তিন জোড়া পায়ে বন্ধুত্বের চিরকুট

তরবারিতে মরচে ধরে। সময়ের নিয়মে সিংহের শরীরে বাসা বাঁধে বয়সের ভার। গায়কের গলার জোর কমে আসে- কিন্তু নিজের জাত চেনাতে বেশি সময় নেয় না ভারী তলোয়ার কিংবা বৃদ্ধ সিংহ, সপ্তকের সুরগুলো কানে এলেই চড়া সুর বেঁধে দেন বৃদ্ধ গায়ক,অসহায় বাঘের সামনে আগুনের রিং রাখলে সে এখনো ঝাঁপ দিয়ে প্রমাণ করে দিতে পারে তাঁর রাজকীয় মেজাজ।

লাতিন আমেরিকায় শেষ ফুটবল বিশ্বকাপ গিয়েছিল ২০০২ সালে। ব্রাজিলের সেই বিখ্যাত রোনাল্ডো-রিভাল্ডো জুটি আর গাউচোর মাদকীয় ফুটবল। তারপর ১৭ বছর কেটে গেছে। বিশ্বফুটবলের গর্ভগৃহে আর যায় নি সোনার কাপটা। ইউরোপীয় ফুটবলের পাশে ম্লান হয়ে গেছে লাতিন আমেরিকান আধিপত্য৷ ২০০৬ ইতালি, ২০১০ স্পেন,২০১৪ জার্মানি আর ২০১৮ ফ্রান্স- ইউরোপীয় সাম্রাজ্যে ১৭ বছরে ৪ বার বিশ্বকাপই শুধু নয়, ফাইনালে একমাত্র ২০১৪ মেসির আর্জেন্টিনা ছাড়া উঠতে পারে নি কোনো লাতিন আমেরিকান দলই।

আধুনিক ফুটবলে অর্থ আর বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ও পদ্ধতিতে ট্রেনিং ইউরোপীয় ফুটবলকে নিয়ে গেছে সর্বোচ্চ শিখরে। জার্মানিতে ট্রেনিং-এ প্লেয়ারের হিটম্যাপ দিয়ে তুলে এনালিসিস করা যাচ্ছে দমের ঘাটতি, স্লো মো দিয়ে বোঝানো হচ্ছে পায়ের ড্রিবলের কোথায় দূর্বলতা- লাতিন আমেরিকা ক্রমশ পিছিয়ে যাচ্ছে এই অর্থের আর প্রযুক্তির কাছে। অথচ আজও ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা-উরুগুয়ে-চিলির আনাচে কানাচে গলি ফুটবলে খেলে বেড়ায় ফুটবলের স্তন্যপান করে জন্মানো লাতিন আমেরিকানরা। The Sportsstar লিখেছিল- ‘You can still find the mine of football talents in the streets of Brazil…’

দুর্ধর্ষ বায়ার্ণ মিউনিখের জালে দুটো ঐতিহাসিক বল ফেলে ইতিহাস লিখে দিয়েছেন লিওনেল মেসি৷ দ্বিতীয় গোলের পর থমকে যাওয়া ক্যাম্প নৌ দেখেছে মেসি সাম্রাজ্যের শ্রেষ্ঠ স্ফূরণ। নিজের পায়ের বলটা ম্যানুয়েল নয়ারের পাশ দিয়ে পুশ করেই পিছন ফিরে এসিস্টের নেপথ্যে থাকা লিওকে জাপটে ধরলেন সাও পাওলোর বখাটে ছেলেটা।

ব্রাজিল থেকে আসার পরে যে মেসি ওকে আগলে রেখেছিল বড় দাদার মতো। বার্সা ড্রেসিংরুমে গাউচোর পর ফের ব্রাজিলিয়ান দমকা হাওয়া নিয়ে আসে নেইমার। দানি-লিওর বন্ধুত্বে মিশে যায় ছেলেটা অনায়াসে। পরের সিজনেই লিভারপুল থেকে এসে জোটে তৃতীয় মাথা সুয়ারেজ। উরুগুয়ের রাস্তায় ফ্লোর ক্লিনার লুইস মানসিকভাবে ভেঙে সে সময়ে। লিভারপুল আর উরুগুয়ের একের পর এক বিতর্ক, প্রিমিয়ার লিগে দুরন্ত খেলেও ব্যান- ক্যাম্প ন্যুতে এসে যেন পুরোনো জোটের নতুন সঙ্গী এল মেসি-নেইমারের।

প্র‍্যাকটিসের শুরুতেই লিও একটু একটু করে দুজনকে শিখিয়ে দিতেন বার্সেলোনার ঐতিহ্য আর ইতিহাসের নকশা, মাঠে ক্রুয়েফের স্বপ্ন রূপোলি চাদরের মতো বিছিয়ে দিতেই প্রথম দিন থেকে মাঠে নামল এম-এস-এন। তিন মরশুমে ২৭০ টা গোল। বার্সার হয়ে চাম্পিয়ন্স লিগ, লা লিগা, কোপা দেল রে- সহ সমস্ত ট্রফি। ঐ তিনটে বছর যেন ইউরোপের বুকে বাজল লাতিন আমেরিকান সাম্বা-ট্যাঙো মিউজিকের অর্কেস্ট্রা, লাতিন আমেরিকান প্রতিভা মাথা তুলে দাঁড়াল ইউরোপীয় শক্তির সামনে।

রূপকথা ভেঙে যায়। রেশ থেকে যায় বন্ধুত্বের। দাগ রেখে যায় কিছু আদিম প্রবাদ। লাতিন আমেরিকান ফুটবলের ক্ষয়িষ্ণু সময়ে তিন লাতিন আমেরিকান সুপারস্টার একবার ইউরোপীয় ঔদ্ধত্যকে চ্যালেঞ্জ করলেন, একবার সারা ইউরোপ দেখল লাতিন আমেরিকান মিউজিক সুর-তাল-লয়ে বাজতে শুরু করলে তার মূর্ছনা কোথায় যেতে পারে, সারা পৃথিবীতে নিবে আসা ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার আধিপত্যের শেষ তিন যোদ্ধা কাতালান ক্লাবের হয়ে লিখলেন ইতিহাস।

ট্রফি ক্যাবিনেট হয়ত শেষ কথা বলে না, একটা ট্রেবল হয়ত যথেষ্ট ছিল না কোনোদিনই এই ত্রয়ীকে স্বীকৃতি দিতে। বায়ার্ণ থেকে জুভেন্টাস, মাদ্রিদ থেকে আর্সেনাল যেকোনো প্রতিপক্ষকেই কার্যত দুটো মরশুম ছেলেখেল করেছিল এম এস এন। ম্যাচের আগে একসাথে মাঠে আসা, একসাথে তিনজনের অবসরযাপনে লেগেছিল শিকড়ের টান।

গ্যারিঞ্চা, বেবেতো, পেলে, রোমারিও, ম্যারাডোনা, রোনালদো, রোনালদিনহোর ফুটবল সাম্রাজ্যের পতাকা কাঁধে করে ইউরোপ জয় করেছিল ত্রয়ী৷ হয়ত শেষবার। হয়ত লাতিন আমেরিকান আধিপত্যের শেষ তিনযোদ্ধা আর একসাথে মাঠে নামবেন না কোনোদিন, ফের ইউরোপীয় ফুটবলের যুগে চাপা পড়ে যাবে লাতিন আমেরিকার ঘ্রাণ তবু আমাদের মতো নব্বই-এর দশকের ছেলেমেয়েদের কাছে বহুদিন পর ছেলেবেলার রিকেলমে-তেভেজের আর্জেন্টিনা কিংবা রোনাল্ডো-রিভাল্ডোর ব্রাজিলের ফুটবল প্যানোরামার স্বাদ দিয়েছিল মেসি-সুয়ারেজ-নেইমার।

চোখ বুজে পড়ে ফেলা স্কোয়ার পাসগুলো? না! ওরা পাস নয়, ওরা বন্ধুত্বের গল্প লেখা চিরকুট হয়ে ঘুরত ঐ তিনজোড়া পায়ে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Share via
Copy link