কালের বিবর্তনে মানুষ নিজেদেরকে মানিয়ে নিয়ে টিকে থাকতে চেয়েছে। কেউ কেউ আবার খানিকটা ভিন্ন পথে হেটেছেন। নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার পরিবর্তে একেবারে রুপান্তরিত করে ফেলেছেন নতুন সাজে। বনে গেছেন আগের চাইতেও শক্তিশালী। সে তালিকায় এখন নিশ্চয়ই হার্দিক পান্ডিয়াও নিজেকে আবিষ্কার করতে শুরু করেছেন।
হার্দিক পান্ডিয়া, ভারতের ক্রিকেটের গেল কয়েক বছরে বেশ পরিচিত, আলোচিত কিংবা সমালোচিত এক নাম। কখনো ব্যক্তিগত জীবন অথবা কখনো নিজের পারফর্মেন্সের কারণে তাকে সইতে হয়েছে সমালোচনার বিষবাণ। তবে না সে বিষে তিনি কুপকাত হয়ে ঘোর অন্ধকারে হারিয়ে যাননি। সে বিষ তার ক্ষতির চাইতে উপকারই করেছে বেশি। তিনি নিজেকে ঢেলে সাজিয়েছেন সে বিষকে অমৃত সুধা মনে করেই।
তিনি যখন এলেন ভারতীয় ক্রিকেট অঙ্গনে তখন তাকে স্রেফ একজন সম্ভাবনাময় অলরাউন্ডার হিসেবেই গন্য করা হচ্ছিল। এর আগে অবশ্য তার কোন অস্তিত্বই যেন ছিল না। তিনি রঞ্জি দলের হয়েও ছিলেন না নিয়মিত। একেবারেই সাদামাটা তরুণ, ক্রিকেটার হওয়ার স্বপ্নে বিভোর। ভারতে ক্রিকেটারদের রীতিমত পূজা করা হয়, ক্রিকেটকে পূজা করা হয়। কে না চায় বলুন প্রায় ১২০ কোটি মানুষের মনে জায়গা করে নিতে?
হার্দিক পান্ডিয়াও চেয়েছিলেন। তবে ঠিক পথ খুঁজে পাচ্ছিলেন না। সে পথ হয়েই যেন তার সামনে হাজির হয় ইন্ডিয়ান প্রিমিয়ার লিগ (আইপিএল)। তবে সে পথ প্রদর্শক মানা হয় ইরফান পাঠানকে। বরোদার সবচেয়ে বড় তারকা ইরফান পাঠান ছিলেন ভারত জাতীয় দলের এক সময়কার অন্যতম আস্থাভাজন একজন অলরাউন্ডার। তিনি জানতেন আসলে ভারত দলের ঠিক কি প্রয়োজন। আর সে প্রয়োজন মেটানোর গুণাবলি তিনি দেখেছিলেন হার্দিকের মাঝে।
তাইতো, রঞ্জিতে নিয়মিত খেলতে না পারা ছেলেটা সুযোগ পেয়ে গেল আইপিএলে। যেখানে তার ঘরোয় ক্রিকেটের পরিসংখ্যান তাকে এড়িয়ে যাওয়ার জন্য যথেষ্ট। শুরুতে বলা কথাটা আবার বলার প্রয়োজন। তিনি নিজেকে রুপান্তরিত করে ফেললেন। হতশ্রী ঘরোয়া পরিসংখ্যান তাকে আর দমিয়ে রাখতে পারল না। পেছন ফিরে তাকানোর দিন যেন শেষ। তিনি ক্রমশ সাফল্যের সিড়ি বেয়ে উঠে যাচ্ছিলেন উপরের দিকে।
মাঝে খানিকটা ছন্দপতন ২০২১ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে তার অফফর্ম জন্ম দিয়েছিল একরাশ সমালোচনার। অনেকে ভারতের প্রথম রাউন্ড থেকে বাদ হয়ে যাওয়ার দায় তার উপর দিতেই যেন বেশ স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। কিন্তু আবার ঐ যে পরিবর্তনই মূল মন্ত্র। হার্দিক নিজেকে আবার পালটে ফেললেন। তিনি এবার রীতিমত আরও বেশি কার্য্যকর একজন খেলোয়াড় হিসেবেই পূর্ণতা পেলেন।
শুধু খেলোয়াড় নন, তিনি যেন একজন যোগ্য অধিনায়ক হওয়ার দাবিদার। অন্তত টি-টোয়েন্টি ফরম্যাটে। দলকে নেতৃত্ব দেওয়ার সক্ষমতা তিনি অর্জন করেছেন। সেটা থেকেও বড় কথা তিনি শিখেছেন কি করে কঠিন পরিস্থিতির মুখে থাকতে হয় একেবারে বরফ শীতল পানি। সে কাজটা বোধকরি মহেন্দ্র সিং ধোনির থেকে আর ভাল এই আধুনিক ক্রিকেটে করতে পারেন না। আর হার্দিক তো ধোনিকেই মানেন নিজের অনুপ্রেরণা।
গুজরাট টাইটান্সের হয়ে পঞ্চদশ আইপিএলের শিরোপা নিজের হাতে তোলার আগেই ভারত দলের সব কিংবদন্তিদের বেশ পছন্দের একজন ছিলেন হার্দিক। সেটা ধোনি বলেন কিংবা বিরাট কোহলি অথবা রোহিত শর্মা। সবার মন জয় করে নিতে খুব বেশি সময় লাগেনি হার্দিকের। এমন কি তিনি সময় অসময়ে পেয়েছেন ভারতের সবচেয়ে সফল অধিনায়ক মহেন্দ্র সিং ধোনির টোটকা।
আর সেসব টোটকা কাজে লাগিয়েই তিনি অভিষেক বছরের গুজরাট টাইটান্সকে জিতিয়েছেন শিরোপা। এই যে অধিনায়ক সত্ত্বাটা যেমন তিনি নতুন করে সামনে আনলেন ঠিক তেমনি তার পুরনো অলরাউন্ডার সত্ত্বার একটা নতুন মোড়ক উন্মোচন হল এবারের আইপিএলে।
স্বাভাবিকভাবেই তার ‘পাওয়ার হিটিং’ সক্ষমতার জন্য ‘ফিনিশার’। তবে না তিনি যে মিডল অর্ডারের ভরসার জায়গা হতে পারেন সে প্রমাণও রাখলেন এবারে আইপিএলে। গুজরাটের মিডল অর্ডার তো তিনি একাই যেন টেনে নিয়ে গেছেন।
ফাইনালের দিনও তার সময়পোযোগি ৩৪ রান করে দলের জয়ের ভীতটা গড়ে দিয়েছিলেন। আর যে বোলিং নিয়ে এত সমালোচনা ও আশঙ্কা দল থেকে বাদ পড়ে যাওয়ার সেটারও এক ঝলক উন্নতি দেখিয়ে দিয়েছেন। জস বাটলার, সাঞ্জু স্যামসন ও শিমরন হেটমায়ার এই তিন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাটারের উইকেট ফাইনালে নিজের পকেটে পুরেছেন। দিয়েছেন কেবলমাত্র ১৭ রান। ২৪ বলের ১৪ খানাই ডট। সুতরাং বোলার হার্দিকও হারিয়ে যাননি।
এই হার্দিক পান্ডিয়ার এত পরিবর্তন, এতটা রুপান্তর সবকিছুই যেন সমালোচকদের মুখে কুলুপ এঁটে দিল। আর তাছাড়া এটাও প্রমাণ করল হার্দিক পান্ডিয়া নতুন এক প্যাকেজ হয়েই তৈরি বিশ্বকাপ জয়ের জন্যে। নিশ্চয়ই তিনি অস্ট্রেলিয়া যাচ্ছেন টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ খেলতে। কি যাচ্ছেন না?