কাগজে-কলমে বয়স ৩৫ পেরিয়েছে। সাথে আছে এক যুগেরও বেশি সময় ধরে সর্বোচ্চ পর্যায়ের ক্রিকেট খেলার অভিজ্ঞতা। টেকনিক, ক্লাস আর এই পরিপক্কতা মিলে মুশফিকুর রহিম এখন টেস্ট ক্রিকেটের জন্য একেবারে পোড় খাওয়া লোক। আর এই সবকিছুর পুরো ব্যবহার করেই তিনি গতকাল সারাদিন বাইশ গজে পড়ে ছিলেন। আর আজ সকালে ব্যাট হাতে পুরো মাঠটাকে মুশফিক নিয়ন্ত্রণ করেছেন। যেন মুশফিকের এই শো তে মাঠের বাকি ক্রিকেটাররাও দর্শক।
এমনই তো হবার কথা ছিল। বাংলাদেশের ক্রিকেটে আসা সবচেয়ে টেকনিকাল ব্যাটসম্যানদের একজন মুশফিকুর রহিম। ফলে ক্যারিয়ারের এই সময়ে এসে টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর স্রেফ রাজত্ব করার কথা। বাংলাদেশের ক্রিকেটও তাঁর কাছে এই দাবিই করে। তবে তিন ফরম্যাট মিলিয়ে তিনি বোধহয় আর পেরে উঠছিলেন না। মাঝে কয়েকটা মাস খানিক খেই হারিয়ে ফেলেছিলেন।
এমনকি টেস্ট ক্রিকেটেও গত একবছর সময়টা ভালো যাচ্ছিল না। বড় ইনিংসের দেখা পাচ্ছিলেন না। সাদা পোশাকের ক্রিকেটে আবার রানে ফিরলেন চট্টগ্রাম টেস্টে। যেই রিভার্স স্যুইপ নিয়ে এত আলোচনা-সমালোচনা সেটাকে একেবারে ঝেড়ে ফেলে দিলেন। নিজের সলিড টেকনিকে উপর আস্থা রেখেই মুশফিক রান পেলেন, আত্মবিশ্বাস খুঁজে পেলেন।
তবুও চট্টগ্রাম টেস্টে তাঁর সেঞ্চুরি নিয়েও খানিক সমালোচনা ছিল। কেননা ম্যাচের চতুর্থ দিনে তখন বাংলাদেশের একটু দ্রুত রান তুলে শ্রীলঙ্কাকে ব্যাটিংয়ে পাঠানো প্রয়োজন ছিল। আরেকপ্রান্ত থেকে সাকিব হাত খোলার চেষ্টা করলেও মুশফিক সেদিকে ভ্রুক্ষেপ করেননি। তিনি নিজের মতই খেলে গিয়েছেন। ম্যাচের পরিস্থিতি, দলের প্রয়োজন তাঁর কাছে খুব একটা গুরুত্ব পায়নি। তবে সেই সময়ে ড্রেসিং রুম থেকে মুশফিকের কাছে কোন বার্তা গিয়েছিল কিনা সেই প্রশ্নও থাকে।
তবে ঢাকা টেস্টে তিনি আর কোন আলোচনা কিংবা সমালোচনার সুযোগ রাখেননি। তাঁর তীব্র সমালোচকও এই ইনিংসের মুগ্ধতা টের পাবে। গতকাল দলের বিপর্যয়ে হাল ধরেছিলেন। লিটনের সাথে সারাটা দিন আকড়ে পড়েছিলেন বাইশ গজে। দুজনই তুলে নিয়েছিলেন সেঞ্চুরি।
আজ এই দুইজনের উপর আবার প্রথম থেকে শুরু করার দায়িত্ব ছিল। অন্তত প্রথম সেশনটা টিকে থাকতে হতো। রান বাড়িয়ে নিতে হতো। সেভাবেই শুরু করেছিলেন দুজনে। তবে লিটন ফিরে গেলে মোসাদ্দেকও মুশফিককে সঙ্গ দিতে পারেননি। ফলে মুশফিক বাদে আর কোন স্বীকৃত ব্যাটসম্যান ছিলেন না।
আর তখনই আসলে মুশফিকের এই ইনিংসের সৌন্দর্য্যটা ফুটে উঠে। তাইজুলের সাথে মুশফিকের সেই জুটিতেই তিনি পরিচয় দিলেন নিজের পরিপক্কতার। তাইজুল ব্যাট করতে নামার পরেই হাত খুলেন মুশফিক। দ্রুত রান তুলে নেয়ার চেষ্টা করেন।
শ্রীলঙ্কার বোলারদের রীতিমত নাচিয়েছেন এই সময়টায়। বাউন্ডারি আদায় করেছেন, ওভারের শেষ সিঙ্গেল নিয়ে নিজের কাছে স্ট্রাইক রেখেছেন। শ্রীলঙ্কান ক্রিকেটাররা মুশফিকের পরিকল্পনা বুঝেও যেন কিছুই করতে পারছিলেন না। যেন মুশি যা করতে চাইবেন ঠিক তাই হবে। একটা কর্তিত্ব নিয়ে খেলে যাচ্ছিলেন।
লিটনের সাথে ২৭২ রানের যেই জুটি গড়েছেন সে জুটিতে মুশফিক ২৬৭ বল খেলে করেছিলেন ১১৯ রান। অর্থাৎ তাঁর স্ট্রাইকরেট সেই জুটিতে ছিল ৪০ এর কাছাকাছি। তবে তাইজুলের সাথে জুটিতে একেবারে ভিন্ন চেহারা মুশফিকের। এই দুজনে মিলে ৭৯ বল খেলে করেছে ৪৯ রান। আর সেখানে মুশফিকের ব্যাট থেকেই এসেছে ৩৪ রান। ব্যাটিং করেছেন প্রায় ৯০ স্ট্রাইক রেটে। পরে একদম শেষ ব্যাটার এবাদতের সাথেও উইকেটে ছিলেন বড় সময়। এবাদত আউট হওয়ার সময়ও ১৭৫ রানে অপরাজিত ছিলেন মুশফিকুর রহিম।
তাইজুলের সাথে এই জুটিতেই মুশফিক ছুয়েছেন দেড়শ রানের মাইলফলক। মুশফিক এই নিয়ে পঞ্চম বারের মত টেস্টে ১৫০-এর ওপর রান করলেন এক ইনিংসে। এটাই বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
গতকাল সারাদিন মুশফিক অসাধারণ ব্যাটিং করেছেন সেটা সত্যি। তবে আজ সকালে মুশফিক যেই অথরিটি নিয়ে খেললেন সেটাই আসলে এই ব্যাটসম্যানের মাপটা বুঝিয়ে দেয়। শুধু এই অংশটুকুর জন্যই তাঁর ইনিংসের মান বেড়ে যায় বহুগুনে। আর আবারো দাবিটা জোরালো হয়। টেস্ট ক্রিকেটে এই মুশফিককেই তো চাই।