ম্যাজেস্টিক মাজিদ!

বলকে চোখের পলকে সীমানার বাইরে নিয়ে ফেলাই তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল। শেবাগের মতোই চিন্তা-ভাবনা ছিলো সাবেক পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান মাজিদ খানেরও! ফুটওয়ার্কে বিশ্বাস করতেন না তিনি। ব্যাটের সাথে হাত এবং চোখের ব্যবহার করেই প্রতিপক্ষের বোলারদের খেলে গিয়েছেন অনায়াসেই। তিনি প্রমাণ করে দেন, ফুটওয়ার্কটা স্রেফ কেতাবি জ্ঞান। সেটা করেই তিনি বনেছেন ‘ম্যাজেস্টিক মাজিদ’।

ফুটওয়ার্ক নিয়ে প্রায়ই আমরা মন্তব্য দেখি যে অমুক ব্যাটসম্যানের ফুটওয়ার্ক ভালো না, সে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে টিকতে পারবে না। অপরদিকে, ফুটওয়ার্ক নিয়ে কখনোই মাথা ঘামাননি এমনও অনেকে আছে যারা দিব্যি খেলে গিয়েছেন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। সাবেক ভারতীয় ওপেনার বীরেন্দ্র শেবাগ ফুটওয়ার্ক নিয়ে তেমন একটা ভাবতেন না।

বলকে চোখের পলকে সীমানার বাইরে নিয়ে ফেলাই তাঁর মূল লক্ষ্য ছিল। শেবাগের মতোই চিন্তা-ভাবনা ছিলো সাবেক পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান মাজিদ খানেরও! ফুটওয়ার্কে বিশ্বাস করতেন না তিনি। ব্যাটের সাথে হাত এবং চোখের ব্যবহার করেই প্রতিপক্ষের বোলারদের খেলে গিয়েছেন অনায়াসেই। তিনি প্রমাণ করে দেন, ফুটওয়ার্কটা স্রেফ কেতাবি জ্ঞান। সেটা করেই তিনি বনেছেন ‘ম্যাজেস্টিক মাজিদ’।

ক্যারিয়ারের শুরুটা করেছিলেন একজন পেসার হিসেবে। দিন যতই গড়িয়েছে পরিশ্রমের মাধ্যমে মাজিদ নিজেকে গড়ে তুলেছেন একজন ব্যাটসম্যান হিসেবে। এর পেছনে কারণও আছে। পিঠের ইনজুরিতে ভুগছিলেন তিনি। বোলার হিসেবে ক্যারিয়ারে বেশিদিন খেলতে পারবেন না সেটাও হয়তো বুঝতে পেরেছিলেন। এরপর বনে যান পুরাদস্তুর ব্যাটসম্যান। তবে পার্ট টাইমার হিসেবে বোলিংও করেছেন বেশ কয়েক বার।

মাত্র ১৫ বছর বয়সেই প্রথম ক্লাস ক্রিকেটে অভিষেক। ব্যাগ, বই-খাতা নিয়ে স্কুল-কলেজে যাবার বয়সে ব্যাট হাতে পেশাদার ক্রিকেট খেলছেন এক ছোকরা! লাহোরে অভিষেক ম্যাচেই সেই ছোকড়া প্রমাণ করেছিল নিজের সামর্থ্য। বল হাতে ৬৭ রানে ৬ উইকেট শিকারের পর ব্যাট হাতে খেলেছিলেন হার না মানা ১১১ রানের ইনিংস!

প্রায় তিন বছর ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক পারফরম্যান্সের পর জাতীয় দলে ডাক পান মাজিদ। ১৯৬৪ সালে মাত্র ১৮ বছর বয়সে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করাচি টেস্টে অভিষিক্ত হন তিনি। অভিষেকটাও ছিল মলিন! আট নম্বরে নেমে আউট হন রানের খাতা খোলার আগেই! বল হাতে অবশ্য শিকার করেছিলেন ২ উইকেট। ঘরোয়া ক্রিকেটে ধারাবাহিক রান পেলেও আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এসে ঠিক যেন সেই তেজটা ধরে রাখতে পারেননি মাজিদ!

১৯৭৪ সালে প্রথম পাকিস্তানি ব্যাটসম্যান হিসেবে ওয়ানডেতে সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন তিনি! ইংল্যান্ডের বিপক্ষে ২৪৫ রানের টার্গেটে ব্যাট করতে নামে পাকিস্তান। সময়ের হিসেবে তখন ২৪৫ রান বেশ বড় লক্ষ্য এবং জয়ের জন্য যথেষ্ট। কিন্তু মাজিদ খানের ৯৩ বলে ১০৯ রানের দুর্দান্ত সেঞ্চুরিতে ৪৩ ওভারেই সেই লক্ষ্যমাত্রা সহজেই টপকে যায় পাকিস্তান!

তবে, ক্যারিয়ারের সেরা সময় পার করেছিলেন ১৯৭৭ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে সিরিজে। অ্যান্ডি রবার্টস, কলিন ক্রফট, জোয়েল গার্নারদের বিপক্ষে ওই সিরিজে দাপুটে ব্যাটিং করেন মাজিদ। ওই সিরিজে ৫৩ গড়ে ৫৩০ রান করেন তিনি! যদিও পাকিস্তান ৩-১ এ সিরিজ হেরে যায়।

১৯৭৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে দুর্দান্ত খেলেও সেবার জিততে পারেনি পাকিস্তান। ২৯৪ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে মাজিদের ৮১ এবং জহির আব্বাসের ৯৩ রানের পরেও ৪৪ রানে ম্যাচ হারে পাকিস্তান। এক সময় দলের অবস্থা ছিল ১ উইকেটে ১৭৬ রান! সেখান থেকে ব্যাটিং বিপর্যয়ের হার নিয়ে মাঠ ছাড়ে পাকিস্তান।

এরপর ১৯৮২ সালে ইংল্যান্ডের বিপক্ষে বাজে পারফরম্যান্সের পর দল থেকে বাদ পড়েন মাজিদ। তাঁকে বাদ দিয়েছিলেন কে জানেন? তাঁরই চাচাতো ভাই সাবেক পাকিস্তানি অধিনায়ক ইমরান খান! অবশ্য মাজিদ খানই ছিলেন ইমরান খানের শৈশবের হিরো। পরবর্তীতে এক সাক্ষাৎকারে মাজিদকে বাদ দেওয়ার প্রসঙ্গে ইমরান বলেন, ‘তাঁকে বাদ দেওয়ার সিদ্ধান্তটা মোটেও সহজ ছিল না। এমনকি বাদ দেওয়ার পর মাজিদ আমার সাথে কথাও বলেনি। ‘

মাজিদ ক্রিকেট পরিবার থেকেই উঠে এসেছিলেন। তাঁর বাবা জাহাঙ্গীর খান তৎকালীন ব্রিটিশ ভারতের হয়ে ক্রিকেট খেলেছিলেন!  মাজিদের চাচাতো ভাই সাবেক পাকিস্তানি কিংবদন্তি ইমরান খান। মাজিদ খানের ছেলে বাজিদ খানও ২০০৫ সালে পাকিস্তানের হয়ে অভিষিক্ত হন।

মাজিদ একমাত্র পাকিস্তানি এবং সব মিলিয়ে পঞ্চম ক্রিকেটার হিসেবে কোনো টেস্টের প্রথম দিনে লাঞ্চ বিরতির আগেই সেঞ্চুরির কীর্তি গড়েন। ১৯৭৬ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে করাচিতে এই কীর্তি গড়েন তিনি।

শুধু ব্যাট হাতেই নয়, স্লিপ ফিল্ডার হিসেবেও মাজিদ ছিলেন দুর্দান্ত। তিনি ক্যারিয়ারে প্রায় ৪৫০ এর বেশি ক্যাচ ধরেছেন, যার অধিকাংশই স্লিপে দাঁড়িয়ে।

ক্রিকেট মাঠে এক মজার ব্যক্তিত্বও ছিলেন তিনি। যদি তিনি নিজে মনে করতেন আউট হয়েছেন, তাহলে আম্পায়ারের দিকে ফিরেও দেখতেন না; সোজা প্যাভিলিয়নের পথ ধরতেন। ডার্বিশায়ারের বিপক্ষে এক ম্যাচে আউট হবার পর তো ব্যাট তিন টুকরা করে ড্রেসিং রুমের দিকে ছুঁড়ে মারেন!

১৯৭৮ সালে লাহোরে ভারতের বিপক্ষে টেস্টে কপিল দেব বেশ কয়েকবার লেগ স্টাম্পের বাইরে বল করেন। স্ট্রাইকে তখন মাজিদ। লেগ স্টাম্পের বাইরে গেলেও আম্পায়ার একবারও ওয়াইডের ইশারা দেননি! হুট করেই মাজিদ লেগ স্টাম্প উঠিয়ে নিয়ে লেগ সাইডে আরেকটু দূরে নিয়ে বসান! এরপর কপিলের দিকে ইঙ্গিত করে বললেন অন্তত এবার যাতে স্টাম্পের বল ফেলে!

প্রায় দুই দশক ধরে খেলা মাজিদ পাকিস্তানের হয়ে ৬৩ টেস্ট ও ২৩ ওয়ানডে খেলেছেন। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ৪৫০০ এর বেশি রানও আছে তার নামে। ইনজুরির কারণে পেসার থেকে ব্যাটসম্যান বনে যাওয়া মাজিদের ক্যারিয়ারে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে শিকার করেছেন ২২৩ উইকেট! ব্যাট হাতে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে রান করেছেন ২৭ হাজারেরও বেশি! ঘরোয়া ক্রিকেটের সেই জৌলুশটা অবশ্য আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে সেভাবে দেখাতে পারেননি মাজিদ। তবে, টেস্টে ৮টি সেঞ্চুরি ও ১৯ টি  হাফ-সেঞ্চুরির মালিক তিনি।

ক্রিকেটকে বিদায় জানানোর পর কাজ করেছেন পাকিস্তান ক্রিকেট বোর্ডেও (পিসিবি)। ১৯৯৯ এর বিশ্বকাপের তিনি পিসিবির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন। তবে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ফিক্সিংয়ের অভিযোগ ওঠার পর তিনি পদত্যাগ করেন। অবশ্য এই ম্যাচ ফিক্সিংয়ে সন্দেহের তীর উঠেছিল মাজিদের দিকেই!

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link