সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ। ক্রীড়াক্ষেত্রে এই বিষয়ে আলোচনায় কয়েকটি নাম মোটামুটি সর্বগ্রাহ্য। ক্রিকেটে ডন ব্র্যাডম্যান ও গ্যারি সোবার্স। ফুটবলে পেলে, মারাদোনা, মেসি। টেনিসে ফেডেরার, সাম্প্রাস, জকভিচ। স্প্রিন্টার হিসেবে উসাইন বোল্ট। সাঁতারে ফেল্পস। এথলেটিক্সে জেসি ওয়েন, কার্ল লুইস। এ তো গেল শুধু পুরুষদের কথা। এছাড়া নারীরাও আছেন।
অনেকের মতে, এই প্রচেষ্টাই হাস্যকর। ক্রিকেটের কথাই ধরুন। দুই প্রজন্মের ব্যাটসম্যানের তুলনাই অনেকে মেনে নিতে পারেন না। নিয়ম বদলেছে, পিচের চরিত্র বদলেছে, ব্যাট বদলেছে, বোলিংয়ের মান বদলেছে। ওপেনিং ব্যাটসম্যানের সঙ্গে মিডল অর্ডারের তুলনাই বা কীভাবে হয়? ব্যাটসম্যানের সঙ্গে বোলারের? বা ফাস্ট বোলারের সঙ্গে স্পিনারের? অফ স্পিনারের সঙ্গে লেগ স্পিনারের?
তবুও এই বিষয়ে আলোচনা মাঝে মধ্যে হয়। যেমন বিংশ শতকের শেষে হয়েছিল। শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদ কে? কার প্রভাব সব চাইতে বেশি? স্পোর্টস ইলাস্ট্রেটেড এবং বিবিসি – এই দুই বিখ্যাত সংস্থা আলাদা আলাদা ভাবে বেছে নিয়েছিল শতাব্দীর শ্রেষ্ঠ ক্রীড়াবিদকে। দুই সংস্থাই কিন্তু শেষে একটা নামই বেছেছিল – মোহাম্মদ আলী। বক্সার। শো ম্যান। এবং আরও অনেক কিছু।
আমার কিশোর বয়সে একজন বক্সারকেই চিনতাম – মাইক টাইসন। মূর্তিমান আতঙ্ক। প্রথম রাউন্ডে মাত্র কয়েক সেকেন্ডেই নির্ধারিত করে ফেলতেন লড়াইয়ের ফলাফল। কখনও মাত্র একটি ঘুষিই যথেষ্ট, কখনও বা চার – পাঁচটা ঘুষির কম্বিনেশন। তবু আমরা মনেপ্রাণে জানতাম যে টাইসনের ঘুষি ঠিকঠাক পড়লে ঐ একটাই যথেষ্ট। বাকিগুলো সুপারফ্লুয়াস। টাইসনের সঙ্গে লড়াইয়ের ঔধ্যত্যের শাস্তি। দ্য গ্রেটেস্ট এভার – এই কথাটা টাইসনের সম্বন্ধে প্রায়ই শোনা যেত। এবং এই আলোচনাতে সেই নামও উঠে আসত বারবার।
মহম্মদ আলি। আগের নাম ক্যাসিয়স ক্লে। যার সম্বন্ধে বহুল প্রচলিত প্রবাদ ছিল ‘ফ্লোটস লাইক আ বাটারফ্লাই, স্টিংস লাইক আ বি’। প্রজাপতির মতো সুন্দর, মৌমাছির মতো মারাত্মক। পরে কিছুটা খোঁজখবর নেওয়া আরম্ভ করলাম মহম্মদ আলি সম্বন্ধে। ১৯৪২ সালে জন্ম। ১৯৬০ সালের অলিম্পিক স্বর্ণপদক বিজয়ী। ১৯৬১ সালে নাম ও ধর্ম পরিবর্তন। ১৯৬৪ সালে ওয়ার্ল্ড হেভিওয়েট বক্সিং চ্যাম্পিয়ন।
শেষোক্ত খেতাবটি আলি দখল করেন সোনি লিস্টন নামের এক অসম্ভব শক্তিশালী বক্সারের সঙ্গে লড়াইয়ের পর। অনেকটা টাইসনের মতোই লিস্টন বিখ্যাত ছিলেন তার ঘুষির জোরের জন্য। অনেক বোদ্ধার ধারণা ছিল সেই লড়াইয়ে আলি হয়ত শেষ অব্দি আসবেনই না, ভয় পেয়ে পালাবেন। এবং যদি ভুল করে লড়তে আসেন সেক্ষেত্রে ভয়ংকরভাবে আহত হবেন। তার কারণ লড়াইয়ের আগে লিস্টনকে ক্ষেপাবার কোন কসুর রাখেননি আলি। এমন কি রাত দুটোর সময় দলবল নিয়ে চড়াও হয়েছিলেন লিস্টনের বাড়িতে। ঘোষণা করেছিলেন কালো ভাল্লুকটাকে মেরেই ফেলব। অথচ বেটিং মার্কেটে ৭-১ আন্ডারডগ ছিলেন আলি সেই লড়াইয়ে।
প্রথম দিকে, সেদিন লিস্টন ছুঁতেই পারেননি আলিকে। বক্সিং নয়, সেদিন যেন রিঙের মধ্যে ব্যালের প্রদর্শনী করবেন বলে ঠিক করেছিলেন আলি। সেই সঙ্গে অসম্ভব দ্রুতগতির পাঞ্চিং। জ্যাব। রাইট লেফট কম্বিনেশান। শুধুমাত্র পঞ্চম রাউণ্ডের শুরুতে বেকায়দায় পড়েন আলি। লিস্টনের শরীরে লাগানো মলম কীভাবে যেন তার চোখে ঢুকে গিয়ে কিছুক্ষণের জন্য তার দৃষ্টিশক্তি নষ্ট করে দিয়েছিল। সেটা বুঝতে পেরে লিস্টন প্রাণপণ চেষ্টা করেছিলেন সেই রাউণ্ডে আলিকে নক আউট করতে। কিন্তু টিকে রইলেন আলি। কিছু পরে তার চোখ পরিষ্কার হলে আবার আরম্ভ করলেন আক্রমণ। আর বেশিক্ষন দাঁড়াতে পারেননি লিস্টন।
লড়াইয়ের শেষে আলীকে দেখা যায় তিনি সাংবাদিকদের উদ্দেশ্যে চিৎকার করে বলছেন – ইট ইয়োর ওয়ার্ডস! আই শুক আপ দ্য ওয়ার্ল্ড! এবং সেই কথা যা তিনি এরপর বারবার বলবেন – আই অ্যাম দ্য গ্রেটেস্ট! প্রথম প্রথম হয়ত নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়ানোর জন্য কথাটা বলতেন আলী। তারপর পুরো পৃথিবী মেনে নেয়। মোহাম্মদ আলী – দ্য গ্রেটেস্ট!
পরবর্তী কালে লিস্টন ছাড়াও দুই কিংবদন্তি মুষ্টিযোদ্ধাকে পরাজিত করেন আলী। প্রথম, জো ফ্রেজিয়ার। পৃথিবীর সর্বকালের অন্যতম সেরা বক্সার। দ্বিতীয়, জর্জ ফোরম্যান। যার ঘুষির জোর, অনেকের মতে, মাইক টাইসনের চেয়েও বেশি ছিল। তবে ফ্রেজিয়ারের কাছে প্রথম লড়াই হেরে যান আলী। তারপর দু’বার তাকে হারান। শেষ লড়াইয়ের পর আলী বলেন, মৃত্যুর এতটা কাছাকাছি তিনি কোনদিন পৌঁছান নি।
কিন্তু ফ্রেজিয়ার বা ফোরম্যানের মুখোমুখি হওয়ার আগে মোহাম্মদ আলী তার চেয়েও কঠিন প্রতিপক্ষের মুখে পড়েছিলেন। সেই লড়াই ছিল রিঙের বাইরে। যখন তিনি অস্বীকার করেছিলেন ভিয়েতনাম যুদ্ধে নিজের দেশকে সমর্থন করতে। যখন তিনি অস্বীকার করেছিলেন সেনাবাহিনীতে যোগ দিতে। যে আমেরিকা কালো মানুষদের অধিকার, সম্মান দিতে পারে না, সে কোন অধিকারে দেশপ্রেম আশা করে তাদের কাছে? আলী ভিয়েতনামের গরীব, দুর্বল মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধে যাবেন না, তারা তার সঙ্গে কোনরকম শত্রুতা করে নি।
সমালোচনার ঝড় বয়ে গিয়েছিল আলীর বিরুদ্ধে। এমনিতেই নিজের বড় বড় কথার জন্য এবং ইসলাম ধর্ম গ্রহণের জন্যে আলী অনেকের চক্ষুশূল ছিলেন। এরপর তার শরীরে দেশদ্রোহীর স্টিকার সেঁটে দেওয়া হল। যে দেশের হয়ে লড়াই করতে অস্বীকার করে, সে দেশদ্রোহী না তো কী? ক্ষমা চাইতে হবে আলিকে। নইলে তার বক্সিং ক্যারিয়ার শেষ। সঙ্গে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। বারবার প্রাণহানিরও হুমকি দেওয়া হয় আলীকে।
পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিশালী দেশের বিরুদ্ধে সেদিন মাথা নোয়াননি মোহাম্মদ আলী। নিজের ক্যারিয়ার বা অর্থের বিনিময়ে বিকিয়ে দিতে রাজি হননি নিজের বিবেককে। তখন আলীর বয়স পঁচিশ। নিজের শারীরিক ক্ষমতার তুঙ্গে ছিলেন তখন। একাধারে বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং ঘৃণ্য বক্সার।
আলির কাছ থেকে কেড়ে নেওয়া হয়েছিল বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের খেতাব। সেই সঙ্গে বক্সিং গ্লাভসও। প্রায় চার বছর প্রতিযোগিতামূলক বক্সিং থেকে বাইরে ছিলেন আলী।
কিন্তু আলী যেমন অনেক কিছু হারিয়েছিলেন, পেয়েছিলেনও অনেক কিছু। তিনি হয়ে উঠেছিলেন শান্তি এবং কালো মানুষের লড়াইয়ের প্রতীক। দেশ, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে আলী হয়ে উঠেছিলেন পৃথিবীর সবচেয়ে জনপ্রিয় মানুষ। পরবর্তীকালে আমেরিকার সাধারন মানুষও ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরোধী হয়ে ওঠে।
যারা এক সময় আলীর সমালোচনায় সোচ্চার হয়েছিলেন, তারা পরে স্বীকার করে নিয়েছিলেন যে সেদিন আলী ঠিক ছিলেন, নিজেরা ভুল। এবং সবশেষে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট আলীকে সব অভিযোগ থেকে মুক্তি দিয়েছিল। ফিরিয়ে দিয়েছিল তার গ্লাভস। আরও দু’বার বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছিলেন আলী।
সর্বকালের সেরা বক্সার আলী কিনা সে সম্বন্ধে কিছুটা হলেও বিতর্ক রয়েছে। জো লুইস, রকি মারসিয়ানো, জো ফ্রেজিয়ার বা মাইক টাইসনের ফ্যানেরা তাদের প্রিয় বক্সারের পক্ষে তথ্য এবং যুক্তি পেশ করার জন্যে সবসময়ই তৈরি। কিন্তু, তারাও মন থেকে জানেন ‘দ্য গ্রেটেস্ট’ একজনই – মোহাম্মদ আলী। কারণ আলীর গ্রেটনেস শুধু বক্সিং রিং-এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না।