আবার মোহামেডান

সাকিব আল হাসান, মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম, সৌম্য সরকার, তাসকিন আহমেদ, মেহেদী হাসান মিরাজ।

খেলোয়াড়দের নাম তো শুনলেন। এবার দলটার নাম বলুন তো?

প্রথম দেখাতে এটাকে বাংলাদেশ জাতীয় দল বলে ভুল করারই কথা। সেই ভুলটা শোধরানোর পর আপনি বড় জোর অনুমান করতে পারেন যে, এটা আগামী মৌসুমের আবাহনী লিমিটেড। না, এ অনুমানেও একটু ভুল থেকে গেলো।

বিশ্বাস করুন, আর নাই করুন – এই তারকাখচিত দলটির নাম মোহামেডান স্পোর্টিং!

এই ২০২১ সালে এসে মোহামেডানের তারকাখচিত দল করাটা আসলেই বিষ্ময়কর ঘটনা। কিন্তু বাস্তবতাটা চিরকাল এমন ছিলো না। এই বেশি না, এক যুগ আগেও বাংলাদেশের ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় পাওয়ার হাউজগুলোর একটা ছিলো মোহামেডান।

মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাবের যাত্রা শুরু তো গত শতকের তিরিশের দশকে। ক্রিকেটেও তারা স্বাধীনতার আগে থেকে অংশ নিয়ে আসছে। স্বাধীনতার পর ঢাকা লিগ শুরু হলে সেখানে সবচেয়ে বড় আকর্ষন ছিলো আবাহনী ও মোহামেডানের লড়াই।

রাজনৈতিক দর্শনে দুই ভিন্ন মেরুতে অবস্থান এই দুই ক্লাবের। দেশের রাজনৈতিক পটবদলের প্রত্যক্ষ ছাপ পড়তো এই দুই ক্লাবের দাপটের ওপর। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি এসে প্রথম ঢাকা লিগ জেতে মোহামেডান। আশি ও নব্বই দশক জুড়ে আবাহনী-মোহামেডান ক্রিকেট দ্বৈরথও আকর্ষনীয় এক ব্যাপার ছিলো।

এটা ঠিক যে, ফুটবলের মতো যুদ্ধাবস্থা ক্রিকেটে এই দু দলের লড়াইয়ে খুব একটা তৈরী হয়নি। তারপরও ব্যাপারটা আজকের মত নিরুত্তাপ ছিলো না।

আবাহনীর অধিনায়ক তখন গাজী আশরাফ হোসেন লিপু। সেই সময়ে মোহামেডানের পতাকা ওড়াচ্ছেন মিনহাজুল আবেদীন নান্নু, আমিনুল ইসলাম বুলবুলরা। লিপু-নান্নুর সেই সময়ে আবাহনী-মোহামেডানের পরষ্পরকে টপকে যাওয়ার চেষ্টা ছিলো অসাধারণ। দুই দল প্রতিযোগিতা করে বিশ্বের দামী দামী সব তারকাকে আনতো ঢাকার ক্রিকেটে। সেই ধারাবাহিকতায় ওয়াসিম আকরাম থেকে শুরু করে অর্জুনা রানাতুঙ্গা, সনথ জয়াসুরিয়ারা খেলে গেছেন মোহামেডানের জার্সি গায়ে।

১৯৭৭ সালে প্রথম শিরোপা জেতা মোহামেডান গুণে গুণে নয়টা লিগ শিরোপা জিতেছে; কেবল মাত্র ১৭ শিরোপা জেতা আবাহনীই তাদের ওপরে আছে এই দিক থেকে।

বেশি না, এই ২০১০-১১ সালেও মোহামেডান তারকা খচিত দল গড়তো চ্যাম্পিয়ন হওয়ার জন্য। দেশের মধ্যে সেরা সাকিব আল হাসান, তামিম ইকবালরাও একসাথে খেলেছেন এই দলের হয়ে। এসেছেন বাইরের তারকারাও। কিন্তু গত প্রায় এক যুগ ধরে সে সবই স্মৃতি হতে বসেছিলো।

প্রথমে মোহামেডানের এক শীর্ষ কর্মকর্তা দল বদল করে ফেললেন। তিনি পরে নিজেই একটা দলও করে ফেললেন। এই ভদ্রলোক ছিলেন তার আগের বেশ কিছুদিন মোহামেডানের তারকাদের ভেড়ানোর মূল ব্যক্তি। তিনি চলে যাওয়ার পর একটা ভাটা পড়ে মোহামেডানের ক্রিকেট দল গঠনে। এরপর রাজনৈতিক অবস্থাও একটা ভূমিকা রাখে। মোহামেডানের স্পন্সররা একটু গুটিয়ে নেন নিজেদেরকে। ফলে তারকা খচিত দল গঠন করার মত অর্থেরও অভাব হতে শুরু করে।

এরপর আরামবাগ খেলার পাড়ায় ক্যাসিনো কাণ্ডে ধরপাকড় মোহামেডানকে আরও প্রান্তে ঠেলে দেয়। ফলে দেশের অন্যতম ঐতিহ্যবাহী এই দলটির টিকে থাকা নিয়েই শঙ্কা তৈরী হয়। অবশেষে সেই জায়গা থেকে ঘুরে দাড়িয়েছে মোহামেডান।

গত কিছুদিনে মোহামেডানের সাথে যুক্ত হয়েছেন সমাজের ও প্রশাসনের বেশ কিছু ক্ষমতাধর ও ক্রীড়ামোদী মানুষ। আর এরা আসার পর থেকেই সময়টা বদলাতে শুরু করেছে। এবার দলবদলের আগেই তারকাখচিত এক দল গঠন করে ফেলেছে তারা।

মাহমুদউল্লাহ রিয়াদ, মুশফিকুর রহিম, সৌম্য সরকার, তাসকিন আহমেদ, মিরাজদের সাথে আনুষ্ঠানিক চুক্তি করে ফেলেছে মোহামেডান। যতদূর জানা গেলো, সাকিব আল হাসানও গত বছরের মত মোহামেডানেই থাকছেন।

মোহামেডানের এই তারকাখচিত দল করাটা দেশের ক্রিকেটের জন্য একদিক থেকে শুভ একটা ব্যাপার। হ্যা, পুল ব্যবস্থা না থাকায় একটা মনোপলি আবাহনী ও মোহামেডানের তৈরী হবে। তাতে মাঝারি মানের দলগুলো হয়তো খুব বেশি তারকা পাবে না। কিন্তু এটা সত্যি যে, বাংলাদেশের ক্রিকেটে যে একটা এককেন্দ্রিক অচলাবস্থা তৈরী হয়েছিলো, সেটা সম্ভবত কেটে যাবে।

সবচেয়ে বড় কথা, আরেকবার আবাহনী-মোহামেডান লড়াইটা জমবে। মোহামেডান শিরোপা জিতুক আর নাই জিতুক, লড়াইটা তো জমে উঠবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link