দ্বিতীয় ইনিংসে মাহেলার অনবদ্য সেঞ্চুরিতে ম্যাচ ড্র করে শ্রীলঙ্কা, ম্যাচসেরার পুরষ্কারটাও পান মাহেলা।
দ্বিতীয় টেস্টে লঙ্কানরা ছয় উইকেটে হারলেও শেষ টেস্টে মুরালি ম্যাজিকে ১৩৪ রানে ম্যাচ জিতে সিরিজ ড্র করে শ্রীলঙ্কা। আর ওয়ানডেতে তো ইংলিশরা দাঁড়াতেই পারেনি, পাঁচ ম্যাচ সিরিজের সবকটাতে জিতে ঘরের মাঠে ইংলিশদের ধবল ধোলাইয়ের স্বাদ দেয় মাহেলার দল। এরমধ্যে তৃতীয় ও চতুর্থ ওয়ানডেতে টানা দুটি সেঞ্চুরি করে দলের এই ৫-০ ব্যবধানে সিরিজ জয়ে বড় অবদান রাখেন মাহেলা নিজেই। অধিনায়ক হিসেবে মাহেলার ভিতটা মজবুত হয়ে যায় এই সফরের পরপরই।
২০০৬ সালের জুলাইয়ে শ্রীলঙ্কা সফরে আসে দক্ষিণ আফ্রিকা, প্রথম টেস্টে কলম্বোর এসএসসিতে মুখোমুখি হয় দুই দল। প্রথম ইনিংসে প্রোটিয়ারা অল আউট মাত্র ১৬৯ রানে! তবে ডেল স্টেইনের জোড়া আঘাতে মাত্র ১৪ রানে শ্রীলঙ্কার দুই ওপেনার সাজঘরে ফিরলে মনে হচ্ছিলো যে এই অল্প পুঁজিতেই বুঝি ম্যাচ জমিয়ে তুলে প্রোটিয়ারা! তবে এরপর যা হলো, সেটা শুধু প্রোটিয়ারা কেনো, লঙ্কানরাও তাদের স্বপ্নে ভাবতে পেরেছিল কিনা সন্দেহ! ১৫৭ ওভার ব্যাটিং করে ৬২৪ রানের পাহাড়সম এক জুটি দাঁড় করান কুমার সাঙ্গাকারা ও মাহেলা জয়াবর্ধনে!
এই ৬২৪ রানের জুটি শুধুমাত্র আন্তর্জাতিক টেস্টেই নয়, ফার্স্ট ক্লাস ক্রিকেট হিসেব করলেও যেকোনো জুটিতে সর্বোচ্চ! জুটি ভাঙ্গে ব্যক্তিগত ২৮৭ রানে কুমার সাঙ্গাকারার বিদায়ে। তবে ব্যাট হাতে তখনো অবিচল মাহেলা বেশ ভালোভাবেই লারার ৪০১ রানের রেকর্ড ভাঙার দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। কিন্তু দ্রুত রান তুলতে গিয়ে আন্দ্রে নেলের বলে বোল্ড আউট হলে মাহেলার সেই মহাকাব্যিক ইনিংস থামে ৩৭৪ রানে! মাত্র ২৭ রানের জন্য লারার রেকর্ড মিস করলেও অন্য আরেকটি রেকর্ড ততক্ষণে মাহেলার দখলে চলে গেছে!
ডানহাতি ব্যাটসম্যানদের মধ্যে টেস্টে এক ইনিংসে সর্বোচ্চ রান এই ৩৭৪-ই! তাছাড়া জয়াসুরিয়ার ৩৪০ রান টপকে লঙ্কান ব্যাটসম্যান হিসেবে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ডটাও নিজের করে নেন মাহেলা। শ্রীলঙ্কা এই টেস্ট জিতে নেয় এক ইনিংস ও ১৫৩ রানের ব্যবধানে আর ম্যাচ সেরার পুরস্কারটাও পান মাহেলা জয়াবর্ধনে। পি সারা ওভালে পরের টেস্টে প্রোটিয়ারা ৩৫২ রান ছুঁড়ে দেয় লঙ্কানদের।
মাহেলার ১২৩ রানে ভর করে এই রান তাড়া করে সিরিজ ২-০ তে জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা, সেসময়ে এটিই ছিল লঙ্কানদের সর্বোচ্চ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড। এ ম্যাচেও সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জেতেন মাহেলা জয়াবর্ধনে। অধিনায়ক হিসেবে নিজের প্রথম বছরেই আইসিসি টিম অব দ্য ইয়ারের অধিনায়ক নির্বাচিত হন মাহেলা জয়াবর্ধনে।
২০০৩ সালের দুঃস্বপ্নের বিশ্বকাপে রান না করায় ২০০৭ বিশ্বকাপে মাহেলার উপর ছিল রান করার চাপ,অধিনায়ক হিসেবে রান করতে না পারলে পুরো ক্যারিয়ারই হুমকির মধ্যে পড়ে যেত।সেই চাপকে শক্তিতে পরিণত করে বিশ্বকাপে দুর্দান্ত পারফর্ম করেন মাহেলা,পাশাপাশি অধিনায়ক হিসেবে নিজের কার্যকারীতার প্রমাণ দেন। ৬০.৮৯ গড়ে ৫৪৮ রান করে টুর্নামেন্টের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক হন মাহেলা।
সুপার এইটে দ্বিতীয় হয়ে সেমিফাইনালে যায় শ্রীলঙ্কা যেখানে প্রতিপক্ষ ছিল নিউজিল্যান্ড। টসে জিতে আগে ব্যাটিং এ নেমে লঙ্কানদের শুরুটা মন্থর হলেও মাহেলার ১০৯ বলে ১১৫ রানের দুর্দান্ত ইনিংসে ২৮৯ রানের বড় সংগ্রহ দাঁড় করায় শ্রীলঙ্কা যা জয়ের জন্য যথেষ্ট ছিল। তবে ফাইনালে অজিদের সাথে আর পেরে উঠে নি মাহেলার দল, ৫৩ রানে হেরে রানার্স আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় লঙ্কানদের। সে বছর অনুষ্ঠেয় টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে সুপার এইটেই বিদায় নিতে হয় মাহেলার শ্রীলঙ্কাকে। অসাধারণ পারফর্ম করে ২০০৭ সালে উইজডেন বর্ষসেরা খেলোয়াড় হন মাহেলা। পরের বছর পাকিস্তানের মাঠে ফাইনালে ভারতকে ১০০ রানে হারিয়ে এশিয়া কাপের শিরোপা জিতে নেয় শ্রীলঙ্কা।
অধিনায়ক হিসেবে মাহেলা বেশ ভালো সময় পার করছিলেন, কিন্তু বিনা মেঘে বজ্রপাতের মতোই ২০০৯ সালের শুরুতেই মাহেলা ঘোষণা দেন যে তিনি আর অধিনায়ক হিসেবে থাকবেন না! তার এই সিদ্ধান্তে ভক্তরা তো বটেই বোর্ডও বেশ অবাক হয়ে যায়। অধিনায়কত্ব ছাড়ার পেছনে সেরকম কোনো শক্ত কারণ মাহেলা দিতে পারেননি।
অনেকের মতেই, সেসময়ে শ্রীলঙ্কার সহ অধিনায়ক ও মাহেলার সবচেয়ে কাছের বন্ধু কুমার সাঙ্গাকারাকে অধিনায়ক হওয়ার সুযোগ করে দেওয়ার জন্যেই মাহেলা এভাবে হুট করে অধিনায়কের পদ থেকে সরে যান। তবে অধিনায়কের পদ ছাড়লেও দলের সিদ্ধান্ত গ্রহণের ব্যাপারে মাহেলার প্রভাব মোটামুটি আগের মতোই রয়ে যায়, একারণে কিছুদিন পরেই মাহেলাকে সাঙ্গাকারার ডেপুটি করে দেয় লঙ্কান বোর্ড। সাঙ্গাকারার নেতৃত্বে ২০০৯ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অসাধারণ খেললেও ফাইনালে পাকিস্তানের কাছে হেরে আবারো রানার আপ হয় শ্রীলঙ্কা।
কিছুটা ক্লাসিক ঘরনার ব্যাটসম্যান হওয়ায় টি-টোয়েন্টিতে শুরুর দিকে নিজের জাতটা ঠিক চেনাতে পারছিলেন না মাহেলা। যদিও শ্রীলঙ্কার টি-টোয়েন্টি দল কিংবা আইপিএল- দু জায়গাতেই নিয়মিত খেলে যাচ্ছিলেন মাহেলা, কিন্তু পারফর্মেন্স যা করছিলেন, তা তার নামের পাশে বেশ বিবর্ণই ছিল। মাহেলার টি-টুয়েন্টি ক্যারিয়ারে টার্নিং পয়েন্ট হয়ে আসে ২০১০ সালে আইপিএলের একটি ম্যাচ।
মাহেলার দল কিংস ইলেভেন পাঞ্জাবের বিপক্ষে ২০০ রানের পাহাড় দাঁড় করায় কলকাতা নাইট রাইডার্স। রান তাড়া করতে নামার আগে এ ম্যাচে ওপেনিংয়ে নামার ইচ্ছার ব্যাপারে পাঞ্জাবের অধিনায়ক সাঙ্গাকারাকে জানান মাহেলা। সাঙ্গাকারা সম্মতি দিয়ে দেন আর ওপেনার হিসেবে সুযোগ পেয়েই খেলেন ৫৯ বলে ১১০ রানের বিধ্বংসী এক ইনিংস। তার এই ইনিংসে ভর করে এক ওভার আগেই জয়ের বন্দরে পৌঁছে যায় পাঞ্জাব।
আইপিএলে ওপেনার হিসেবে সফল হওয়ায় ২০১০ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপেও ওপেনার হিসেবে খেলা শুরু করেন মাহেলা। এখানেও শুরুতেই বাজিমাত, নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাত্র ৫১ বলে ৮১ রান করেন জয়াবর্ধনে। তবে বাকি ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায় শ্রীলঙ্কা মাত্র ১৩৫ রানে গুটিয়ে গেলে চার উইকেটে ম্যাচটা জিতে নেয় কিউইরা। গ্রুপ পর্বের শেষ ‘ডু অর ডাই’ ম্যাচে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে ৬৪ বলে ১০০ রান করে ক্রিকেটের ক্ষুদ্রতম ফরম্যাটে প্রথম লঙ্কান ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জন করেন মাহেলা জয়াবর্ধনে।
তার এই সেঞ্চুরিতে ভর করেই লঙ্কানরা দাঁড় করায় ১৭৩ রানের সংগ্রহ, যা জিম্বাবুয়েকে হারানোর জন্য যথেষ্টই ছিল। পরের ম্যাচে সুপার এইটে স্বাগতিক উইন্ডিজের মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা আর সেই ম্যাচেও অব্যাহত থাকে মাহেলার রান ফোয়ারা। ৫৬ বলে ৯৮ রানে অপরাজিত থাকলে মাত্র দু’রানের জন্য টানা দুইটি আন্তর্জাতিক টি-টুয়েন্টি ম্যাচে সেঞ্চুরি করার বিরল রেকর্ড গড়া থেকে বঞ্চিত হন মাহেলা।
পরের ম্যাচে অজিদের বিপক্ষে ব্যাট হাতে নিষ্প্রভ ছিলেন মাহেলা, লংকাও হেরে যায় ম্যাচটা। গ্রুপপর্বের শেষ ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে শ্বাসরুদ্ধকর এক ম্যাচ জিতে শ্রীলঙ্কা চলে যায় সেমিফাইনালে। কিন্তু সেমিতে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে হেরে যাওয়ায় সেবারও শিরোপা না জিতেই ফিরতে হয় লঙ্কানদের। তবে ৩০২ রান করে টুর্নামেন্টের সর্বোচ্চ রান সংগ্রাহক জয়াবর্ধনেই হন।
চার এপ্রিল, ২০১১।
পুরো টুর্নামেন্টে দুর্দান্ত খেলে বিশ্বকাপ ফাইনালে মুম্বাইর ওয়াংখেড়ে স্টেডিয়ামে ভারতের মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা। টসে জিতে ব্যাটিং এর সিদ্ধান্ত নিলেন লঙ্কান অধিনায়ক কুমার সাঙ্গাকারা। কিন্তু শুরুতেই জহির খানের অসাধারণ বোলিং সাথে ভারতীয় ফিল্ডারদের অসাধারণ ফিল্ডিং এ শুরুতেই বেশ চাপে পড়ে যায় শ্রীলঙ্কা। মুম্বাইয়ের ফ্ল্যাট পিচে যেখানে বড় সংগ্রহের দরকার ছিল সেখানে পাওয়ার প্লের দশ ওভারে লঙ্কানদের রানরেট ছিল ওভারপ্রতি তিন রান!
মাহেলা জয়াবর্ধনে যখন ক্রিজে আসেন তখন শ্রীলঙ্কার সংগ্রহ ওভারে ৫৬/২। তখন মাহেলার উপর একইসাথে দুইটা দায়িত্ব, রানের গতি বাড়ানো সাথে নিজের উইকেট বিলিয়ে না আসা। মাহেলা জয়াবর্ধনে দুইটা দায়িত্বই বেশ ভালোভাবে সামলালেন, অপরপ্রান্তের কোনো ব্যাটসম্যানের কাছ থেকে সেভাবে সমর্থন না পেলেও মাহেলা একাই বুক চিতিয়ে লড়ে গেলেন, খেললেন মাত্র ৮১ বলে ১০৩ রানের দুর্দান্ত এক ইনিংস।
পরিস্থিতি আর পারিপার্শ্বিক চাপের কথা বিবেচনা করলে এই ইনিংসটাকে সহজেই বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে সেরা তিন ইনিংসের তালিকায় রাখা যায়। মাহেলার এই অসাধারণ ইনিংসে ভর করেই সেদিন শ্রীলঙ্কা ২৭৪ রানের লড়াকু সংগ্রহ পায়। অথচ সেদিন যদি আরেকজন ব্যাটসম্যান মাহেলাকে ঠিকভাবে সাপোর্ট দিতে পারতেন, তাহলে হয়তো সেদিন লংকানদের সংগ্রহ ৩০০ ছাড়িয়ে যেতো।
তবে, বিশ্বকাপ ফাইনালের ইতিহাসে এর আগে কোনো দলেরই ২৫০+ রান তাড়া করে জয়ের রেকর্ড ছিল না। ফলে মনে হচ্ছিলো, ২৭৪ রানই বুঝি শ্রীলঙ্কার জয়ের জন্য যথেষ্ট হবে। কিন্তু মুম্বাইর ফ্ল্যাটপিচ রাতের শিশিরের প্রভাবে আরো বেশি ব্যাটিং বান্ধব হয়ে যায়, গৌতম গম্ভীর আর ধনীর অসাধারণ দুইটি ইনিংসে বৃথা যায় মাহেলার অসাধারণ সেই সেঞ্চুরি, ছয় উইকেটের জয়ে দ্বিতীয়বারের মতন বিশ্বজয় করে ভারত। আর বিশ্বকাপ ফাইনালে সেঞ্চুরি করেও পরাজিত দলে থাকার দুঃসহ রেকর্ডের অধিকারী হয়ে যান মাহেলা জয়াবর্ধনে। এই পরাজয়ের পরে দল নির্বাচন নিয়ে সমালোচনার জের ধরে অধিনায়কের পদ থেকে সাঙ্গাকারা ও সহ অধিনায়ক হিসেবে মাহেলা পদত্যাগ করেন।
কিন্তু মাহেলা-সাঙ্গার পদত্যাগের পর দিলশানের নেতৃত্বে জঘন্য এক বছর পার করে শ্রীলঙ্কা, শেষপর্যন্ত ২০১২ সালে আবারো দলের দায়িত্ব নেন মাহেলা। দায়িত্ব নিয়েই শ্রীলঙ্কাকে আবারো সাফল্যের কক্ষপথে নিয়ে আসেন মাহেলা। অস্ট্রেলিয়া ও ভারতের সাথে ত্রিদেশীয় সিরিজে অসাধারণ ক্রিকেট খেলেও রানার আপ হয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয় শ্রীলঙ্কাকে। তবে ঘরের মাঠে পাকিস্তানকে ওয়ানডে ও টেস্ট সিরিজে ঠিকই হারায় শ্রীলঙ্কা।
মাহেলা তার দলকে ঘরের মাঠে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের জন্য তৈরি করতে থাকেন। নেটে বোলিং দেখে ১৭ বছর বয়সী রহস্যময় স্পিনার আকিলা ধনাঞ্জয়কে ট্রাম্পকার্ড হিসেবে দলে নেন মাহেলা। মাহেলার ট্যাকটিসে ঘরের মাঠের সেই টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে অদম্য একদলে পরিণত হয়েছিলো শ্রীলঙ্কা, সেমিফাইনালে পাকিস্তানকে হারানোর ম্যাচে ম্যাচসেরাও হন মাহেলা।
ফাইনালে উইন্ডিজের মুখোমুখি হয় শ্রীলঙ্কা, প্রথম ১০ ওভারে উইন্ডিজ মাত্র ৩২ রান করায় মনে হচ্ছিলো উইন্ডিজকে বুঝি হেসেখেলেই হারাতে পারবে শ্রীলঙ্কা। কিন্তু এমন একটা গুরুত্বপূর্ণ দিনে মাহেলার তূণের সেরা তীর মালিঙ্গাই হয়ে উঠলেন খরুচে বোলার! শেষপর্যন্ত উইন্ডিজদের সংগ্রহ দাঁড়ায় ১৩৭ রানে যা কলম্বোর স্লো পিচে বেশ ভালো সংগ্রহ ছিল।
তবে এই রানচেজে লঙ্কানরা ভালোমতোই ছিল কিন্তু বৃষ্টির আভাস দেখে রানরেট বাড়াতে হুট করে রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে সেট ব্যাটসম্যান মাহেলা আউট হলে তাসের ঘরের মতো ভেঙে যায় লঙ্কান ব্যাটিং লাইনআপ। ঘরের মাঠে এত কাছ থেকে বিশ্বকাপ হারানোর দুঃখে তৎক্ষণাৎ টি-টুয়েন্টির অধিনায়ক হিসেবে সরে যান মাহেলা। পরের বছর অস্ট্রেলিয়া সফর শেষে টেস্ট ও ওয়ানডে অধিনায়ক হিসেবেও সরে যান মাহেলা।
২০১৪ টি-টুয়েন্টি বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার অধিনায়ক হিসেবে চান্দিমাল নিয়োগ পেলেও ইংল্যান্ডের বিপক্ষে স্লো ওভাররেটের জন্য চান্দিমাল এক ম্যাচ নিষিদ্ধ হওয়ায় নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে ডু অর ডাই ম্যাচে অধিনায়কের দায়িত্ব পান লাসিথ মালিঙ্গা যার আগে অধিনায়ক হিসেবে জাতীয় দলে কোনো অভিজ্ঞতাই ছিল না! এমন গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচে শ্রীলঙ্কা অলআউট মাত্র ১১৯ রানে!
তখন মনে হচ্ছিলো, মাহেলা-সাঙ্গার একটা বিশ্বকাপের স্বপ্ন বুঝি অধরাই রয়ে যাবে। কিন্তু নেতাদের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্যে আর্মব্যান্ডের যে কোনো দরকার হয় না সেটা আবারো প্রমাণ করেন মাহেলা, মালিঙ্গাকে একপাশে রেখে পুরোম্যাচে নেতৃত্ব দেন মাহেলা নিজেই। মাহেলার অসাধারণ নেতৃত্বেই মাত্র ১১৯ রানের পুঁজি সত্ত্বেও ৫৯ রানে জিতে সেমিফাইনালে চলে যায় শ্রীলঙ্কা।
এরপর উইন্ডিজকে সেমিতে হারানোর পর ফাইনালে ভারতের মুখোমুখি হয় লঙ্কানরা আর সেখানে আবারো মাহেলার চমক! আগে থেকেই ভারতের ব্যাটসম্যানদের দুর্বলতা খুঁজে সেই অনুযায়ী ডেথ ওভারে বোলিং করার পরিকল্পনা সাজান মাহেলা আর এই ট্যাকটিসের কারণেই ভারতের ইনিংস মাত্র ১৩০ রানেই থেমে যায় যা ২.১ ওভার হাতে রেখেই শ্রীলঙ্কা টপকে গেলে অবশেষে বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন পূরণ হয় মাহেলার!
বিচিত্র এই পৃথিবীতে ঘটনাগুলো যেন আরো বেশি বিচিত্র, অফিসিয়াল অধিনায়ক হিসেবে ট্যাকটিসের সমস্তটা দিয়েও যেখানে মাহেলা অধিনায়ক হিসেবে দলকে বিশ্বকাপ জেতাতে পারেননি, সেখানে পর্দার আড়ালে থেকে যেবার নেতৃত্ব দিলেন সেবারই দল জিতে গেলো বিশ্বকাপ! অবশ্য এটা নিয়ে মাহেলার কোনো অতৃপ্তি ছিল না, তৃপ্তি নিয়েই ওই ম্যাচের পর টি-টোয়েন্টি থেকে অবসরের ঘোষণা দেন মাহেলা।
একই বছর পাকিস্তানের বিপক্ষে নিজের শেষ টেস্ট খেলেন মাহেলা। আর ঘোষণা দেন ২০১৫ বিশ্বকাপের পর ওয়ানডে থেকেও অবসর নেওয়ার। টি-টোয়েন্টির মতো অবশ্য ওয়ানডের বিদায়টা সুখকর হয়নি, দক্ষিণ আফ্রিকার কাছে কোয়ার্টার ফাইনালে হেরে শ্রীলঙ্কা বিদায় নেয় আর মাহেলাও খেলে ফেলেন নিজের শেষ আন্তর্জাতিক ম্যাচ।
ক্রিকেটীয় জীবনে ছিলেন ভদ্রতার প্রতিমূর্তি। ২০১৩ তে জিতেছেন আইসিসির ‘স্পিরিট অব দ্য ক্রিকেট অ্যাওয়ার্ড’! বন্ধু সাঙ্গাকারার সাথে ব্যবসা আছে। খেলা ছাড়ার পর জড়িয়ে পড়েন ক্রিকেট কোচিংয়ের সাথে। সেখানেও সফল এই ক্রিকেট ব্যক্তিত্ব। আইপিএলে মুম্বাই ইন্ডিয়ান্সকে তিনবার শিরোপা জেতান। বিপিএলে কোচ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন খুলনা টাইটান্সের।
তবে সবচেয়ে বড় স্বপ্নটা আসলে ভাই ধীশালকে নিয়ে। যতদিন যখন খেলতে নেমেছেন সবসময়ে মনে করেছেন তিনি একা নন, তিনি আসলে দুইজন। ভাইয়ের স্মৃতিতে শ্রীলঙ্কায় গড়ে তুলেছেন ‘হোপ’ নামের বিনামূল্যের ক্যান্সার হাসপাতাল। যেন কর্কট রোগটা আর কারও প্রাণ কেড়ে না নেয়। বলেছিলেন ক্যারিয়ার শেষে মন-প্রাণ ঢেলে দিবেন এ জায়গাতেই।
১৮ বছরের জীবনে মাঠে যার কাজ ছিল দর্শকদের আনন্দ দেয়া তিনি এখন শান্তি খুঁজবেন হাসপাতালে রোগীর সারল্যমার্কা হাসিতে। সেখানে ধীশালকে খুঁজে বেড়াবেন। শিল্পীদের মন বড় না হলে তো তারা আর অন্যদের চেয়ে আলাদা হন না। দেনাগামাগে প্রবোথ মাহেলা ডি সিলভা জয়াবর্ধনে মানুষ হিসেবে মাঠের চেয়েও বড় শিল্পী। জীবনের হাসি-কান্না মাখা শিল্পের এক বড় আঁকিয়ে!