বিশ্বকাপ ফুটবলে স্টেডিয়ামের ভিতর ধুম ধাড়াক্কা গান বাজনা, বাঁশি, ড্রাম বাজানোর দৃশ্য বেশ চিরায়ত। এবারের কাতার বিশ্বকাপে যদিও সেই চিত্রে খানিকটা ভাটা পড়েছে। তারপরও বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত লোক ঠিকই শামিল হয়েছে এ বৈশ্বিক মহাযজ্ঞে। তাই এ বিশ্বকাপেও আনন্দ, উদ্দীপনা, উচ্ছ্বাসের তেমন একটা কমতি নেই৷
ব্রাজিল থেকে এবার ওয়ালেস লেইটে নামের একজন ড্রামার এসেছেন। তিনি ব্রাজিল দলের কোনো অফিশিয়াল ড্রামার নন। তবে ৭ কেজি ওজনের এক ড্রাম নিয়ে ঘুরে ফিরে ব্রাজিলের খেলা দেখার প্রতি চরম নেশা তাঁর। তবে তাঁর সম্পর্কে যে বিষয়টি বেশি বিস্ময় জাগিয়েছে সেটি হল, তিনি এই কাতার বিশ্বকাপ দিয়ে দশটি বিশ্বকাপ শুধু ড্রাম বাজিয়েই ব্রাজিলকে সমর্থন জুগিয়ে গেছেন। সেই যে ১৯৯০ সালে তাঁর ড্রাম নিয়ে বিশ্বকাপ যাত্রা শুরু হয়েছিল সেই ড্রাম নিয়ে তিনি এখনো স্টেডিয়াম মাতাতে আসেন।
ওয়ালেস লেইটের এমন দারুণ গল্প হঠাৎই নজরে এসেছে বৈশ্বিক গণমাধ্যমে। আল জাজিরা তো তাঁর একটি সাক্ষাৎকারও ইতোমধ্যে নিয়ে ফেলেছে। সেখানে তিনি বলেন, ‘ড্রাম বাজানোর মধ্যে আমি আমার আনন্দ খুঁজে নিই। ১৯৯০ বিশ্বকাপ থেকে আমি প্রত্যেকটা বিশ্বকাপেই ব্রাজিলের পথযাত্রার সাক্ষী ছিলাম। কত শত স্মৃতি। সময়ের পর সময় গড়ালেও, ম্যাচের সময় প্লেয়ারদের সমর্থন জোগাতে আমার ড্রাম বাজাতে একটুও ক্লান্তি আসে না।’
এবারের কাতার বিশ্বকাপে ব্রাজিলিয়ান এ ড্রামারের কেমন লাগছে? এমন প্রশ্নে লেইটে বলেন, ‘এখানে কোনো ইস্যু নেই,কোনো রাজনীতি নেই। খুবই শান্তিপূর্ণ পরিবেশ। সবাই খুবই উপভোগ করছে।’
ওয়ালেস লেইটের বয়স এখন ৬০ এরও বেশি। তো এই বয়সে এসে ৭ কেজি ড্রাম বহনে কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা তা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘জীবনে বহু ইনজুরির শিকার হয়েছি। শরীরের এমন কোনো জায়গা নেই যে যেখানে আমি আঘাত পাইনি।
হাত, পা, কাঁধ সব জায়গায় আমার ব্যথা রয়েছে, আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। তবে প্রত্যেকটা বিশ্বকাপ চলাকালেই আমি বেশ কিছু থেরাপি নিই, ম্যাসাজ পার্লারেও নিয়মিত যাই। তাই এখন পর্যন্ত মোটামুটি ঠিক আছি। তবে বছরের পর বছর ড্রাম বাজানোর কারণে এটাতে আমি অভ্যস্ত হয়ে গেছি। বরং এটা বলা যায়, এই ড্রাম ছাড়া আমার জীবন অর্থহীন।’
লেইটেকে মানুষ ভালবেসে ‘ওয়ার্ল্ড কাপ ওয়ালেস’ বলে ডাকে। প্রতি আসরে তিনি রীতিমত তারকা খ্যাতিতে ডুবে যান। অটোগ্রাফ, ফটোগ্রাফের জন্য অনেকে তাঁর কাছে ভিড়ও জমান। তবে নিজেকে সেলেব্রিটি ভাবতে নারাজ লেইটে। তিনি বলেন, ‘নিজেকে কখনোই অমন তারকা বলে আমার মনে হয় না। তবে হ্যাঁ, মানুষের এমন ভালোবাসা দু’হাত ভরে নিই। এটা সত্যিই একটা দারুণ অনুভূতি জোগায়।’
ওয়ালেস লেইটে প্রথম দিককার বিশ্বকাপের আসরগুলোতে নিজ খরচেই যেতেন। তবে আস্তে আস্তে তিনি সবার নজরে আসতে শুরু করেন। তাই এরপরে বেশ কিছু বিশ্বকাপে আয়োজক দেশ তাকে বিশেষ ভাবে আমন্ত্রণ জানাত। এমনকি তাকে বিশেষ পর্যটক হিসেবে সে সব দেশ খুব খাতিরও করত। এভাবে বহু দেশ ঘোরার ফলে লেইটের অনেক বন্ধুও আছে। এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘আমি অনেক বন্ধু বানিয়েছি। পৃথিবীর বহু দেশে আমার বন্ধু আছে। আর বহু দেশ ঘোরার কারে সেসব দেশের ইতিহাস ও সংস্কৃতি সম্পর্কে আমার বহু জানার সুযোগ হয়েছে। আমি আসলেই অনেক ভাগ্যবান।’
৬০ বছরের জীবনে লেইটে বহু বিশ্বকাপ দেখেছেন। তবে তাঁর প্রিয় বিশ্বকাপের আসরটি হল, আজ থেকে ৫২ বছর আগের ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ। সে বিশ্বকাপে ব্রাজিল চ্যাম্পিয়ন হয়েছ। আর পেলের ক্যারিয়ারের শেষ বিশ্বকাপও ছিল সেটিই। অবশ্য মেক্সিকোয় হওয়া সে বিশ্বকাপের সময় লেইটের বয়স ছিল মাত্র ৮! তবে শিশু বয়সে দেখা ঐ বিশ্বকাপটি তাঁর আজও গেঁথে আছে।
লেইটে জীবনে বহু বিশ্বকাপের আসর সামনাসামনি দেখেছেন। তবে তাঁর দৃষ্টিতে আয়োজক দেশ হিসেবে ৮৬ এর আয়োজক মেক্সিকোর আতিথেয়তা তাঁকে মুগ্ধ করেছিল। যদিও ১৯৯০ বিশ্বকাপ থেকে লেইটের ড্রাম বাজানো শুরু। তবে তিনি ১৯৮৬ বিশ্বকাপও দেখেছিলেন।
আর্জেন্টিনার শিরোপা জেতা সে বিশ্বকাপের স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘মেক্সিকো মানেই আমার কাছে বিশেষ কিছু। ওদের আতিথেয়তা অন্য রকমের। মেক্সিকোর মানুষজনও খুব তাড়াতাড়ি অচেনা লোকদের সাথে মিশে যেতে পারে। সেবার আমি বিশ্বকাপে গিয়েছিলাম। কিন্তু পরিবহন খরচ থেকে শুরু করে খাওয়া, থাকার খরচের একটি টাকাও আমাকে খরআ করতে হয়নি। সব তারা করেছিল। এমন না তারা আমার পূর্ব পরিচিত ছিল কিংবা তাদের অন্য কোনো স্বার্থ ছিল। তারা নি:স্বার্থভাবে আমার পাশে ছিল। আমি জীবনেও মেক্সিকানদের কথা ভুলব না।’
১৯৯০ থেকে ২০২২, এই দশ আসরের দুটি আসরের চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল লেইটের দেশ ব্রাজিল। তবে ২০ বছর ধরে দেশটির বিশ্বকাপ শিরোেপা জেতেনি। এবার কি সেই খরাটা কাটবে? এমন প্রশ্নে ওয়ালেস লেইটে বলেন, ‘২০ বছর আগে জিতেছিলাম। জাপানে হওয়ার সে বিশ্বকাপের স্মৃতি এখনও আমার চোখে ভাসে। আশা করছি, সেই স্মৃতি এবার তারা ফিরিয়ে আনতে পারবে।’
লেইটের সহধর্মিণী কার্মেন প্রথম সময়ে সাও পাউলোতে এক ফ্যাশন ইন্ডাস্ট্রিতে কাজ করতেন। এরপর তিনিও তাঁর স্বামীর সাথে যোগ দেন। তিনিও বিশ্বকাপে ড্রামের তালে নেচে গেয়ে ব্রাজিলকে সমর্থন দিতেন। সেই তারুণ্য তারা দুজনই ফেলে এসেছেন। লেইটেরও তাঁর স্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। এ নিয়ে তিনি বলেন, ‘কার্মেন আমাকে সব সময়ই সাপোর্ট দিয়ে গিয়েছে। কস্টিউট থেকে শুর করে অনেক কিছুই সে নিয়ন্ত্রণ করত। আমার জন্য তাই কাজটা অনেক সহজ হয়ে যেত।’
ওয়ালেস লেইটেকে শেষ প্রশ্ন করা হয়েছিল, ড্রাম বাজাতে কখনো ক্লান্ত লাগে না? কতক্ষণ এক নাগাড়ে বাজাতে পারেন সর্বোচ্চ? লেইটে সেই প্রশ্নের উত্তরে সবাইকে স্তব্ধ করে বলেন, কোন টাইম ফ্রেম নেই। আমি শুধু বাজাতে থাকি। কখন থামবে সেটা ঈশ্বর জানেন। আমি বাজাই, আমার শরীর এগোই, যতদিন এই শরীর কুলাবে ততদিন এই ড্রামকে নিয়ে বেঁচে থাকব।
লেইটে ফুটবল ইতিহাসের কোনো সদস্য নন। অন্তত খাতাকলমে তো নয়-ই। তবে একটা খেলায় যেখানে দর্শক প্রাণ হয়ে থাকে সেখানকার তিনি সন্দেহাতীতভাবে নিউক্লিয়াস। যুগের পর যুগ ধরে এমন পাগলাটে সমর্থকদের জন্যই তো ফুটবলটা এত সুূন্দর, এত নান্দনিক। কারণ দিন শেষে ফুটবলের সৌন্দর্য্য রোমন্থন করে এই লেইটেরাই। অতীত অনেক সোনালি সময়ের স্বর্ণালি অধ্যায় নতুন করে উল্টে পাল্টে দেখা হয় এই লেইটেদের হাত ধরেই। লেইটেদের জন্য তাই একটা কুর্নিশ!
– আল জাজিরা অবলম্বনে