মোনেম মুন্না টু জামাল ভূঁইয়া

একটা সময় ভারতের ফুটবল লিগে বাংলাদেশি ফুটবলারদের অংশগ্রহণ ছিল নিয়মিত।

কলকাতার পত্রিকাগুলোতে থাকত বাংলাদেশি ফুটবলারদের ছবি। কলকাতার পত্রিকাগুলোর প্রথম পাতায় ছাপা হত মোনেম মুন্না, আসলাম, কায়ছার হামিদদের ছবি। প্রথম পাতায় ছাপা হত তাঁদের কীর্তির গল্প।

বিশেষ করে মোনেম মুন্না নিয়ে হত বেশি মাতামাতি। বাংলাদেশের প্রয়াত এই ফুটবলার খেলতেন ইস্ট বেঙ্গলের হয়ে। বাংলাদেশে পোস্টার বয়ের ফুটবল কৃতির কথা অনেকেও জানা। বিশেষ করে আশি-নব্বইয়ের দশকের ফুটবল পাড়ার খবর যারা রাখতেন, তাদের কাছে অজানা নয়।

মুন্না ছাড়াও রুমি, আসলামরা খেলেছেন ইস্ট বেঙ্গলের হয়ে; মাতিয়েছেন ওপার বাংলার ফুটবল লিগ। কায়সার হামিদ, জনিরাও দাপুটের সাথে খেলেছেন ওপার বাংলার ফুটবল লিগে।

তাদের পরে থেমে যায় ভারতের ফুটবলে বাংলাদেশিদের আনাগোনা। গতক দুই দশকেরও বেশি সময় ভারতের ফুটবল লিগে দেখা যায়নি বাংলাদেশের কোনো ফুটবলারকে৷ ভারতের কোনো ক্লাব বাংলাদেশী ফুটবলার দলে নিতে আগ্রহ দেখায়নি। সে দায়টাও আমাদের ফুটবলের ও ফুটবলারদের। কারণ কেউ তো লোক দেখানোর জন্য কাউকে দলে নিবে না।

দুই দশকের এক বিরতির পর কিছু দিন আগে ডাক পেয়েছিলেন বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবলের সাবেক অধিনায়ক মামুনুল হক। প্রতিবেশি দেশের ফুটবল লিগে ডাক পেলেও কোনো ম্যাচ না খেলে দেশে ফিরতে হয় তাকে।

মুন্না, আসলাম, কায়ছার হামিদ, মামুনুলদের পর এবার কলকাতা মোহামেডানের আই লিগ খেলতে গেছেন জামাল ভূঁইয়া।

বিশ্বকাপ বাছাইয়ের এক ম্যাচে বাংলাদেশ প্রায় হারিয়ে দিয়েছিল ভারতকে। হারতে বসা সেই ম্যাচের শেষ দিকে গোল করে ড্র করতে সক্ষম হয় ভারত। এই ম্যাচের বাংলাদেশের পারফর্মেন্সের পর চিত্রটা পালটে গেছে। ভারতের খেলোয়াড়, কোচ, ক্লাব নিয়ে যারা থাকেন তাদের সবার প্রসংশা পেয়েছে বাংলাদেশ। সে ম্যাচে বাংলাদেশ দলের টেকনিক, ট্যাকটিকস, স্কিল আর গতি ওদের পরাস্ত করেছিল শুরু থেকেই।

তারপর থেকে বাংলাদেশের ফুটবলারদের নিয়ে আলাদা করে ভাবা শুরু করে ভারতের ক্লাব কর্তারা। বিশেষ করে বাংলাদেশের অধিনায়ক জামাল ভূঁইয়া শুরু হয় বেশ আলোচনা। তাঁর স্কিল আর গতি নিয়ে বেশ মাতামাতি হয় ভারতের ফুটবল পাড়ায়। কলকাতার ফুটবল অঙ্গনে দারুণ জনপ্রিয়তা পান এই ফুটবল তারকা। ওপার বাংলার ফুটবল এতোটাই জনপ্রিয়তা লাভ করেন যে, একাধিক ক্লাব বেশ কয়েক মাস ঘুরেছে জামালের পিছনে। প্রথমে মোনেম মুন্নার দল ইস্ট বেঙ্গল, পরে ঐতিহ্যবাহী মোহামেডান।

আইলিগের এই দুই দল ছাড়া তাঁকে দলে নিতে পারে আইএসলের ক্লাবগুলোও, এমনটা শোনা যাচ্ছিল। কিন্তু সব কিছু ছাপিয়ে বাংলাদেশের এই অধিনায়ক নাম লিখিয়েছেন মোহামেডানে। তার পিছনে মূল ভূমিকা রেখেছেন তাঁর কোচ। মোহামেডানের পুরনো ঐতিহ্য তাঁকে টেনেছে বেশি। তাঁর সামনে সুযোগ ছিল অনেক। প্রস্তাব পেয়েছিলেন ইস্ট বেঙ্গল থেকে, ফ্রাঞ্চাইজি লিগ আইএসলেও ডাক এসেছিল।

ডেনমার্কে জন্ম ও বেড়ে ওঠা জামালের ‘বাংলাদেশি’ হওয়ার গল্পটা বেশি দিনের নয়। ইউরোপের এই দেশটিতে তাঁর ফুটবলের হাতেখড়ি। বাংলাদেশে না আসলে আজ তিনি ডেনমার্ক জাতীয় দলের জার্সি গায়ে জড়াতে পারতেন হয়তো। ছোট বেলার তাঁর দুই বন্ধু এখন ডেনমার্ক জাতীয় দলে জায়গা পেয়েছেন। সেই হিসাবে বলা যায় তাঁকেও দেখা যেত ডেনমার্ক দলে। নিজের ইচ্ছাতেই জামাল লাল সবুজের জার্সিতে ফুটবল খেলতে চলে আসে বাংলাদেশে।

ডেনমার্কে বেড়ে উঠলেও বাংলাদেশেই তাঁর শিখর পরে আছে। তাঁর বাবা- মা বাংলাদেশি, তাই তিনি বাংলাদেশ জাতীয় দলের হয়ে ফুটবল খেলতে চেয়েছেন। তার কাছে বাংলাদেশের হয়ে খেলাটা গর্বের ব্যাপার।

জামাল ভূঁইয়ার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ার শুরু ২০১৩ সালে; বাবা মায়ের দেশে বাংলাদেশের হয়ে। সে বছর প্রবাসী ফুটবলার হিসেবে জাতীয় দলে অভিষেক হয় তাঁর। খুব অল্প সময়ের ভিতরে নিজের জাত চেনান জামাল। সেই সাথে জাতীয় দলে নিজের জায়গাটা পাকাপোক্ত করে নেন।

অভিষেকের পর থেকেই বাংলাদেশ দলের মাঝমাঠের প্রাণভোমরা তিনি। ২০১৫ সালে বঙ্গবন্ধু গোল্ডকাপে হন মোস্ট ভ্যালুয়েবল প্লেয়ার। ২০১৮ সালে এশিয়ান গেমসে তাঁর করা একমাত্র গোলে কাতারকে হারায় বাংলাদেশ। আর তাতেই নকআউট পর্বে খেলার সুযোগ পায় বাংলাদেশ।

দেশের ফুটবলে অভিষেকের পর থেকেই আলো ছড়িয়েছেন এই বুটার। শুধু খেলোয়াড় হিসেবে নয়, ফুটবলে ভাষ্যকার হিসেবে আলাদা একটি পরিচিত আছে তাঁর। স্প্যানিশ লা লিগায় অতিথি ধারাভাষ্যকার হিসেবে অনন্য কৃর্তির সাক্ষর রেখেছেন জামাল। সব কিছু মিলিয়ে জাতীয় দলের এই অধিনায়ক এখন দেশের ফুটবলের বড় বিজ্ঞাপন।

এমন একজন ফুটবলারকে নিয়ে উপমহাদেশের যেকোনো লিগে কাড়াকাড়ি হওয়াটা স্বাভাবিক। যেমনটা হয়েছে ভারতে ফুটবল লিগে। ইস্ট বেঙ্গল সহ অন্য ক্লাবে নাম লিখিয়ে জামাল নাম লিখিয়েছেন মোহামেডানে। চুক্তি সই করার আগে অনেক খোজ খবর নিয়েছেন এই ফুটবলার। ভারতের লিগে কে, কেমন দল গড়ে? কোন দলের লক্ষ্য কত দূর। এসব জেনে সই করেন মোহামেডানে। মোহামেডান সব সময় চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইট দিতে দল গড়ে। তাই তিনি এই দলে যোগ দিয়েছেন। ১২৯ বছরের ঐতিহ্যবাহী ক্লাব কলকাতা মোহামেডানে পাঁচ মাসের জন্য চুক্তি করেছেন জামাল।

আই লিগে সেকেন্ড ডিভিশনে গেল মৌসুমে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল মোহামেডান। সেই সুবাদে পরে মৌসুমে প্রথম বিভাগ খেলবে তারা। টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়নশিপ ফাইট দিতে শক্তিশালী দল সাজাচ্ছে এবার। এশিয়ান কোটায় খেলবেন জামাল। সামনে লম্বা সময়ের জন্য চুক্তি করা সুযোগ ছিল মোহামেডানের সাথে। সাইফ স্পোর্টিং ক্লাবের সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকায় মোহামেডানের সঙ্গে চুক্তিটা হয়েছে ত্রিপক্ষীয়। সাইফ স্পোর্টিং ক্লাব ছাড়তে না চাওয়া কলকাতা মোহামেডানের সাথে পাঁচ মাসের চুক্তি করেছেন। পাঁচ মাসের চুক্তি শেষে জামাল ফিরবেন সাইফে।

মোহামেডানের সাথে চুক্তির পর তেমন একটা উত্তেজিত মনে না হলেও তাঁর চোখে মুখে ছিল চ্যালেঞ্জের চাপ। সেসময় কলকাতার দুজন সাংবাদিক দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন সে কথা। পশ্চিমবঙ্গের এক চ্যানেলকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে জামাল বলেছিলেন, ‘আমিও আমার নাম ভারত লিগে লিখতে চাই মুন্না, রুমি, কায়সার, জনি ভাইদের মতো।’

মোনেম মুন্না আর শেখ আসলামদের পরে একটা দীর্ঘ বিরতির পর ২০১৪ সালে ভারতের লিগে নাম লিখিয়েছিলেন মামুনুল ইসলাম। আইএসএলে সেবার অ্যাটলেটিকো ডি কলকাতা দলে তাঁকে কাটাতে হয়েছিল সাইড বেঞ্চে বসে। এরপর আবার বছর ছয়েক দেখা যায়নি এপার বাংলার কোনো ফুটবলার। মোনেম মুন্না, আসলাম, মামুনুলদের পর এবার ভারত লিগে খেলতে গেছেন জামাল ভূঁইয়া। আশা করা যায় মামুনুলের মতো জামালের সাথে এমন ব্যবহার করবে না মোহামেডান।

জামালের ম্যাচ খেলা নির্ভর করবে টিম কম্বিনেশন আর পারফর্মেন্সের উপর। তিনি নিজেও সেই কথা জানেন, সুযোগ পেলে হতাশ করবেন। তিনি জানেন বিদেশের মাটিতে দেশের ফুটবলের মান রাখার বড় একটা দায়িত্ব পরেছে তাঁর কাধে। দেশের ফুটবলে তরুণদের আইকন আর অনেপ্রেরণা হয়ে ওঠা জামালকে এখন ভরসা নাম হয়ে উঠতে হবে। সেখানে জামাল ভাল খেললে ভারতের ফুটবল লিগে বাংলাদেশিদের উপর আস্থা বাড়বে। ভাল খেলতে ব্যর্থ হলে আবার হয়তো দীর্ঘ শুন্যতা তৈরি হতে পারে।

বাংলাদেশের এই অধিনায়ক ভাল করেই জানেন, প্রয়াত মোনেম মুন্নার নাম এখনো কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করে ইস্ট বেঙ্গল। আর সেই কৃতিত্বটা ফুটবল খেলেই অর্জন করেছিলেন মুন্না। মুন্নার নামেই বাংলাদেশের ফুটবল সমীহ করতো ওপার বাংলার ফুটবল পাড়ার আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা। এখন সেই ঝান্ডা জামালের হাতে, সেই সাথে কলকাতার ফুটবলে নিজের জাত চেনানোর।

জামাল নিজেও সেটা বিশ্বাস করেন, নিজেও আশাবাদী তিনি পারবেন। যাবার বেলায় এমনটা জানিয়েও গেছেন, ‘আমি আমার নাম লেখাতে চাই, ভারতের লোকজন যেন জামাল ভূঁইয়ার নামটা ভুলে না যায়। জামাল ভূঁইয়া আসছে, হি ওয়ান্টস টু স্টে এন্ড হি ওয়ান্টসটু মেইক ডিফারেন্স। এটাই আমার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য।’

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link