ব্যাট হাতে অফ ফর্ম, চরম অধারাবাহিক; অধিনায়ক হিসেবেও টানা ব্যর্থ, দলের করুণ দুর্দশা; প্রেস ব্রিফিংয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের ছন্নছাড়া জবাব – সব মিলিয়ে সমালোচনার বেড়াজালে বন্দি ছিলেন বাংলাদেশের টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুল হক। তবে সমালোচনার সেই বাক্সে নিজেকে বেশিদিন বন্দি করে রাখতে চাইলেন না তিনি। একটু হাফ ছেড়ে বাঁচতে নিয়ে ফেললেন সিদ্ধান্ত- অধিনায়কের দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়ালেন ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের আগ মূহুর্তে।
জুয়াড়ির প্রস্তাব আইসিসির কাছ থেকে লুকানোয় বছর খানেকের জন্য সব ধরনের ক্রিকেটে নিষেধাজ্ঞা পেয়েছিলেন সাকিব আল হাসান। এরপরই টেস্ট অধিনায়কের দায়িত্বটা কাঁধে উঠে ব্যাট হাতে সাদা পোশাকে উড়ন্ত ফর্মে থাকা মুমিনুল হকের। এই অধিনায়ক ‘ট্যাগ’ যেন কাল হয়ে দাড়ালো মুমিনুলের ক্যারিয়ারে। সেই সাথে টেস্ট ফরম্যাটে বাংলাদেশ দলের চিত্রটাও দেখা গেল শোচনীয়।
মুমিনুলের ব্যাটে রানের দেখা নেই, অধিনায়ক হিসেবে জন্ম দিয়েছেন সমালোচনার।
নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে মাউন্ট মঙ্গানুইতে ইতিহাস গড়ে ৮ উইকেটের জয় তুলে নেয় বাংলাদেশ। ওই টেস্টে দলের জয়ে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন মুমিনুল। খেলেছিলেন ৮৮ রানের অসাধারণ এক ইনিংস। মুমিনুলের অধীনে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে নিউজিল্যান্ডকে প্রথমবারের মত হারিয়ে ঐতিহাসিক জয় পায় বাংলাদেশ।
ব্যাট হাতে আলোর দেখাটা ওই পর্যন্তই। পরের দশ ইনিংসে রান খরায় ভুগছেন তিনি। ৮৮ রানের ওই ইনিংসের আগের চার ইনিংসেও ছুঁতে পারেননি দুই অঙ্কের কোটা। সবশেষ ১৫ ইনিংসে মাত্র এক ফিফটি। বাংলার ‘ডন ব্র্যাডম্যান’ আখ্যা পাওয়া মুমিনুল যেন নিজেকে হারিয়ে খুঁজছেন। ব্যাট হাতে অফ ফর্ম, দলের অবস্থাও নাজেহাল। প্রতিপক্ষের সামনে অসহায়ত্ব দেখিয়ে মুখ থুবড়ে পড়ছে বাংলাদেশের ব্যাটিং শিবির। অবশ্য এর জন্য মুমিনুল একা দায়ী নন।
তবে অধিনায়ক হিসেবে মুমিনুলের ভূমিকা কি? ব্যাটার মুমিনুল চরম ব্যর্থ। নিজের স্বভাবসুলভ ব্যাটিংয়ের দেখা নেই। সেই সাথে অধিনায়ক হিসেবে যে বিশেষ একটা দায়িত্ব সেটি পালনেও তাঁকে খুব একটা সক্রিয় দেখা যায়নি। শরীরী ভাষায় যেন কোথায় একটা খামখেয়ালীপনা কিংবা কিংকর্তব্যবিমূঢ় ভাব স্পষ্ট।
রিভিউ নেওয়া নিয়েও কম সমালোচিত হননি তিনি। অবশ্য রিভিউ নেওয়ার ব্যাপারে বোলার ও উইকেটরক্ষকের দায়টাই সবচেয়ে বেশি। রিভিউ নেওয়ার ক্ষেত্রে সময়টা খুবই কম থাকে; বেশ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে হয়। কিন্তু এক্ষেত্রেও মুমিনুলের শরীরী ভাষাটা টেলিভিশনের পর্দায় যেন সমর্থকদের জন্য বিরক্তের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তিনি নিজেই যেন সংশয় আর দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ভুগেন।
নিজের ব্যাটিং নিয়ে তিনি মোটেও বিচলতি নন – এমন কথা গণমাধ্যমের সামনে বেশ কয়েকবার বলেছেন। নিজের ব্যর্থতা কিংবা দলের ব্যর্থতা মাথায় নিয়ে ভুল শোধরানোর ব্যাপারটা পাশ কাটিয়ে প্রেস কনফারেন্সে মুমিনুল চটপটে উত্তর দিতে মোটেও ভাবছেন না। সব মিলিয়ে মুমিনুলকে নিয়ে সমালোচনার মাত্রাটা তাই তীব্র।
মুমিনুলের অধিনায়ক হিসেবে পরিসংখ্যানটা একটু দেখা যাক। সাদা পোশাকে দেশের হয়ে ১৭ টেস্টে অধিনায়কত্ব করেছেন। জয় মাত্র তিনটিতে। তবে মাত্র শব্দটা না বলাই ভাল। বাংলাদেশের টেস্টে যে করুণ দশা সেদিক থেকে তিন জয়কে মোটেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। ১৭ ম্যাচে মুমিনুলের অধীনে তিন জয় আর দুই ড্র দেখেছে বাংলাদেশ। বিপরীতে ১২টিতেই হেরেছে দল।
মাউন্ট মঙ্গানুই টেস্টে জয়ের জন্য মুমিনুল কিছুটা কৃতীত্ব পেতেই পারেন। ব্যাট হাতেও ভাল ইনিংস খেলেছেন। সেই সাথে বাংলাদেশের প্রথম অধিনায়ক হিসেবে নিউজিল্যান্ডের মাটিতে জয়; সেটিও টেস্ট ফরম্যাটে। অধিনায়ক হিসেবে মুমিনুলের ক্যারিয়ারের সেরা প্রাপ্তি হয়ে থাকবে এই টেস্ট।
ব্যাট হাতে অধিনায়ক হিসেবে ১৭ টেস্টে ৩১ ইনিংসে তিন সেঞ্চুরি আর দুই হাফ সেঞ্চুরি করেছেন। রানের হিসেবে সেটা দাঁড়ায় ৯১২ তে। অধিনায়ক হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর ব্যাট হাতে শুরুটা বেশ ভালই ছিল। প্রথম সাত টেস্টের তিনটিতে করেন সেঞ্চুরি। কিন্তু এরপরই যেন সমর্থকদের প্রত্যাশা আর সাদা পোশাকে অধিনায়কের তকমার চাপ বোঝা হয়ে দাঁড়ায় মুমিনুলের জন্য। সেটা তাঁর ব্যাটিংয়ে স্পষ্ট।
হয়তো বাংলাদেশের সেরা টেস্ট ব্যাটারদের একজন তিনি। কিন্তু, অধিনায়কত্ব? না, এখানে মুমিনুল অনেক পেছনে। আসলে, কখনোই অধিনায়কত্বের জন্য সঠিক পছন্দ ছিলেন না মুমিনুল।
অধিনায়কত্ব ছেড়েছেন – এবার সমালোচনা-চাপ খানিকটা কমবে। তবে, এবার ব্যাটে রান খরায় ভুগতে থাকলে একাদশ থেকে হারিয়ে যাবেন, তিনি সেটাও জানেন। আপাতত খানিকটা বিশ্রাম নিয়ে নতুন উদ্যমে ফিরুক ব্যাট হাতে চিরচেনা সেই মুমিনুল; এটা প্রত্যাশা সমর্থকসহ ক্রিকেট ভক্তদের।