এফএ কাপকে সবচেয়ে ঐতিহ্যবাহী ট্রফি হিসেবে অনেকেই নজরে রাখেন। সেই নজরে রাখতে গিয়ে গতকাল তাজ্জব এক ঘটনা দেখে ফেলেছেন দুনিয়াবাসী।
সাবেক ফুটবলার, বিখ্যাত টিভি তারকা মার্ক রাইট লিডস ইউনাইটেডের বিপক্ষে মাঠে নেমে ফেলেছিলেন। রসিকতা করতে বা প্রমোশের কাজে নয়; বিশ্বাস করুন, সত্যি সত্যি খেলতে নাঠে নেমেছিলেন মার্ক রাইট!
এফএ কাপকে বলা হয় ইংলিশ ফুটবলের সবচেয়ে সম্মানজনক শিরোপা।
পৃথিবীর অন্যতম পুরোনো এই শিরোপার অনেকের কাছে মানে গুণে প্রিমিয়ার লিগের থেকেও অনেক উপরে। হবেই বা না কেন? প্রিমিয়ার লিগে যেখানে খেলে মাত্র ২০ দল, সেখানে এফএ কাপ খেলতে আসে ইংলিশ লিগের প্রতিটি ডিভিশনের প্রতিটি দল। সবমিলিয়ে যেখানে দেখা মিলে এমনসব দলের, যাদের অবস্থা দিন আনি দিন খাই। আবার তারাই চমক দেখিয়ে বসে প্রিমিয়ার লিগ ক্লাবদের বিপক্ষে। গতকাল লিডসকে হারিয়ে ফুটবলীয় চমক তো ক্রলি টাউন দিয়েছেই। সেই সাথে এই ম্যাচে দেখা মিলেছে ইংলিশ টিভি তারকা মার্ক রাইটের।
ঘটনা গতকালের এফএ কাপের থার্ড রাউন্ডের ম্যাচে। প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব লিডস ইউনাইটেডের বিপক্ষে মুখোমুখি হয়েছিল চতুর্থ ডিভিশনের দল ক্রলি টাউন।
ঘটনা ম্যাচের একদম শেষ মিনিটের। লিডসের বিপক্ষে জয় নিশ্চিত করে নিজেদের মধ্যে আনন্দ শুরু করে দিয়েছে ক্রলি টাওনের সমর্থকেরা। তাই শেষ মিনিটে ক্লাবের খেলোয়াড়দের উল্টে-পাল্টে নিচ্ছিলেন ম্যানেজার জন ইয়েমস। আর তখনই ৩০ নম্বর জার্সি পরিহিত মার্ক রাইটকে দেখা যায় মাঠে নামতে। দারুন অবাক হয়েছেন এফএ কাপ দেখতে থাকা লোকজন। মার্ক রাইটের মতন টিভির রিয়েলিটি শোর নিয়মিত মুখকে এভাবে খেলার মাঠে জার্সি গায়ে দেখবেন এ হয়তো স্বপ্নেও ভাবতে পারেননি কেউ।
ব্রিটেনের টিভিতে মার্ক রাইট বেশ পরিচিত মুখ।
মার্ক রাইটকে প্রথম টিভি শোতে দেখা যায় আইটিভির রিয়েলিটি শো ‘The Only Way is Essex’–এ। টিভি মিডিয়ার দর্শকদের মধ্যে যাদের সালমান খানের উপস্থাপনায় ইন্ডিয়ান ‘Big Boss’ দেখার অভিজ্ঞতা আছে, তাদের হয়তো মার্কের এই শোয়ের ধরণ ধরতে সুবিধা হবে। ‘The Only Way is Essex’ বা ‘TOWIE’ থেকেই মূলত মার্ক রাইটের টিভিতে যাত্রা শুরু। এরপর একই ধাঁচের বিভিন্ন রিয়েলিটি টিভি শোতে অংশ নিয়েছেন রাইট। বলতে গেলে গত এক দশকে টিভি রিয়েলিটি শোর নিয়মিত মুখ হয়ে উঠেছিলেন রাইট।
সেই মার্ক আবার টিভি মাঠে এলেন। ‘আবার’ বলতে হচ্ছে। কারণ, মার্কের সাথে টিভির সম্পর্ক এই প্রথম নয়।
রাইটের ফুটবলে হাতেখড়ি হয়েছে একেবারে প্রথম শ্রেণির ইংলিশ ক্লাবে। ওয়েস্টহাম, আর্সেনাল, টটেনহ্যামের মতো ক্লাবের যুব দলে খেলেছেন মার্ক। কিন্তু পারফরম্যান্সে সে ছাপ রাখতে পারেননি। জেমি রেডন্যাপের মতো কোচের গুডবুকে থাকার পরেও তাকে রিলিজ করে দেয় টটেনহ্যাম। সে দিনটা ছিল তার জীবনের সবচেয়ে বাজে দিনের একটা।
সেই দিন মনে করে মার্ক পরে বলেছেন, ‘সেই দিন আমি প্রথম, অ্যলকোহল ছুঁয়েছিলাম। ইয়ুথ টিমের অধিনায়ক হয়ে যেখানে স্বপ্ন ছিল একদিন মূল দলে খেলার, সেখান থেকে ক্লাবহীন হয়ে পরলাম। পরিবার-পরিজন, আত্মীয়-স্বজনের সামনে মুখ দেখানোর অবস্থা ছিল না আমার।’
শেষমেশ এসেক্সের ছোটখাটো ক্লাবে খেলেই দিন কাটছিল তার। কিন্তু ২০১০ সালে রিয়েলিটি টিভি শোতে অ্যাপ্লাই করে ভাগ্য খুলে যায় রাইটের। এক দশক শো বিজনেসে থেকে এখন তার আয় বছরে প্রায় ১০ মিলিয়ন পাউন্ড। ফুটবল খেলতে না পারলেও ভাগ্যের চাকা ঠিকই ঘুরিয়েছেন রাইট নিজের মতন করে।
কিন্তু গানের লাইনের মতন বলতে হয়, ‘বায়োস্কোপের নেশায় আমায় ছাড়ে না।’
শৈশব-কৈশোরের নেশা ভুলতে পারেননি মার্ক রাইট। যখন সুযোগ পেয়েছেন খেলেছেন চ্যারিটি ম্যাচ। ২০২০ সালের শেষদিকে এসে পুরোনো ক্লাব ক্রলি টাউনের হয়ে প্র্যাক্টিস করতে থাকেন নিয়মিত। উদ্দেশ্য ছিল লকডাউনের পর নিজের শরীরটা ফিট রাখা; সাথে সাথে স্বপ্নটাকেও জিইয়ে রাখা। ৩৩ আর এমন কী বয়স?
কিন্তু এফএ কাপ খেলে ফেলার স্বপ্ন নিশ্চয়ই মার্ক দেখেননি!
ম্যানেজার জন ইয়েমস যে তার জন্য এমন পরিকল্পনা করে রাখবেন, তা কে ভেবেছিল? যে কোভিডের কারণে প্রায় দেড় দশক পরে নিজের পুরনো ক্লাবে ফেরত এসেছেন, সে ক্লাবকে নতুন করে ফুটবল খেলার সুযোগ করে দিল রাইটকে। ক্লাবের চতুর্থ সাবস্টিটিউট হিসেবে জ্যাক হ্যাসেনথালারের বদলে মাঠে নেমে আবার পূনর্জীবিত করেছেন নিজের ক্যারিয়ার। কে জানে, টিভির রিয়েলিটি শোর চ্যানেল থেকে ফুটবলের চ্যানেলে নতুনরূপে আবার আবির্ভুত হবেন কিনা ক্রলি টাউনের এই নতুন লেফট ব্যাক।
তবে এতকিছুর মধ্যে ক্রলি টাউনের ম্যানেজারকে ভুললে চলবে না।
জন ইয়েমস নিজের চতুর্থ ডিভিশনের দল নিয়েও যেভাবে চমক দেখিয়েছেন প্রিমিয়ার লিগ ক্লাব লিডসের বিপক্ষে তা এক কথায় অসাধারণ। শুধু কী তাই, তাবত বিশ্বের সেরা কোচেরা যাকে গুরু মানেন, সেই মার্সেলো বিয়েলসাকে নাকানিচুবানি খাইয়ে ছেড়েছেন জন।
ম্যাচে চারভাগের তিনভাগ সময় বল পজিশনে রেখে খেলেছে লিডস, পুরো মাঠ দৌড়ে বেরিয়েছে লিডস। এমনকি প্রথমার্ধ শেষে দুই দল মাঠ ছেড়েছে গোল ছাড়া। কিন্তু দ্বিতীয় হাফে ক্লান্ত লিডসের খেলোয়াড়দের ব্যবহার করেই নিজের সবটা আদায় করে নিয়েছে ক্রলি টাওন। লিডসের পজেশন লসের সর্বোচ্চ ব্যবহার করেছে ক্রলি টাওন। আর ৫২ বছর বয়সী জন ইয়েমস মার্সেলো বিয়েলসার মুখোমুখি হয়ে মাঠে ছেড়েছেন ৩-০ গোলের জয় নিয়ে।
এফএ কাপ যেন সত্যিই এক রঙ্গমঞ্চ!