মালয়েশিয়া, ১৯৯৬ কিংবা ২০১৮
১০ জুন, ২০১৮ সাল।
কিছুক্ষণের জন্য কী একুশ বছর আগের স্মৃতিতে ফিরে গিয়েছিলেন? ফিরে গিয়েছিলেন কী কুয়ালালামপুরের কিলাত কিলাব ক্লাবে যেখানে আইসিসি ট্রফির ফাইনালে এবারের এশিয়া কাপের মতই টানটান উত্তেজনা বিরাজ করেছিল? সেদিন শেষ বলে বীরত্ব দেখিয়ে ঠিকই ঐতিহাসিক জয় তুলে নিয়েছিলেন আকরাম খান ও তাঁর সতীর্থরা। আর একুশ বছর পর একই শহর অর্থাৎ কুয়ালালামপুরের কিনরারা অ্যাকাডেমি ওভালে নারী এশিয়া কাপের ফাইনালে শেষ বলে ঐতিহাসিক জয় নিয়ে মাঠ ছেড়েছিলেন সালমা খাতুনরা।
সেই মালয়েশিয়া, সেই কুয়ালালামপুর – যেখান থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের ছেলেদের ক্রিকেটের নতুন করে পথচলা। ১৯৯৭ এ আইসিসি ট্রফির জেতার মাধ্যমে এদেশে ক্রিকেটের জাগরণ শুরু হয় যা পরবর্তীতে দেশের ক্রিকেট উন্নতিতে অনবদ্য ভূমিকা পালন করে। বাংলাদেশ পুরুষ দল আজ যে অবস্থানে এসেছে, ক্রিকেট বিশ্বে সমীহ জাগানিয়া দলে পরিণত হয়েছে তার শুরুটা মূলত সেদিনই হয়েছিল।
সেই টুর্নামেন্টের ফাইনাল ম্যাচটাও ছিল এশিয়া কাপের ফাইনালের মতই চরম উত্তেজনাকর। শেষ বলে জয়ের জন্য সেদিন দরকার ছিল ১ রান। লেগ স্ট্যাম্পে করা মার্টিন সুজির বলটা হাসিবুল হোসেন শান্ত ব্যাটে খেলতে পারেননি। প্যাডে লেগে বল যতক্ষণে শর্ট ফাইন লেগ ফিল্ডারের হাতে ততক্ষণে দৌঁড়ে ইতিহাসের পাতায় ঢুকে যান শান্ত। সেইসাথে ইতিহাসের পাতায় নতুন করে নাম লেখায় বাংলাদেশ। প্রথমবারের মত আইসিসি ট্রফি জিতে ক্রিকেট বিশ্বকে নিজেদের আগমনী বার্তা দিয়ে রাখেন তাঁরা।
একুশ বছর পর সেই কুয়ালালামপুরেই আরেকটি ফাইনাল মঞ্চস্থ হলো বাংলাদেশের। এ যেন বিধাতার এক অপার মহীমা! সকল দৃশ্যপট যেন বিধাতার সাজানো সেই একুশ বছর আগের ফাইনাল ম্যাচের আদলেই। সেদিন আকরাম খানদের জিততে শেষ ২ বলে দরকার ছিল ৩ রান। আর আজ সালমাদের জিততেও শেষ ২ বলে দরকার হয় ৩ রান। সেদিনের খেলা শেষ বল পর্যন্ত গড়িয়েছিল এবং ২০১৮ সালেও তাই।
সেদিন শেষ বলে জয় তুলে নিয়ে লাল সবুজের পতাকা উড়িয়ে কুয়ালালামপুর কাপিয়েছিলেন বাংলাদেশের ছেলেরা। আর আজ একুশ বছর পর ভারতের বিপক্ষে শেষ বলে জয় তুলে নিয়ে কুয়ালালামপুর কাপালো বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটাররা। একুশ বছর পর মালয়েশিয়ার আকাশে আবারো পতপত করে উড়লো লাল সবুজের পতাকা এবং সেটা নারী ক্রিকেটারদের হাত ধরে।
এশিয়ার শ্রেষ্ঠত্ব এখন বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের দখলে। বিশ্ব অবাক তাকিয়ে রয়, বিশ্বাস করতে অনেকের কষ্টও হয়। কারণ গতকাল পর্যন্ত এই এশিয়া কাপটা ছিল শুধুই ভারতময়। কারণ গত ছয় আসরের সবকটিতে অপরাজিত চ্যাম্পিয়ন ছিলেন ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম পরাশক্তি হারমানপ্রীত কৌরের ভারত। তাঁরা বিশ্বকাপের বর্তমান রানার্স আপ, টি-টোয়েন্টির সেরা চার দলের একটি। আর বাংলাদেশ র্যাংকিংয়ের নিচু সারির একটি দল, টুর্নামেন্ট ফেভারিটের তকমা যাদের স্পর্শ করাও খুব দূরের ব্যাপার।
তবে এসব আলোচনাকে পেছনে ঠেলে এবারের এশিয়া কাপে টানা চার জয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে ভারতের সাথে ফাইনালে জায়গা করে নেয় বাংলাদেশ। এবারের এশিয়া কাপ অন্য এক বাংলাদেশকে আবিষ্কার করেছে। পুরো টুর্নামেন্টে আত্মবিশ্বাসে ভরপুর একটি দল হিসেবে খেলতে দেখা গেছে সালমা-রুমানাদের। অথচ টুর্নামেন্টের আগে তাদের এই আত্মবিশ্বাসে প্রয়োজনীয় জ্বালানিটুকুও সংগ্রহ করা সম্ভব হয় নি।
নারী এশিয়া কাপের সপ্তম আসর শুরু হওয়া আগ মুহূর্তে বাংলাদেশকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৫ ম্যাচের ওয়ানডে ও ৩ ম্যাচের টি-টোয়েন্টি সিরিজে ধবলধোলাই হতে হয়। এমনকি দক্ষিণ আফ্রিকায় বিধ্বস্ত হওয়া সিরিজে একাধিক ওয়ানডেতে ১০০ এর নিচে অলআউট পর্যন্ত হতে হয় বাংলাদেশকে।
দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিরে এশিয়া কাপের প্রস্তুতির জন্য খুব বেশি সময়ও পান নি ক্রিকেটাররা। তাই প্রস্তুতিতে ঘাটতি রেখেই মালয়েশিয়ায় পা রাখে সালমার দল। টুর্নামেন্টের প্রথম ম্যাচেই সে ছাপ স্পষ্ট। শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে তাঁরা গুটিয়ে যান মাত্র ৬৩ রানে এবং পরাজিত হন ৬ উইকেটের ব্যবধানে। এমনিতেই টুর্নামেন্টে তাদের ওপর বড় কোন প্রত্যাশার চাপ ছিল না সমর্থকদের। তাই প্রথম ম্যাচের পর বাংলাদেশ টুর্নামেন্টের ফাইনাল খেলবে সেটা যে ঘুণাক্ষরেও কেউ কল্পনা করেনি তা হলফ করে বলাই যায়।
যদিও সেখান থেকেই শুরু এক মহাকাব্য রচনার। প্রথম ম্যাচে বিধ্বস্ত হবার পর পাকিস্তান, ভারত, থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়াকে টানা চার ম্যাচে হারিয়ে প্রথমবারের মত ফাইনাল নিশ্চিত করে বাংলাদেশের নারীরা। রাউন্ড রবিন লিগে ভারতের বিপক্ষে ৭ উইকেটের জয় পান তাঁরা যা তখন পর্যন্ত নারী এশিয়া কাপের ইতিহাসে একমাত্র হার ছিল ভারতের।
তারপর সেই ভারতের বিপক্ষে ফাইনালে সাক্ষাৎ। তাদের বিপক্ষে আগের জয়টি যে অঘটন ছিল না সেটি প্রমাণ করার পালা। অভিজ্ঞতায় বাংলাদেশ থেকে ভারত যোজন যোজন এগিয়ে। বলতে গেলে বাংলাদেশের নারীদের অভিজ্ঞতার ভাণ্ডার শূণ্য। যদিও আত্মবিশ্বাসে টইটুম্বুর ছিলেন একেকজন। বাংলাদেশ এখন পর্যন্ত কোন ফাইনাল খেলতে পারেনি পক্ষান্তরে ভারতের রয়েছে ৬ বার এশিয়া কাপ ও ২ বার বিশ্বকাপ ফাইনাল খেলার অভিজ্ঞতা। মূলত আজকের ফাইনালে বাংলাদেশের পুঁজি ছিল কেবল আত্মবিশ্বাস আর কিছুদিন আগে ভারতকে হারানোর সুখস্মৃতি। এই দুইয়ের সমন্বয়ে মাঠের খেলায় আজ আবারো ভারতকে রুখে দিলেন তাঁরা।
খেলার শুরু থেকেই বাংলাদেশের প্রত্যেকের শরীরী ভাষা ছিল ইতিবাচক। একটি সাফল্যের ক্ষুদা তাদের চোখে মুখে স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছিল। সেই ক্ষুদাই মাঠে প্রত্যেকের সেরাটা বের করে এনেছে। ব্যাটিং, বোলিং ও ফিল্ডিংয়ের মানদন্ডে আজ ভারতের চেয়ে বেশ এগিয়ে ছিলেন বাংলাদেশের নারীরা। ফলাফল এশিয়ার সবচেয়ে সফল দলটির বিপক্ষে ৩ উইকেটের জয় এবং প্রথমবারের মত বড় কোন ট্রফি নিজেদের করে নেয়া।
আসলে প্রত্যেকটা সাফল্যের পিছনেই থাকে অনেক গল্প। সে গল্পগুলো হয় নানা প্রতিবন্ধকতার, কঠিন সংগ্রামের ও অক্লান্ত পরিশ্রমের। আজকে বাংলাদেশের নারীদের এশিয়া কাপ জেতার পেছনেও রয়েছে সেরকম কিছু গল্প।
প্রথমত পর্যাপ্ত আন্তর্জাতিক ম্যাচ তাঁরা পাননা খেলার জন্য। আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার জন্য তাদেরকে সারাবছর হাপিত্যেশ করে বেড়াতে হয়। এর প্রমাণ দীর্ঘ ১৪ মাস পর কোন আন্তর্জাতিক সিরিজ খেলতে গত মাসে তাদের দক্ষিণ আফ্রিকায় পা রাখা। আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের মত ঘরোয়া ক্রিকেটেও নারীরা অনিয়মিত। তাদের ঘরোয়া লিগও সময়মত মাঠে গড়ায় না। মাঠে গড়ালেও সেসব লিগগুলোতে থাকে নানা অব্যবস্থাপনা।
আরো রয়েছে অপ্রতুল ম্যাচ ফি ও বেতন বৈষম্যের ঘটনা। বেতন কিংবা ম্যাচ ফি’র আকাশ-পাতাল বৈষম্যের পাশাপাশি নিয়মিত অনুশীলনের সুযোগও অনেকসময় মেলে না তাদের। এমনকি পর্যাপ্ত নিরাপত্তার সুবিধা থেকেও নারী ক্রিকেটাররা বঞ্চিত। অনুশীলন শেষে প্রায়ই দলের একেজনকে ফুটপাত ধরে কিংবা রাস্তায় হেটে নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছতে দেখা যায়। অথচ এতসব সমস্যার মাঝেও নিজেদেরকে মেলে ধরে দেশের জন্য সম্মান বয়ে আনার জন্য তাদের প্রচেষ্টার কোন ত্রুটি থাকে না।
প্রথমবারের মত এশিয়া কাপ জিতে তাঁরা এ দাবি আরো জোরালো করেন যে তাঁরা আরো বেশি সুযোগ-সুবিধা প্রাপ্য। এ দাবি উন্নত প্রশিক্ষণের সুযোগ করে দেবার পাশাপাশি বেশি বেশি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার সুযোগ করে দেয়ার। এ দাবি লিগ এবং আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ম্যাচ ফি বাড়ানোর পাশাপাশি বেতন বৃদ্ধি করারও। নানাবিধ সমস্যায় জর্জরিত হওয়ার পরও নারীরা আজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে যে বীরত্ব দেখিয়েছেন তাতে এবার অন্তত ক্রিকেট বোর্ডের সজাগ হওয়া দরকার। তবেই আমাদের নারী ক্রিকেটারদের আজকের মত আরো অনেক সাফল্য এনে দেবার পথ মসৃণ ও সুগম হবে।
সেই সাফল্যের সুবাদে এবং এরপর খেলোয়াড়দের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে মেয়েদের বেতন কাঠামোতেও পরিবর্তন এসেছে কিছু। বেড়েছে ম্যাচ ফি। তবে, এখনও সেটা যথেষ্ট নয়। বিনিয়োগ থাকলে সাফল্য আসবে, ছেলেরা প্রমাণ করেছে। মেয়েরা বিনিয়োগ ছাড়াই সাফল্য দেখেছে। আরেকটু বেশি কি তাঁদের এখন প্রাপ্য নয়? এশিয়া কাপ জিতেই তো তাঁরা অবহেলার জবাবটা দিয়ে রেখেছিল সেদিন।